বাংলাদেশ ক্রিকেটে বর্তমানে পেসারদের বেশ দাপট। বলতে গেলে পেস বিভাগে ক্রিকেট ইতিহাসে নিজেদের সেরা অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। তাসকিন, মুস্তাফিজ, এবাদত, সাইফউদ্দিনদের সাথে একঝাঁক উঠতি পেসাররা আছেন অভিষেকের অপেক্ষায়। বলতে গেলে পেস বিভাগটা এখন ‘সেইফ হ্যান্ড’-এ। ২০১৫ সালের পর থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে বেশ পরিবর্তন দেখা দেয়। ঘরের মাটিতে দলটা একরকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। মুস্তাফিজ-তাসকিনদের মত তারকাদের উত্থানটাও সেই সময়।
২০১৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে বেশ কিছু তরুণ সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারকে নেওয়া হল। এর মধ্যে একজন ছিলেন আবু হায়দার রনি। না, একেবারেই অপরিচিত কোনো নাম না। ততদিনে দিনে সাড়া ফেলে দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে। ২০১৫ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) এই আবু হায়দার রনি ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। বিপিএল দিয়েই পরিচিতি, ক্রিকেটে উত্থান বলতে পারেন। ক্রিকেট সমর্থকরাও চাচ্ছিলেন রনিকে দ্রুত জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হোক। এরপর আর জাতীয় দলে ডাক পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। পরের জিম্বাবুয়ে সিরিজেই সুযোগ পেয়ে গেলেন।
২০১৫ বিপিএল। ইনস্যুইংয়ের পাশাপাশি দুর্দান্ত ইয়র্কারে স্টাম্প উপড়ে ফেলেছেন – এমন দৃশ্য পুরো আসর জুড়েই দেখা গেছে রনির বোলিংয়ে। বাঁ হাতি পেসার হিসেবে মুস্তাফিজের সাথে দারুণ জুটি হতে পারেন – এমনটাই ভাবছিলেন সমর্থকরাও। বাংলাদেশ ক্রিকেট পেতে যাচ্ছে আরেক তারকা। স্যুইং, ইয়র্কার ছাড়াও স্লোয়ারটাও দিতে পারতেন দুর্দান্ত। সব মিলিয়ে বলা চলে ‘পরিপূর্ণ এক প্ল্যাকেজ’।
ঢাকা থেকে প্রায় ১৬৮ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ বিভাগের এক জেলা নেত্রকোনা। চীনামাটির পাহাড়ের জন্য অবশ্য বেশ বিখ্যাত জায়গা। এই নেত্রকোনা থেকেই উঠে আসেন আবু হায়দার রনি। জাতীয় দলে নিজের সেরাটা দিয়ে নিজ জেলার গর্ব হতে চেয়েছিলেন।
কথায় আছে, ‘ অকালে বাড়ে সকালে মরতে’। রনির ক্ষেত্রে প্রবাদটা বেশ ভালই খাটে। যেমন হুট করেই এসেছিলেন জাতীয় দলে – তেমনি হারিয়ে গেলেন দ্রুতই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেকে ৪০ রানে শিকার করলেন ২ উইকেট। এরপর সুযোগ পেলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও। সেখানে তিন ম্যাচেই রান খরুচে থাকলেন। বোলিংয়ে বিপিএলের সেই ঝলক কিংবা জাদু কোনোটাই নেই।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই বাদ পড়লেন দল থেকে। প্রায় দুই বছর তিনি দলের বাইরে। বয়স তখন মাত্র ২২। ফেরার সুযোগ আর সম্ভাবনা সবটাই ছিল। কিন্তু পারফরম্যান্স ফেরার আভাসটা দিচ্ছিল না। সুযোগ কারও কারও জীবনে একাধিকবার আসে; কারও এক সুযোগেই সব শেষ! কেউ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকে নিয়ে যায় সফলতার শীর্ষে; কেউ আবার ব্যর্থতার বোঝা মাথায় চাপিয়ে হারিয়ে যায় দ্রুতই। ভাগ্য – এই ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রনির ক্যারিয়ারেও দ্বিতীয়বার সুযোগ আসলো। প্রায় দুই বসন্ত পেরিয়ে ভারতের বিপক্ষে সুযোগ পেলেন। এরপর আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও বেশ ক’য়েক ম্যাচে খেললেন। কিন্তু তবুও রনির সেই জাদুর দেখা নেই। মাঝে দুই ওয়ানডেও খেলেছেন। তবে চিত্রটা সেই একই। রান খরচা করছেন, উইকেটেরও দেখা নেই; পুনরায় হারিয়ে যাওয়ার আভাস! সেই আশংকা বাস্তবে রূপ নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষেই।
এবার বাদ পড়লেন লম্বা সময়ের জন্য। সেই সময় কতটা দীর্ঘ সেটা এখনও অনিশ্চিত। চার বছর তিনি দলের বাইরে। বাদ পড়ার পরের আসরগুলোতে ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেকটাই সাদামাটা ছিলেন। বলতে পারেন নামের সাথে ‘রান মেশিন’ শব্দটা যেন নিজ হাতে জুড়ে দিয়েছেন।
হতাশা, আক্ষেপ – সবটাই তো ছিল; এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে ফেরার অদম্য ইচ্ছেটাও আছে। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ, বিপিএল সহ ঘরোয়া লিগে আবার মাথাচাড়া দিলেন রনি। বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও বেশ উন্নতির দেখা মিলল। ব্যাটিংয়ে লোয়ার অর্ডারে ক্লিন হিটে বড় শট হাঁকাচ্ছেন! খেলছেন ক্যামিও! যেন এক ভিন্ন রনির দেখা পাওয়া গেল।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন পেসার সংকট নেই বললে চলে। তরুণ সম্ভাবনাময় পেসাররাও অভিষেকের অপেক্ষায়। রনির বয়স এখন ২৬। জাতীয় দলে ফেরার সুযোগ আর সম্ভাবনা দুটোই এখনও আছে। তবে এর জন্য ধারাবাহিক পারফরমটা করতে হবে।
নেত্রকোনার গর্ব হতে পারেননি, এখন পর্যন্ত আক্ষেপই বলা চলে। আরও এক সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তিনি। এই অপেক্ষা কবে শেষ হবে তিনি নিজেও জানেন না।