এবি ডি ভিলিয়ার্স, ব্যর্থ জাহাজের নাবিক

ক্রিকেটীয় জাতি হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্জনের তালিকা স্রেফ খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ও দ্বিপাক্ষিক সিরিজেই সীমাবদ্ধ। ১৯৯৮ সালের আইসিসি নকআউট টুর্নামেন্ট বাদ দিলে এই দলটির প্রাপ্তির তালিকায় কোনো ট্রফি নেই।

অথচ দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেট প্রতিভার কোনো অভাব কোনোকালেই ছিলো না। মারাত্মক সব প্রচলিত, অপ্রচলিত প্রতিভা উপহার দিয়েছে তারা পৃথিবীকে। তাদেরই একজন এবি ডি ভিলিয়ার্স; কারো কারো কাছে একজন আধুনিক ক্রিকেট গ্রেট। সেই ডি ভিলিয়ার্সও কিন্তু শেষ বিচারে একজন শূন্য হাতে বিদায় নেওয়া মানুষ।

ডি ভিলিয়ার্সের কাছে কখনো পাত্তা পায়নি ক্রিকেটের কোনো ব্যাকরণ। গুরুত্ব পেয়েছে নিজের সামর্থ্যের সঠিক ব্যবহার! হোক সেটা ব্যাকরণ মেনে আর নাই মেনে। নি:সন্দেহে ডি ভিলিয়ার্স টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজের অবস্থান কে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন। যেখানে কিনা তাকে খুঁজতে ব্যবহার করতে হয় বায়নোকুলার। নিজেকে তৈরি করেছেন এই ফরম্যাটের পরিপূরক। ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট কে প্রেমের সাথে তুলনা করা হলে, ডি ভিলিয়ার্স এই ফরম্যাটের শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন কোনোপ্রকার সংকোচ ছাড়াই।

পাশাপাশি সকল ফরম্যাটেই নিজের বিশালতা স্পষ্ট করেছেন। অস্পষ্ট শুধু তার সফলতার চিত্র। আফ্রিকানদের অধরা স্বপ্নগুলো পূরণ করতে এবিডি ছিলেন এক সময় সমর্থকদের মূল ভরসার প্রতীক। পূর্বের আঁধারের সকল দিনগুলোকে রোদের আলোয় আলোকিত করে রাঙিয়ে তোলার প্রয়াসেই ক্রিকেটের সকল ব্যাকরণকে তুড়ি মেরে তাড়িয়েছেন। ব্যক্তিগত অর্জনে নিজেকে রঙিন করলেও, রাঙাতে পারেননি নিজের কোনো দলকেই।

২০১৫ সালের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।

অকল্যান্ডের গ্যালারি ভরা কিউই সমর্থকদের ভিড়ে গুটিকয়েক প্রোটিয়া সমর্থক আশা বুনে যাচ্ছে। আশার মূল কেন্দ্র বিন্দুতেই অবস্থান অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্স। কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারির রঙ কেবলই কালো আর নীলের সংমিশ্রণ। স্বাগতিকদের ফাইনালে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্ন কে বাস্তবে উপভোগ করতেই গ্যালারিতে ফাঁকা নেই একটি আসনও।

তারপরেও কিছু প্রোটিয়া সমর্থক গ্যালারীর কোণায় বসে প্রার্থনায় মগ্ন। হাজার-হাজার কিউই দর্শকের ভিড়ে প্রোটিয়া সমর্থকদের চিৎকারের আওয়াজ কানে এসে না পৌঁছালেও প্রার্থনার প্রতিটা শব্দ অনুভব তো ঠিকই করা যায়। সমর্থকদের একমাত্র চাওয়া — এইবার আমাদের কাপটা চাই।

ব্যাট হাতে ফাফ কে সঙ্গী করে কিউই প্রাচীর বেশ সহজেই ভেঙেছিলেন। চার-ছয়ের বৃষ্টিতে অকল্যান্ডের আকাশে বিষাদের সুর বাজিয়েছেন। স্বাগতিকদের গ্যালারি ও ডাগআউটেও ছিলো সেই দুশ্চিন্তার স্পষ্ট চিত্র।

