সাউদাম্পটন ক্লাবের বাইরে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালান। আজকেই ছেলের ট্রায়ালের ফলাফল দেবার কথা, কিন্তু সেটা দেখতে ভেতরে যেতে সাহস পাচ্ছে না সে। নিজের শহরের দল নিউক্যাসল এর মাঝেই রিজেক্ট করে দিয়েছে। ওয়েস্টব্রম, ম্যানচেস্টার সিটিও জানিয়ে দিয়েছে নিজেদের অপারগতা।
অথচ তাঁর ছেলেটা ফুটবলটা মন্দ খেলে না, বলা চলে একা হাতেই চ্যাম্পিয়ন করেছে স্কুল টিমটাকে। তবে অন্য ক্লাবের মত খাঁটি হীরে চিনতে ভুল করেনি সাউদাম্পটন, ট্রায়ালের পর দলে ডেকে নিয়েছিল অ্যালানের ছেলেকে যার পুরো নাম অ্যালান শিয়েরার।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানো নয়। চেলসির বিপক্ষে প্রিমিয়ার লিগে বদলি হিসেবে যখন মাঠে নামেন, তখন তার বয়স কেবল ১৭। সে ম্যাচে মনে রাখবার মত কিছু না করতে পারলেও শিয়েরার পত্রিকার শিরোনাম হন মাস খানেক পরেই। প্রিমিয়ার লিগে প্রথমবারের মত শুরুর একাদশে মাঠে নেমেই সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে আর্সেনালের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন শিয়েরার। মূলত এই ম্যাচ দিয়েই প্রথম বারের মত ইংরেজ গণমাধ্যমের শিরোনামে আসেন তিনি।
সাউদাম্পটনে এরপরের সময়টা অম্লমধুর কেটেছে শিয়েরারের, কখনো গোল পেয়েছেন আবার কখনো পাননি। তবে শিয়েরারের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি প্রথাগত স্ট্রাইকারের মত বক্সে বলের অপেক্ষা না করে নিচে নেমে গোলের সুযোগ তৈরি করতেন। চার বছরে সেইন্টদের হয়ে করেন ৪৩ গোল। একদম ক্লাসিক নাম্বার নাইন হওয়ার শুরুটা সেখানেই।
১৯৯২-৯৩ মৌসুম। ইউরোপিয়ান কাপ বদলে গিয়ে নতুন জৌলুসে, নতুন করে শুরু হল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নাম নিয়ে। অর্থের ঝনঝনানিতে সাউদাম্পটনও তাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁস চিনতে ভুল করল না। ট্রান্সফার ফি’র নতুন রেকর্ড গড়ে ৩.৬ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে শিয়েরারকে দলে ভেড়ায় ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স।
নতুন ক্লাবে মৌসুমের মাঝ পথেই করেন ১৬ গোল। এত দুর্দান্ত শুরুর পরও নতুন ক্লাবে প্রথম মৌসুমটা ভালো যায়নি তার, ইনজুরির কারণে ছয় মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান শিয়েরার। ইনজুরি থেকে ফিরেই অবশ্য স্বমহিমায় উজ্জ্বল শিয়েরার, ৪০ ম্যাচে ৩১ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের সেরা ফুটবলার হওয়ার পাশাপাশি ব্ল্যাকবার্নকে করেন রানার্স আপ। পরের মৌসুমে অবশ্য দ্বিতীয় হওয়ার যন্ত্রণায় পুড়তে হয়নি শিয়েরারকে।
ক্রিস সাটনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন বিধ্বংসী এক জুটি, প্রতিপক্ষের ডিফেন্স নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করে ৮০ বছর পরে ব্ল্যাকবার্নকে এনে দেন শিরোপার স্বাদ। ৩৪ গোল করে টানা দ্বিতীয় বারের মত প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
১৯৯৫-৯৬ মৌসুমটা ছিল শিয়েরারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিয়েরার তখন তর্ক সাপেক্ষে বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকার। বিশ্বের বড় বড় সব ক্লাব তখন শিয়েরারকে দলে পেলে বর্তে যায়। ডাক আসে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকেও।
