আফ্রিদি একজন সাহসী যোদ্ধা

পৃথিবীতে অসাধারণ সব আবিস্কারের পেছনের গল্পটা হচ্ছে ‘দরকার বা প্রয়োজন’। এই আবিষ্কারের গল্পটাও ওরকম একটা প্রয়োজন থেকে।

১৯৯৬ সাল। একটা ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে আমরা তখন কেনিয়ায়। ওয়ার্ল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন লেগস্পিনার মুশতাক আহমেদ ইনজুরিতে আবার আমাদের তখন একজন লেগ স্পিনারের খুব দরকার। দলে প্রয়োজন। ঠিক এই সময় ছেলেটার আবির্ভাব। এর নাম আমরা আগে কখনো শুনিনি।

নির্বাচকেরা বেশ আশা নিয়ে ছেলেটাকে আমাদের দলের সাথে দিয়ে দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ছেলেটা ঠিক আছে, আর কিছুই তারা বলেননি। আমরাও ভাবলাম, ঠিক আছে…চলুক, খেললেই দেখা যাবে। কাজ হলেও হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঐ সময় ছেলেটা আমাদের জন্যে ছিলো একেবারেই অজানা একটা মানুষ, কি করতে পারে কিছুই জানিনা। এবং অসাধারণ কিছু ছেলেটার হাবেভাবেও বোঝা যায়নি। খুব সাধারণ।

নায়রোবিতে পৌঁছে নেটে বল করতে এলো ছেলেটা। আমার মনে আছে, নেটে ছেলেটা বেশ দ্রুত গতিতে বল স্পিন করাচ্ছিলো। বোলিং এ ভ্যারিয়েশন আছে। কিশোর একটা ছেলে,ছাড় দেবোনা ধরনের একটা ঔদ্ধত্য। নিখুঁত গুগলি এবং সেই গুগলিতে আবার গতিও বেশ, গুগলির গতিটা সে খুব স্বচ্ছন্দে বদলাতে পারছে। ওর বোলিং এ মুশতাকের ছাপ কম, কুম্বলের ছাপ ছিলো বেশি। বোলিং দেখে মনে মনে বলেছিলাম,আরেকটু লম্বা হলে ভালো হতো।

নেটে ওর ব্যাটিং এর সময় এলো। সন্ধ্যা হয় হয়, আলো কমে এসেছে। তখন খালি ওরই ব্যাট করা বাকি। ওদিকে আমাদের আবার হোটেলে যাবার তাড়া আছে। নেটে ব্যাটিং করতেই হবে সেরকম জরুরী কিছু ছিলোনা- তখনকার সময়টায় বোলারদের নেটে খুব একটা ব্যাটিং দেয়া হতোনা। ভাবলাম আছেই আর অল্প একটু সময়, করুক ব্যাটিং। নললাম প্যাড পরে নাও, ব্যাটিং এ যাও।

এরপর যা হলো, তাতে আমাদের হোটেলে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। প্রথমে আমি লেগব্রেক শুরু করলাম। আমার লেগব্রেক মোটামুটি পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ছেড়ে দিলো ছেলেটা। এরপর ওয়াকার অফব্রেক শুরু করলো এবং একই ঘটনা,ওয়াকারের বল ও সব শক্ত পিটুনি খেলো। এরপর আমি আর ওয়াকার দুজনেই শর্ট রান-আপ নিয়ে বল করলাম। একই ঘটনা।

আমি তখনও সন্দেহে ভুগছি। বিগিনারস লাক নাকি? এরপর আমরা দুজনেই লম্বা রান-আপ নিয়ে একদম সত্যিকারের পেইস অ্যাটাক শুরু করলাম। তাতেও দেখলাম ছেলেটার কোন হেলদোল নেই। সমানে পিটিয়েই যাচ্ছে। চারদিকে। কোন নির্দিষ্ট দিকে না। আমরা যতো আক্রমনাত্মক বোলিং করছি, ছেলেটা ঠিক ততোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের ঠ্যাঙাচ্ছে। একটা বারের জন্যেও ভেতরে কোন ভয়ডর দেখলাম না। আধো আলো ছায়াতেই আমাদের দুজনকে ছক্কা-চার মেরে যাচ্ছে যেন বিড়ালের মতো বল কম আলোতেও দেখতে সমস্যা হচ্ছেনা। তাড়াতাড়ি সব বন্ধ করলাম। মানসন্মান নিয়ে টানাটানি অবস্থা।