বৃষ্টির কারণে খেলা পুরো ১০০ ওভারে গড়ায়নি। উভয়পক্ষের জন্য বেঁধে দেওয়া ৪৩ ওভার খেলায় উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলো কয়েকগুণ। দীর্ঘদিনের না পারার বেদনা এবার ঘুচেই যাচ্ছিলো প্রোটিয়াদের। চোকার্স তকমা মুছে ফেলতে দলনায়ক ভিলিয়ার্সের দিকে সবার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি। বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নামা কিউইরাও নিজের মাঠের ফায়দা প্রতি বলে বলে নিয়েছে।

রান তাড়া করতে নামা কিউইদের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে কূল কিনারা হারিয়ে দিশেহারা প্রোটিয়া বোলার ও ফিল্ডাররা। গ্যালারিতে চলছে কিউই সমর্থকদের জয়ের কাছাকাছি যাওয়ার তীব্র উন্মাদনা। যদিও নক আউট গেমের রোমাঞ্চ তখনও বাকি। সেদিনের রোমাঞ্চ কিউইদের জন্য সুখকর হলেও, মোটেও উপভোগ্য ছিলোনা প্রোটিয়াদের।

ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম তুখোড় ফিল্ডার হয়েও গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন ভিলিয়ার্স। ত্রিশতম ওভারের খেলা চলছে মাঠে, নিজের বলেই কোরি এন্ডারসনের স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড এক ক্যাচ মিস করেন ভিলিয়ার্স। পরের ওভারেই মাঝপথে আটকে যাওয়া ব্যাটসম্যান কে অনায়াসেই রান আউট করতে গিয়ে প্রথম সুযোগেই বল লুফে না নিতে পারায়! শুধুমাত্র স্ট্যাম্প ভেঙে সহজ আউটের সহজ সুযোগ মিস করেন ভিলিয়ার্স।

ত্রিশ পার হওয়া তরতাজা যুবকের কাছে এটা মোটেও কঠিন কিছুই ছিলোনা। বাউন্ডারিতে ঝাঁপিয়ে বল কে হাতের নাগালে পেয়েও আটকাতে পারেননি চার হওয়া থেকে৷ ইনিংসের শেষের দিকে ডিরেক্ট থ্রো তে মিস করেন ভেট্টোরি কে রান আউট করার সুযোগ।

অন্যান্য বহু ম্যাচে এক নিমিষেই এমন অসংখ্য ফিল্ডিং করেছেন তিনি, তারচেয়েও চমকপ্রদ কিছুই তিনি নিয়মিত করে যাচ্ছিলেন। প্রতিটা সহজ সুযোগ মিস হতে হতেই, দক্ষিণ আফ্রিকার হাত থেকে ম্যাচ ফসকে যায়। কাপ্তানের দেখানো পথেই হেঁটেছে কুইন্টন ডি কক, ফারহান বেহারডিনও। যোগ দেন ক্যাচ ও রান আউট মিসের মিছিলে। বড় ম্যাচের চাপ না নিতে পারার রোগ থেকে সেরে উঠতে পারেননি কাপ্তান সহ দলের বাকি সদস্যরাও।

প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এসব ঘটনা কে বড় করে দেখা হচ্ছে ?

মূলত বড় ম্যাচে এগুলোই পার্থক্য গড়ে দেয়। শিরোপার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয় একটা দল কে। আর বিপরীত কিছু ঘটলে ফ্লাড লাইটের উজ্জ্বল আলোও নিভু নিভু হয়ে আসে। এলোমেলো ক্রিকেট সুখের বার্তা কখনোই দিতে পারেনা। বড় আসরের হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে দলের পারফরম্যান্সের এক পাশের পাল্লা ভারি রেখে অন্যপাশ একেবারেই নীচু করে বিদায় নিয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্যাট হাতে উজ্জ্বল থেকেও ভিলিয়ার্স ও দলের বাকিদের ফিল্ডিংয়ে শিশুসুলভ ভুল ছিটকে দিয়েছিলো পুরো দলকে ফাইনালে যাওয়ার পথ থেকে।