কিন্তু, গসফোর্থের অলিগলিতে ফুটবল খেলে বেড়ে ওঠা শিয়েরার অনুভব করছিলেন নাড়ির টান, অর্থ-খ্যাতির মোহ উপেক্ষা করে তাই যোগ দেন নিজের শহরের ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডে। এরপরের সময়টাতে নিউক্যাসল আর শিয়েরার নামদুটো যেন একে-অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল।
টানা দশবছরে উল্টেপাল্টে দেন প্রিমিয়ার লিগের রেকর্ডের নোটবুক, চারবার জেতেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার। সময় যত গড়িয়েছে, শিয়েরার তত শাণিত হয়েছেন। নিউক্যাসলের হয়ে বড় কোনো শিরোপা না জিতলেও দলকে এফএ কাপের ফাইনালে নিয়ে গিয়েছেন টানা দুবার।
ক্লাবের মত জাতীয় দলেও সমানতালে গোল করেছেন শিয়েরার। গ্যারি লিনেকারের অবসরের পর ইংল্যান্ড যখন হন্যে হয়ে আছে একজন স্ট্রাইকারের খোঁজে, ঠিক তখনই আগমণ শিয়েরারের। যদিও দলগত ব্যর্থতায় শিরোপা জেতা হয়নি, কিন্তু শিয়েরার নিজের কাজটা করে গিয়েছেন নীরবেই।
১৯৯৬ ইউরোতে জেতেন সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব। সেবার সেমিফাইনালেও শুরুতে গোল করে এগিয়ে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে, কিন্তু টাইব্রেকারে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জার্মানির কাছে হেরে যায় তার দল। টাইব্রেকার যেন শিয়েরারের জীবনে এক বিভীষিকার নাম, ১৯৯৮ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডেও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল করে দলকে এগিয়ে দেবার পর টাইব্রেকারে হেরে যায় ইংল্যান্ড। ৬৩ ম্যাচে ৩০ গোল করে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের পঞ্চম সর্বোচ্চ গোলদাতা অ্যালান শিয়েরার।
শিয়েরারের জীবনের আজন্ম আক্ষেপ নিউক্যাসলের হয়ে লিগ জিততে না পারা। গোলের পর গোল করে গিয়েছেন, কিন্তু ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে শিরোপা জেতার সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দাপটে লিগ শেষ করতে হয় দ্বিতীয় স্থানে থেকে। ২৬০ গোল করে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি, এর মাঝে ২০৬ গোলই করেছেন নিউক্যাসলের জার্সিতে।
অবশেষে ২০০৬ সালের ১১ মে সব ধরনের ফুটবলকে অবসর জানান শিয়েরার। তার সম্মানে ক্লাব ফেয়ারওয়েল ম্যাচ আয়োজন করলেও ইনজুরির কারণে সে ম্যাচে খেলতে পারেননি তিনি। ফলে প্রিমিয়ার লিগে সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাই হয়ে আছে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।
শিয়েরারের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ক্লাবের বাইরে নয় ফুটের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেছে নিউক্যাসল ক্লাব। তর্জনী উঁচু করে তাঁর সেই বিখ্যাত উদযাপন আজও নস্টালজিক করে তোলে গসফোর্থবাসীদের।
খেলা ছাড়লেও এখনো ফুটবলের সঙ্গেই আছেন শিয়েরার। কখনো কোচ, কখনো ম্যানেজার আবার কখনো ধারাভাষ্যকার হিসেবে বারবার ফিরে এসেছেন সবুজ গালিচায়। ফুটবল মাঠে সাফল্য-ব্যর্থতা ছাপিয়ে অ্যালান শিয়েরার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ফুটবলের প্রতি তার হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসার জন্য। সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় যদি তিনি না থাকেন তাহলে সেই তালিকাই অসম্পূর্ণ।