পরের দিন ওকে আগে ব্যাটিং এ পাঠিয়ে দিলাম। এইবার একদম প্রথম থেকেই আমি আর ওয়াকার একদম পুরো রান-আপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম। কোন অদলবদল নেই। দিনের আলোয় দেখি সন্ধ্যার আলোর চেয়ে বেশি পেটাচ্ছে। পেটানোর পরেও কোন হেলদোল নেই, যেন এমনটাই হবার কথা। ভাবছিলাম, নেটে বোলিং হচ্ছে বলে বল নেটেই থাকছে, খোলা মাঠে হলে এর সবকয়টা হয় বাউন্ডারির বাইরে নয়তো গ্যালারির বাইরে গিয়ে পরতো।

ঠিক ঐ দিন নেটে আমি মোটামুটি পরিস্কার ধারণা পেয়ে গেলাম – ছেলেটার ভেতর প্রতিভা আছে। বহুদূর যাবার সামর্থ্য আছে।

এরপর খবর এলো আমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। লাহোরে ফেরত যাবার জন্যে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে সাঈদ আনোয়ার কে বললাম ছেলেটাকে যেনো আগে ব্যাটিং এ পাঠায়। স্রেফ একটা সাজেশন। আমার অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান দলের ক্যাপ্টেন তখন সাঈদ আনোয়ার।

আমি স্রেফ একটা সাজেশন দিয়েছিলাম। এরপর যা করেছে তা সাঈদ। আমি জানি যে সাঈদ জানে ও কি করছে। সেই একটা ছোট্ট সাজেশন যে ইতিহাস করে ফেলবে তা বুঝিনি। লাহোরে পৌঁছে খবর শুনলাম, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষের সেই ইনিংস লাইভ দেখতে পারিনি। পরেরদিন আসলে খবরের কাগজে পড়েছিলাম ইনিংসটার কথা। সন্ধ্যায় দেখলাম সেই বিস্ফোরক ইনিংস।

নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসেই ওয়ানডে ক্রিকেটের আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ৩৭ বলে সেঞ্চুরি। সালটা ১৯৯৬, যখন ৫০ ওভারের ম্যাচে ২৩০ রান মোটামুটি একটা সন্মানজনক স্কোর ধরা হতো।

রাতে আবার দেখলাম সেই ইনিংস। বুঝে গেলাম, এই ছেলেটা, শহীদ আফ্রিদি থাকার জন্যেই এসেছে।

সত্যিটা বলি। আমি আফ্রিদী কে আবিস্কার করিনি। যেভাবেই হোক ছেলেটা জাতীয় দল পর্যন্ত এসেছে। আমাদের লাহোরীদের ভাষাতে একটা শব্দ আছে, ফাড়াক, ইংরেজীতে স্পার্ক বলা যায়।ছেলেটার ভেতর তা আছে। এজন্যেই নিয়ে নিলাম ছেলেটাকে। এই স্ফুলিঙ্গটাকে কাজে লাগানো গেলে পাকিস্তান ক্রিকেটেরই লাভ।

শুরুতে আফ্রিদি ছিলো লাজুক একটা ছেলে, আজকের যে লড়াকু, টাফ গাই দেখছেন, সেরকম না। আর দশটা কিশোরের মতো সবকিছুতেই একটু বেখাপ্পা। এর কারন বোঝাটা খুব একটা কঠিন কিছু না। ভাবুন একবার, ও যখন দলে এসেছে তখন পাকিস্তান দলের লাইন-  আপ টা কি – ওয়াকার ইউনুস, সেলিম মালিক, রমিজ রাজা, ইজাজ আহমেদ, সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হক – সম্ভবত আমাদের সবারই পোষ্টার ওর ঘরে তখনও লাগানো। এরপর হঠাৎ করেই ও আমাদের একদম মাঝখানে। যে কারো জন্যে খুব কঠিন একটা পরিবর্তন বলা যায়।

খুব দ্রুত বুঝে গেলাম শহীদ আফ্রিদির কনফিডেন্স বুষ্ট করা দরকার। প্রজেক্ট হিসেবে নিলাম ছেলেটাকে। এরপর ওকে সাথে করে সবার সাথে দেখা করতে নিয়ে যেতাম। সব ইভেন্ট আর ডিনারগুলোতে বগলদাবা করে নিয়ে যেতাম-আসলে পোলিশিং করাটা শুরু করেছিলাম। আমি সবসময় তেই বিশ্বাস করি, একজন মানুষ যদি নিজে আত্মবিশ্বাসী হয়, সেটা তার কাজের উপরেও পজিটিভ প্রভাব ফেলে। শহীদ আফ্রিদি, সেই কিশোর ছেলেটার ও এই সত্যটা জানা এবং সে যে দলে অনাহুত কেউ না, তা বোঝার দরকার ছিলো।

