এখন আফ্রিকা সেরা দল সেনেগাল। নেপথ্যের নায়ক হিসেবে বারবারই উঠে আসছে আলিউ সিসের নাম। অনেকটা একবার না পারিলে দেখ শতবারের মতো। একাধিকবার চেষ্টা করেই আফ্রিকান নেশন্স কাপের শিরোপা জিতেছে সাদিও মানের দল।
একই ক্লাবে খেলার কারণে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া মোহাম্মদ সালাহ আরেকবারের মতো হতাশ হয়েছেন। কোচ হিসেবে সিসের আক্ষেপ ঘুচেছে এবার। এর আগে ২০০২ সালে প্রথমবার আফ্রিকান নেশন্স কাপের ফাইনালে ওঠেছিল সেনেগাল। ক্যামেরুনের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি গড়ায় শুটআউটে। সেবার মিশরের মাটিতে অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচে পেনাল্টি মিস করে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পোড়েন সেনেগালের অধিনায়ক আলিউ সিসে।
সেই খেলোয়াড়ই এবার ভিন্ন ভুমিকায়। ২০ বছর পর দলের কোচ হিসেবে আরেকটি পেনাল্টি শুটআউটে এসে আক্ষেপ ঘুচলো তার। কাকতালীয়ভাবে সেটা ওই মিশরের বিপক্ষেই! সিসের কাছে অনেকটা আক্ষেপ ঘোচানোর মতো শাপমোচনও। খেলোয়াড়ি জীরনে সেনেগালের হয়ে ১৯৯৯-২০০৫ পর্যন্ত ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার সিসে। এরপর ২০১৫ সালে জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নেন তিনি। নেশন্স কাপের গত আসরে শিরোপার খুব কাছে গিয়েও ব্যর্থ হয় সিসের দল সেনেগাল।
ফাইনালে হেরে আলজেরিয়ার কাছে হেরে আরও একবার কষ্ট নিয়ে ফিরতে হয়। অনেক অপেক্ষার পর এবার মিশরকে হারিয়ে পাওয়া ট্রফিটা সেনেগালের মানুষকে উৎসর্গ করেছেন সিসে। শিরোপা জেতার পর চ্যাম্পিয়ণ কোচ বলেন, ‘শিরোপা জেতার পর বলতেই পারি, আমি এখন আফ্রিকান চ্যাম্পিয়ন। অনেক দীর্ঘ সময়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই অবস্থানে আসতে হয়েছে। কিন্তু আমি সহ আমরা কখনো হাল ছাড়িনি। আমি এই জয় তাই উৎসর্গ করছি সেনেগালের জনগণকে। অনেক বছর ধরেই দেশটির মানুষরা এই কাপের স্বপ্ন দেখে আসছি। এই শিরোপা জয়ে আমরা দেশের জার্সিতে একটি তারকার ছাপ রাখতে পারলাম।’
রেকর্ড সাতবারের আফ্রিকা চ্যাম্পিয়ন মিশরকে হারিয়ে পাওয়া জয়কে তাই স্পেশাল বলছেন সিসে। শিরোপা লাসি সেভেন পার হওয়া মিশরের বিপক্ষে জিতে সিসে বলেন, ‘মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্ট আফ্রিকান নেশন্স কাপ জেতার একটা বিশেষ অর্থ রয়েছে। আর আফ্রিকার সবচেয়ে সফল দলের বিপক্ষে পাওয়া জয়টা আরেকটি মাহাত্ম্য বহন করে নিশ্চিতভাবেই।’
সিসে এই অর্জনের ভাগিদার করলেন কোচিং প্যানেলে তার সহকর্মীদেরও। প্রায় সাত বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করছেন তারা। অসাধারণ অর্জন হওয়ায় বন্ধুদের ধন্যবাদ দিয়েছেন প্রধান কোচ। সেমিফাইনালে লালকার্ড দেখায় ফাইনাল ম্যাচে ডাগআউটে ছিলেন না মিশরের কোচ কার্লোস কুইরোজ।
তিনি ম্যাচ দেখেন গ্যালারিতে বসে। তার সহকারী দিয়া আল সায়েদ শিরোপা জিততে না পারায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ’মোহাম্মদ সালাহ বিশ্বমানের একজন খেলোয়াড়। সে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। কিন্তু এবার সালাহ দেশের হয়ে কাপ জিততে অনেক পরিশ্রম করেছে। এছাড়া আমরা চাই, তাকে নিয়ে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে। লক্ষ্যপূরণ না হওয়ায় খুবই হতাশ হয়েছে সে।’
