১৯৯৯ সালের ১৭ জুন। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের অন্ধকার একটা দিন। বার্মিংহ্যামে সেদিন বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে শেষ চার বলে জয়ের জন্য মোটে এক রান দরকার ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। শেষ ওভারের তৃতীয় বলটা ডট, ক্লোজ ইন ফিল্ডার বাড়িয়ে ফেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রতাপশালী অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ।
চতুর্থ বলটায় কোনো রকম ব্যাটে ছুঁয়েই দৌঁড় শুরু করলেন ল্যান্স ক্লুজনার, সেই বিশ্বকাপের বিস্ময়। নন স্ট্রাইকিং এন্ডে ছিলেন শেষ ব্যাটসম্যান অ্যালান অ্যান্থনি ডোনাল্ড। কিন্তু, তিনি দৌঁড় না শুরু করে ইতোমধ্যে হাফ ক্রিজে চলে আসা ক্লুজনারের দিকে ঠিকমত তাকালেনও না, তাঁর দৃষ্টি বলের গন্তব্যের দিকে। ওই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কেন এমন করলেন? – কে জানে!
না পেরে যখন দৌঁড় শুরু করলেন, তখন কোনো আশা ভরসাই আর বাকি নেই। কে জানে, সেদিন সময় মত দৌঁড়টা শুরু করলে প্রোটিয়া ক্রিকেটের ইতিহাস হয়তো আজ অন্যভাবে লেখা হত। কে জানে, হয়তো সেবার বিশ্বকাপটাই জিতে ফেলতো ডোনাল্ড-ক্লুজনাররা।
আজও সেই ‘যদি-কিন্তু’ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কাঠগড়ায় তোলা হয় ডোনাল্ডকে। অথচ, সাদা বিদ্যুৎ খ্যাত ডোনাল্ড দেশটির ইতিহাসে তো বটেই নিজের সময়েরই অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার ছিলেন।
টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার ছিলেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, দলটির হয়ে সর্বপ্রথম সাদা পোশাকে ৩০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন এই পেসার। ডোনাল্ডের মান বোঝার জন্য একটা তথ্যই যথেষ্ট। তাঁর ‘বানি’ ছিলেন স্বয়ং ক্রিকেটের বরপুত্র খ্যাত ব্রায়ান চার্লস লারা। আট বারের দেখায় ছয় বারই ব্রায়ান লারাকে নিজের শিকারে পরিনত করেন।
ডোনাল্ডকে বোলিং করতে দেখা এটা সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল। নাকে আর গালে জিঙ্ক ক্রিম মেখে নামতেন, সাথে ছিল তুখোড় পেস। তাই তো নামকরণ হয়েছিল ‘সাদা বিদ্যুৎ’ নামে। ডোনাল্ডের বায়োগ্রাফিও প্রকাশিত হয়েছে একই নামে।
অ্যালান ডোনাল্ডের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল ঐতিহাসিক এক দিনে। সেটা ছিল ১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দিনটির কথা কখনোই ভুলবে না। সেদিনই নিষেধাজ্ঞা শেষ করে পুনর্জীবন লাভ করে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট। ইডেন গার্ডেন্সে সেদিন এক লাখ মানুষের সামনে ভারতের মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
এই আন্তর্জাতিক এক্সপোজারে প্রোটিয়া দলের অধিকাংশই সেদিন অভ্যস্ত ছিলেন না। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বোর্ডে জমা করতে পারে মাত্র ৭৭ রান। তবে, সাদা বিদ্যুৎ অপেক্ষায় ছিলেন বোলিংয়ে নামার। সেদিনই তিনি প্রথমবারের মত ঝলক দেখান। ৮.৪ ওভার বোলিং করে মাত্র ২৯ রান হজম করে নেন পাঁচ উইকেট। যদিও, সেদিন তরুণ শচীন টেন্ডুলকারের ৭৩ বলে ৬২ রানের ইনিংসে ভর করে জিতে যায় ভারত। তবে, শচীন-ডোনাল্ড দু’জনকেই যৌথ ভাবে ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়া হয়।
সেই থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ব্যাটসম্যানদের রাতের ঘুম হারাম করেছেন ২০০৩ সাল অবধি। যে আসরে তিনি নায়ক থেকে খলনায়ক বনে গিয়েছেন, সেই ১৯৯৯ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেও তিনি ১৬ টা উইকেট পেয়েছেন।
বাইশ গজের সাফল্য ডোনাল্ড ধরে রেখেছেন ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পরও। তিনি সম সেরা বোলিং কোচদের একজন। তিনি ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, পুনে ওয়ারিয়র্স ইন্ডিয়া, ওয়ারউইকশায়ার, শ্রীলঙ্কা, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের মত দলের হয়ে কাজ করেছেন।
মজার একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি। প্রোটিয়া ইতিহাসের সেরা পেসার শৈশবে ফুটবল নয় বরং রাগবিকেই বেছে নিতে চেয়েছিলেন। গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রাগবি অনেক এগিয়ে থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার এক নম্বর খেলা। ক্রিকেট দ্বিতীয় আর তৃতীয়তে থাকবে ফুটবল। আমি ফ্লাই হাফ ও ফুল-ব্যাক হিবে খেলতাম। একটা সময় বুঝতে পারলাম এটা খুবই নির্মম একটা খেলা। তখনই সিদ্ধান্ত পাল্টালাম।’
ভাগ্যিস সিদ্ধান্ত বদলেছিলেন, না হয় বাইশ গজে সাদা বিদ্যুতের ঝলক আদৌ দেখা যেত না!