আমি ওর ক্যাপ্টেন ছিলাম বছর দশেক এর মতো, এর মাঝে আমার ক্যাপ্টেনসি এসেছে গিয়েছে। এর মাঝে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো হয়েছে, একজন আরেকজন কে খুব পছন্দ করতাম। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যে কাজটার জন্যে আমরা ওকে দলে নিয়েছিলাম, কুইক লেগস্পিনার, সেই কাজটায় আমরা ওকে কি ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পেরেছিলাম? আমি জানি ওর নিজেরও একটা আক্ষেপ আছে ,ওর দক্ষতাটা ঠিকঠাক কাজে লাগানো হয়নি।
এটাই বাস্তবতা।

পাকিস্তান ক্রিকেটে একটা খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত মনস্তত্ব নিয়ে আলাদাভাবে কোন কাজ করা হয়না। দলের আরেকজন খেলোয়াড় কি ভাবছে তা আমরা ভাবিনা। আমরা প্রো-অ্যাকটিভ না। ইমরান খান ছিলেন প্রো-অ্যাকটিভ। উনি তো ইমরান খান। ওনার মতো কেউ আর কখনো পাকিস্তান ক্রিকেটে আসেননি, এখনো নেই, কখনো হয়তো তাঁর মতো কেউ আসবেন ও না।

দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান ক্রিকেটে আফ্রিদি যখন ঢুকেছে, নিজের আসন নিয়ে গেড়ে বসছিলো তখন দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের এক সংকট তৈরী হচ্ছিলো, সেই সংকট আমাকে মাঝে মাঝে দেয়া এবং কেড়ে নেয়া ক্যাপ্টেনসির মাঝেও দেখা যাচ্ছিলো। আফ্রিদী যখন গড়ে উঠছিলো তখন আরো কার্যকর আর তীক্ষ্ণ খেলোয়াড় হবার জন্যে তার চারপাশে প্রয়োজন ছিলো আত্মবিশ্বাসী একটা পরিবেশ, আত্মবিশ্বাসী মানুষজন। সেরকম কিছু সে পায়নি, মানুষও সেরকম কেউ ছিলোনা। এটা ওর দুর্ভাগ্য। এছাড়াও ছেলেটার বয়স তখন খুবই কম, সবে কৈশোর পেরিয়েছে, চারদিক থেকে খুব অ্যাটেনশন ও পাচ্ছিলো। আশপাশে খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো সবকিছু। খুবই দ্রুত। এর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াটা কঠিন, খুবই কঠিন।

আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ ওর পাশে, ওর জন্যে দাঁড়িয়েছিলো। আমার মনে আছে, ১৯৯৯ সালে ভারত সফরের আগে নির্বাচকদের সাথে আফ্রিদিকে নিয়ে আমি নিজে তর্কে জড়িয়েছিলাম। আমি ওকে দলে চাইছিলাম আর ওদিকে নির্বাচকেরা ভেটো দিয়ে বসে আছেন। তখন খুব কঠিন একটা কাজ আমাকে করতে হয়েছিলো-আমি জানি ছেলেটা ম্যাচ উইনার-নির্বাচকদের বলেছিলাম আফ্রিদিকে টেস্ট দলে না দিলে আমি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবো।

শেষে নির্বাচকেরা অনেকটা নিমরাজি হয়েই আফ্রিদিকে দলে দিয়েছিলেন। প্রথম টেস্টেই আফ্রিদি নিজেকে প্রমাণ করেছিলো, স্কোর ১৪৪ তাও দানবীয় এক ব্যাটিং-এ। ভারতের বোলিং ঐ এক ইনিংসেই দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো। আফ্রিদি আবার এক সেনসেশন।

আফ্রিদি নিজে নিজের মেধা সম্পর্কে যদি জানতো করতে পারতো আরো অনেক কিছুই। প্রতিনিয়ত আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিটাই ওকে থিতু হয়ে বসতে দেয়নি। কেউ একজন যদি ওকে ডেকে বলতো, ‘পাঠান, অনেক কিছুই করেছো তুমি। এবার টেকনিকটা ঠিক করে যেখানে তোমার পৌঁছা উচিৎ সেখানে পৌঁছাও’। এই একজনের খুব দরকার ছিলো আফ্রিদির, এই একজনটাই ওর জীবনে কেউ হয়ে ওঠেনি।