ম্যাচশেষে শুধু চোখের অশ্রুই তাকে সঙ্গ দিয়েছে, পুরো আসরে তার দানবীয় ব্যাটিং-ফিল্ডিংয়ে ঝরে পড়া ঘামের বিন্দু নীরবেই হারিয়ে মুখ লুকিয়েছে কয়েক ঘন্টার ব্যর্থতার সাগরে।

ঠিক পরের বছর ভারতের মাটিতে আসর বসেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। ততদিনে মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি তকমা ভিলিয়ার্সের গায়ে। মূলত ২০১৫ বিশ্বকাপের আগেই তার গায়ে লেগেছিলো এই তকমা। ভারতের মাঠ বরাবরই চেনাজানা টি-টোয়েন্টি স্টার দের জন্য। এবিডি ও তার সৈন্যরা নিয়মিতভাবে আইপিএলে অংশ নিয়ে থাকেন।

তাই কন্ডিশন মাথাব্যাথার কারণ হওয়ার উপায় নেই। দলের বেশীরভাগ ক্রিকেটার নানানসময়ে অংশ নিয়েছে আইপিএলে। শিরোপা উঁচিয়ে ধরার আশা তাই পুরোপুরি যৌক্তিক। মি. ৩৬০ ডিগ্রী অতিচমকপ্রদ কিছু করে দল কে ফাইনালে নিয়ে যাবেন। প্রথমবারের মত কোনো আইসিসি ট্রফি জেতাবেন দলকে। আশায় বুক বেঁধে ছিলো সমর্থকরা। না এবারও কিছুই হলোনা!

চেনা পরিবেশে জ্বলে উঠার বিপরীতে একেবারেই নিষ্প্রভ ছিলেন ভিলিয়ার্স। ব্যাটে-বলে যথাযোগ্য সংযোগ করে মাঠে থিতু হতেই প্রতিম্যাচে বেগ পেতে হয়েছে তাকে। কখনো স্লোয়ারে তো কখনো স্পিনে কাটা পড়েছেন। দলের বিপদের মূহুর্তেও হাল ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার ব্যাটের মতোই তীর হারা সাগরে সাঁতরাতে গিয়ে খেই হারায় দলের নকআউটে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা। দল মোটে জয়লাভ করে দুই ম্যাচে। চারম্যাচে সবমিলিয়ে ভিলিয়ার্সের সংগ্রহ দাঁড়ায় মাত্র ১১০।

সময়ের ব্যবধানে মাত্র এক বছর। ২০১৭ তে ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দক্ষিণ আফ্রিকার দাপুটে প্রত্যাবর্তন আশা করা হচ্ছিলো। নতুন আইসিসি ইভেন্ট, নতুন স্বপ্ন! সবমিলিয়ে নতুন আশায় বুক বেঁধে টিভি স্ক্রিনে সমর্থকরা। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের ভাগ্যাকাশে এবার মেঘ সরে নতুন সময় উঁকি দিবে নিশ্চিত। আবহাওয়ার পরিবর্তন তো আসবেই।

তিন ম্যাচে ভবিষ্যত নির্ধারিত হওয়া টূর্ণামেন্টের শুরুটা দলগতভাবে ভালো হলেও, ব্যাট হাসেনি ভিলিয়ার্সের। বাকি দু ম্যাচেও ছিলো একই দশা! ব্যাটিংয়ে ছিলোনা আত্মবিশ্বাসের কোনো ছিঁটেফোঁটাও। রানের খাতা না খুলে প্রথম বলে বিদায় নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে। তিনম্যাচে দলের জয় একটি আর ভিলিয়ার্সের তিন ম্যাচে সংগ্রহ দাঁড়ায় মোটে ২০ রান। বিশ্ব আসরে ভিলিয়ার্সের অফ-ফর্মের ধারা চিরন্তন সত্যই মনে হচ্ছিলো। দল হিসেবে তো বহু আগে থেকেই বিশ্ব আসরের পারফরম্যান্সে ছিলো তারা ব্যাপক নিন্দিত।