ভারত উপমহাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘অধ্যবসায়’ প্রবন্ধটি পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিনই হবে। সাধারণ ভাষায়, কোন কাজে সাফল্য পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাওয়ার নামই হচ্ছে অধ্যবসায়। তাবৎ দুনিয়ার সফল মানুষের সফলতার পেছনে রয়েছে এটি।
অধ্যবসায়ের উদাহরণ বলতে বছরের পর বছর রবার্ট ব্রুস, স্যার আইজাক নিউটন, মহাকবি ফেরদৌসী, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসিদের নাম বেশি করে শোনা যেত। এবার সেই তালিকায় আরও একজনের নাম অনায়াসেই যুক্ত করলে কারও কোন আপত্তি থাকবেনা। তিনি আর কেউ নন, আফ্রিকান নেশন্স কাপের শিরোপাজয়ী দেশ সেনেগালের সাদিও মানেদের গুরু, আফ্রিকার ‘নতুন রাজা’ হওয়ার নেপথ্যের কারিগর আলিউ সিসে।
তিনবারের প্রচেষ্টায় আফ্রিকার সেরা হতে পেরেছেন তিনি। আফ্রিকা মহাদেশের সেরা হওয়া লড়াইয়ে তিনবার ফাইনাল খেললে শিরোপা ছুয়ে দেখতে পারেনি সেনেগাল। খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে তিনবারই শিরোপার খুব কাছে গিয়েছেন সিসে। অ্যাফকনে সেনেগালের সবকটি ফাইনাল ম্যাচেই যুক্ত আছে তার নাম। ২০০২ সালে মালিতে হওয়া আফ্রিকা কাপ অব নেশন্সে ফেভারিট হিসেবে সবার উপরের নামটি ছিল সেনেগাল।
সিসের দারুণ নেতৃত্বে তেরেঙ্গার সিংহরা প্রথমবারের মতো শিরোপার খুব কাছে গিয়েও পারেনি। যদিও ২০০২ সালেই প্রথমবারের মতো সেনেগালকে বিশ্বকাপ খেলার স্বাদ এনে দিয়ে সেই হারে ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিয়েছেন তিনি। তারপর আরও একটি দশক কেটে গেলেও বাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। কিছুতেই আর মহাদেশীয় লড়াইয়ে সর্বোচ্চ সাফল্যে পাচ্ছিলো না সেনেগাল।
উপায় না পেয়ে ২০১৫ সালে সাবেক অধিনায়ক আলিউ সিসের উপর সেনেগালের কোচের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। এর আগে সেনেগালের যুবদলের হয়ে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। একসময়ে আফ্রিকা ফুটবলে সাড়া জাগানো এই ফুটবলার কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করার আগে অ্যাফকন-এ সেনেগালের হয়ে সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল ২০০৬ এ সেমিফাইনাল খেলা।
সেনেগালের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পরই দলটির মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন আলিউ সিসে। পুরাতনদের ঝেটিয়ে বিদায় করে নতুনদের একের পর এক সুযোগ দেন তিনি। লক্ষ্যে একটাই অধিনায়ক হিসেবে দেশকে যা এনে দিতে পারেননি এবার নতুন চরিত্রেই তা এনে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
সেনেগালের অধিনায়ক হিসেবে ফাইনাল খেলেও শূন্য হাতে বাড়ি ফিরলেও মাত্র চার বছরের ব্যবধানে সেই লক্ষ্যপূরণে অনেকদূর এগিয়ে যায় সিসে। তার অধীনেই ১৭ বছর পর আবারও আফ্রিকা কাপ অব নেশন্সের ফাইনালে উঠে সেনেগাল।
সেনেগালের প্রধান কোচের দায়িত্ব নিয়েই সাদিও মানেদের আমুল বদলে দিয়েছেন সিসে। শিষ্যদের কৃতিত্বে অপেক্ষায় ফুরোয় ৪৪ বছর বয়সী এই কোচের অধীনে এসে। উনিশ বছর আগে যে টাইব্রেকারে আফ্রিকার সেরা হওয়ার দৌঁড়ে হেরে গিয়েছিলেন, এবার প্রতিযোগিতার সবচেয়ে সফলতম দলটিকেই টাইব্রেকারে কাঁদিয়ে শিরোপা জিতলো দলটি।
দুই দুটো ফাইনালে কাঁদার পর অবশেষে হাসলেন সেনেগাল কোচ সিসে। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও চেষ্টা করে সাফল্যে পাওয়ার বড় একটা উদাহরণ হয়ে গেলেন তিনি। আলিউ সিসে যেন সেনেগালের রবার্ট ব্রুস, নেপোলিয়ন বেনোপার্ট, মেসি কিংবা রোনালদোর কাতারে চলে গেলেন!