গ্রেট হতে আত্মবিশ্বাস টা খুবই জরুরী। আফ্রিদির যা সামর্থ্য তাতে যেকোন সময়ের সেরা বিশ্ব একাদশে ওর নাম ঢোকার কথা। আমি ক্রিকেটের বিভিন্ন যুগের সাথে তুলনা করাটা পছন্দ করিনা, করিওনা, তারপরেও ১৯৯০ এর সময়টা আফ্রিদীর মতো খেলোয়াড়ের জন্যে খুব কঠিন সময় ছিলো। ও যেভাবে ওপেন করতো, সে সময় ওভাবে ওপেন করাটা ছিলো কঠিন, যেভাবে মারতো সেভাবে মারাটা ছিলো কঠিন। ঐ সময় প্রতিটা বিপক্ষ দলে অন্তত তিনজন পেসার থাকতেন যারা সর্বোচ্চ ১৫০কিমি/ঘন্টা বেগে বল করতে পারতেন। আফ্রিদি খেলাটায় যে স্ট্রাইক রেটের সূচনা করেছে, খুব একটা সহজ কাজ না। পার্কে গেলাম আর হাঁটতে হাঁটতে হয়ে গেলো।

কিন্তু ওর রিফ্লেক্স, হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিনেশন, স্বভাবসুলভ আগ্রাসন- সব কিছু ছিলো অবিশ্বাস্য। দল হিসেবে আমাদের জন্যেও একটা বিষয় খুব হতাশার- পিচে ওর ফুটওয়ার্ক। বল এলো-মেরে দিলাম, বল হয় স্টেডিয়ামে না হয় মিড অন এর ফিল্ডারের হাতে। টেস্ট যুগটায় আফ্রিদিকে খুব সংগ্রাম করতে হয়েছে কিন্তু যেই টি টোয়েন্টির যুগ শুরু হলো, আফ্রিদিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এই ফর্ম্যাটটা যেন একেবারে ঠিক ওর জন্যেই বানানো হয়েছে।

আফ্রিদি সীমিত সামর্থ্যের খেলোয়াড় না, ও নিজে নিজেকে সীমিত সামর্থ্যের বানিয়েছে। আন্তর্যাতিক পর্যায়ে কেউ যদি বিশ্বাস করে যে এই পর্যায়ে খেলতে যা দরকার তা তার নেই, তাহলে আসলে এই পর্যায়ে কোন খেলোয়াড় তার আসল খেলাটা খেলতেই পারবেনা। নিজের উপর বিশ্বাস থাকতে হবে। নিজে নিজের জন্যে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে – আমি শর্ট বল ছেড়ে দেবো, অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল ধরে খেলবো- এরকম আরকি। একদম বেসিক নিয়মগুলো মানতেই হবে। সময়ে ঠিকই প্রমান হয়েছে আফ্রিদি আসলে মানুষ, সবসময় মারবেই এমন কোন অতিমানব না।

ওর খেলা ছাড়া আবার ফিরে আসাটাও আমার পছন্দ হয়নি। এই যেমন ধরুন, ২০১০ এ পাকিস্তান দলকে একটা মাত্র টেষ্টে নেতৃত্ব দিয়ে ক্যাপ্টেনসি ছেড়ে দিলো। এর একটাই অর্থ, ও আসলে বিষয়টা নিয়ে অতদূর ভাবেইনি। আজকালকার দিনে যদি কেউ সত্যি সত্যি ক্রিকেটে কোন দাগ কেটে যেতে চায়, তাকে ভাবতে এবং খেলতে হবে লম্বা সময়ের জন্য।