২০১৪-১৭ পর্যন্ত একটানা ৪ বছর আইসিসি ইভেন্ট চলেছে। কোথাও ধরা দেয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার সাফল্য। দু’বার বিদায় নিয়েছিলো নক আউট স্টেজ থেকে। এই বাঁধা টপকানো আর সম্ভব হয়নি তাদের। নিজেদের চোকার্স তকমার প্রতি ‘সুবিচার’ করে গেছে নির্দ্বিধায়।

বাংলাদেশের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে পাঁচ ম্যাচে ১২৯ রান সংগ্রহ করেন ভিলিয়ার্স। সেমিফাইনালে গিয়ে পুনরায় কাটা পড়ে তার দল। অধিনায়ক হিসেবে বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দল কে টপকাতে পারেননি সেমিফাইনালের বাঁধা। অগোছালো ক্রিকেটকে সঙ্গী করে বাংলাদেশ থেকে ফাইনালে পা না রেখেই পাড়ি জমিয়েছিলো নিজ দেশে দল সহ।

সবমিলিয়ে চারটি আইসিসি ইভেন্টে দল কে নেতৃত্ব দিয়েও সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যাটে-বলে, ফিল্ডিং ও অধিনায়কত্ব ছিলেন একেবারেই সাদামাটা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পারফরম্যান্সে দল কে আশা দেখালেও সমাপ্তি কখনোই তার দ্বারা হয়নি।

শুধু জাতীয় দলে নয়, সাফল্য পাননি ডি ভিলিয়ার্স আইপিএলেও।

আইপিএলে চাহিদার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেও দল কে শিরোপার স্বাদ পাইয়ে দিতে পারেননি। অধিনায়ক না হওয়ায় বেশ নির্ভার মনে হয় তাকে সবসময় আইপিএলে। তাই ফিল্ডিং আর ব্যাটিংয়ে এক বিধ্বংসী মি. ৩৬০ ডিগ্রীর দেখা মিলে। পরিশ্রমী এক সৈনিকের দেখা বারংবার পেয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব আইপিএলে এবিডির মাধ্যমে।

কিন্তু হায়! আইপিএলের শিরোপার একেবারে কাছে পৌঁছেও ২০১৬ ফাইনালে দুই অঙ্কের ঘরেও পৌঁছাতে পারেননি নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ। অন্যান্যদিন বোলারদের উপর অত্যাচার চালালেও ফাইনালে ছিলেন অচেনা একজন। এবারের নক আউটে দলের বাকিদের ব্যর্থতায় মাঠে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জে ধীরগতির ব্যাটিংয়ে রান করলেও দল ফাইনালের টিকেট নিশ্চিতে অকৃতকার্য হয়।

ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন এবি ডি ভিলিয়ার্স। বিষ্ময়কর একজনও বটে। যার ব্যাটিংয়ে লেগে থাকে রোমাঞ্চের ছোঁয়া। বাইশ গজ থেকে বাউন্ডারি, কমেন্ট্রিবক্স, গ্যালারি, ভিনদেশও স্বাদ আস্বাদন করে এই রোমাঞ্চের। কিন্তু এই স্বাদের ঘাটতি দেখা দেয় আইসিসি ইভেন্ট ও বৈশ্বিক কোনো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির নক আউট চ্যালেঞ্জে।

খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় ফলাফল বরাবর-ই নিস্ফল। রচনা করতে পারেননি কোনো মহাকব্যিক বিজয়ের গল্প জাতীয় দলের হয়ে। পরাজিত সৈনিক হিসেবে আবির্ভাব তার প্রতিনিয়ত। অভিমান ও অবসাদে ২০১৮ তে ছেড়েছেন জাতীয় দলের ঠিকানা। জয়ের তাড়নায় অতৃপ্তির বেদনাকে মুছে ফেলতে ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে পুনরায় দলে ফিরতে চাইলেও সুযোগ হয়নি। আক্ষেপ নিয়েই শেষ হয় ক্রিকেটের ৩৬০ ডিগ্রি অধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link