চোখের তৃপ্তি হয়েও তিনি এক আক্ষেপের নাম

অলক কাপালি, নামটা বাংলাদেশি যে কোনো ক্রিকেট ভক্তের কাছে অপরিচিত নয়। ২০০২ সালে কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। লেগস্পিন নামক সোনার হরিণ তার দ্বারা পূরণের স্বপ্ন ছিল। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে করেছিলেন হ্যাটট্রিক!

যদিও, তিনি ছিলেন মূলত ব্যাটসম্যান। সব ছাপিয়ে তাই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে নজর কেড়েছিলেন সবার। উইকেটের চারপাশে দারুণ সব শট খেলতে পারার গুণ ছিল। রিস্টওয়ার্কে স্ট্রোক গুলো চোখের প্রশান্তি এনে দিত। এখনো ক্রিকেট অনুরাগীদের আলোচনায় থাকেন, বাংলাদেশি সেরা স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে আশরাফুলের সাথে বেশ একটা জমজমাট লড়াই হয়। তুলনায় যাচ্ছি না, তবে এখন আমরা লিটনের ব্যাটিংয়ে এমন সৌন্দর্যটা পাই।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার ৮৯ রানের ইনিংস, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭১ রান কিংবা ভারতের বিপক্ষে শতক; সবই ছিল চোখের প্রশান্তি। প্রমাণ রেখেছিলেন যোগ্যতারও। একজন অলক কাপালি তার সুদর্শন ব্যাটিংয়ের জন্য এখনো ভক্তদের মনে গেঁথে আছেন। স্টাইলিশ ব্যাটিং, কব্জির মোচড়ে সফট হ্যান্ডের চোখ ধাঁধানো শটগুলো কার না চোখে ভাসে!

সেই সময়টাতে দলের নির্ভরযোগ্য এবং সেরা ফিল্ডারদের একজন ছিলেন তিনি। আউট ফিল্ডে দারুণ সব থ্রো, ক্যাচ এই সময়ের অনেক ফিল্ডারদের অনুকরণীয়। ওই সময়ে এশিয়া একাদশে ঠাই পাওয়া গুটি কয়েক বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের একজন তিনি। খেলেছেন শচীন টেন্ডুলকার, সনাথ জয়াসুরিয়াদের মত কিংবদন্তিদের সাথে।

ক্যারিয়ারের নানান চড়াই-উতরাই পার করে ২০০৮ সালে ভারতের বিপক্ষে অসাধারণ সেঞ্চুরির পর যেখানে ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হওয়ার কথা, সেখানে মাস খানেক পর তিনি নিষিদ্ধ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের (আইসিএল)  ফাঁদে পা দিয়ে নিষিদ্ধ হন বাংলাদেশ ক্রিকেটে।

সেখানে গিয়েও টুর্নামেন্টের প্রথম সেঞ্চুরি আসে তার ব্যাট থেকে। ৬০ বলে ১০০ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেছিলেন। আক্ষেপটা তখন আরো বেড়েছিল ভক্তদের। কিন্তু দেশের ক্রিকেট ছেড়ে ভিনদেশী ক্লাবের হয়ে খেলাটা কেউই ভালো চোখে দেখেনি। হারিয়েছেন অনেক ভক্ত অনুসারী।

নিষেধাজ্ঞা শেষে ফের সুযোগ মেলে ২০১১ সালের এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজে। একই বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন তাতে দলে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল না। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর সুযোগ মিলেনি তার। যদিও ফার্স্টক্লাস ক্রিকেট, অন্যান্য ঘরোয়া ক্রিকেট সহ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) নিয়মিত একজন পারফর্মার। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে চ্যাম্পিয়ন বানানোর নায়ক ছিলেন অলক কাপালি।

ক্যারিয়ারে অনেক অর্জন থাকলেও দিন শেষে অলক কাপালি একটি আক্ষেপের নাম। শুধু স্টাইলটাই ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ে দেয় না। যতই চোখের তৃপ্তি দিক, দিন শেষে মানুষ তার পরিসংখ্যান ঘাটে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২৭৬ ইনিংসে ৩৭টি হাফ সেঞ্চুরি আর ২০টি সেঞ্চুরিতে ৯০৬৭ আর মাত্র ২.৯৭ ইকনোমিতে ২১৫ উইকেট পাওয়া ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক টেস্ট পরিসংখ্যান একেবারেই সাদাসিধে!

১৭ টেস্টের ৩৪ ইনিংসে ব্যাট করেও দুই ফিফটিতে মাত্র ৫৮৪ রান। গড় মাত্র ১৭.৬৯! বোলিংয়ের প্রাপ্তি বলতে শুধু পাকিস্তানের বিপক্ষে হ্যাট্রিক। ১৯ ইনিংসে কব্জি ঘুরিয়ে উইকেট পেয়েছেন মাত্র ৬টি!

এদিকে ২২১ লিস্ট এ ম্যাচে সাড়ে চার হাজারের উপরে রান এবং ১৪০ উইকেট নেয়া ক্রিকেটারের ওডিআই পরিসংখ্যানও হতাশায় ভরা। ৬৯ ম্যাচ খেলে পাঁচ ফিফটি আর এক সেঞ্চুরিতে ১৯.৬০ এভারেজে ১২৩৫ রান! বোলিং ঝুলিতে ২৪ উইকেট!

সাতটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ৬৭.০৫ স্ট্রাইকরেটে সর্বসাকুল্যে রান মাত্র ৫৭। সর্বোচ্চ ১৯ রান। আছে দুটি উইকেট।

ঘরোয়া ক্রিকেটের কিংবদন্তি ক্রিকেটার যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো ফরম্যাটেই ২০-এর উপরে ব্যাটিং গড় টেনে নিতে পারেননি, সেখানে জাতীয় দলে নিজের জায়গাটুকুই বা কতটুকু টেনে নিতে পারতেন! ওয়াসিম জাফর কিংবা দেশের তুষার ইমরানের মতো অলক কাপালিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আক্ষেপ! অথচ তার সেরা সার্ভিসটা পেলে বাংলাদেশ অনেক কিছুই পেত।

২০০৮ সালের ২৮ জুন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ভারতের বিপক্ষে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। আরপি সিং, মানপ্রীত গনি, ইশান্ত শর্মাদের তুলোধুনো করে দৃষ্টিনন্দন ১০ চার ও ৫ ছক্কায় মাত্র ৯৬ বলে সাজিয়েছিলেন ১১৫ রানের ইনিংসটি। সব ফরম্যাট মিলিয়ে এটি তার নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম এবং একমাত্র সেঞ্চুরিও।

অলক কাপালিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট মনে রাখবে। কব্জির মোচড়ে কিংবা স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটানো চোখের তৃপ্তি ছিলেন, তবুও সবচেয়ে বড় ছিলেন এক আক্ষেপের নাম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link