যাই হোক, আফ্রিদি যা অর্জন করেছে, পাকিস্তান জাতীয় দল থেকে অবসরের পরেও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ও খেললে স্টেডিয়াম দর্শকে উপচে পরে। কমপ্লিট ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার। যেকোন যুগের জন্যেই হোক, ও একজন ক্রিকেটার, স্টার ক্রিকেটার। শুরুর দিকে ওর ক্যারিশমা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ১৯৯৯ সালে টের পেয়েছি। ওকে ঘিরে একটা আলাদা আবহ তৈরী হয়েছে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটা ম্যাচের কথা আমার মনে আছে। খেলা হচ্ছিলো পেশোয়ার এ। গ্যালারি একেবারে কানায় কানায় ভরা। গ্যালারীর ভেতরে যত মানুষ তার চেয়ে বেশি মানুষ গ্যালারির বাইরে। লোকজন ওর নাম নিয়ে চিৎকার করছিলো, অনেকটা নাম জপার মতো করে। ব্যাটিং এ নামলো আফ্রিদি। প্রথম বলেই ক্যাচ তুলে আউট। গ্যালারীর জনগন মোটামুটি উন্মাদ হয়ে গেলো।

দেখা গেলো লোকজন গেট ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে-তাদের দাবি আফ্রিদিকে আরেকবার সুযোগ দিতে হবে কারণ প্রথম বলটা ছিলো ‘ট্রাই বল’, সত্যি সত্যি বল না। গলি ক্রিকেটের মতো। শেষমেষ পুলিশ এসে জলকামান এর জল আর টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ে লোকজন কে দমিয়েছিলো। দলের মাঝে ঢুকে মাত্র অল্প কয়েকদিনেই ও যে স্টারডমটা তৈরি করে ফেলেছিলো, অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা।

আফ্রিদীর ব্যাপারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ও কিছু করুক আর না করুক, সেটাতেই লোকজন খুশি। একটা আলাদা ইমেজ ওর আছে। ফিট অ্যাথলেট, দেখতে সুন্দর। শহীদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশনের জন্যেও ও যা করেছে তাতে আমি গর্বিত।

কিন্তু শুধু স্টার হলেই তো হয়না। আশপাশে কি হচ্ছে, নিজের চারপাশে কি হচ্ছে সেদিকেও তো খেয়াল রাখতে হয়। এই ব্যাপারটা আমি শেখার চেষ্টা করেছি, এখনো করছি। দিন চলে যাবে, সত্যি কিন্তু নিজেকেও নিজের কাজটা, নিজের জীবন সম্পর্কে জানতে হবে।

নেতৃত্ব দেয়াটা কি ওর জন্যে সহজ ছিলো? হ্যাঁ।

দলের যখন দরকার তখন কি ও পারফর্ম করেছে? হ্যাঁ।

প্রেশার নিতে কি সবসময় তৈরী থাকতো? হ্যাঁ।

কঠিন ফিল্ডিং পজিশনে যেতে কি কোন অনীহা ছিলো ওর? কখনোই না। বরং ছিলো একপায়ে খাড়া।

আফ্রিদি একজন সাহসী যোদ্ধা। আমার দেখা শক্ত মানুষদের একজন। কতৃপক্ষের সাথে নাকি ওর ঝামেলা হতো খুব। মানলাম, এমন কতৃপক্ষের সাথেই ওর ঝামেলা হতো যারা কোনরকম সন্মান পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। ওকে চালাতে হলে আগে ওর মাইন্ডসেট, ওর ব্যক্তিগত দর্শন টা বুঝতে হবে। আফ্রিদী ঘাড়ত্যাড়া ছেলে বা খেলোয়াড় বা মানুষ না। আপনাকে আগে জানতে হবে আপনি আসলে কাকে চালাতে চাইছেন। যদি আফ্রিদী আপনাকে সন্মান করে, আপনার জন্যে গুলির মুখে বুক পেতে দিতেও ও দ্বিধা করবেনা।

দলে ওকে খেলোয়াড় হিসেবে পাওয়া নিঃসন্দেহে আমার জন্যে সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার, ওকে লিড করাটাও বেশ উপভোগ করতাম। বিষয়টা আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। সাকলায়েন মুশতাক, আব্দুল রাজ্জাক, আজহার মেহমুদ, শোয়েব আখতার, শহীদ আফ্রিদি-সবাই যখন একাদশে থাকে, বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে, পাকিস্তান দল তখন অপরাজেয়।

অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি চাপে আমাকে রেখেছে এই আফ্রিদিই। ওর খেলার সময় সামান্য সময়ের জন্যে টয়লেটেও যাওয়া যেতোনা। কারন ও যে কোন খেলা যেকোন সময় বদলে দিতে পারে। গেইম চেইঞ্জার হিসেবেই ও ছিলো, থাকবেও।

– ওয়াসিম আকরাম

মুখবন্ধ, গেম চেঞ্জার (শহীদ আফ্রিদির আত্মজীবনী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link