রিয়ালের ডাগআউট মাতাতে নতুন কোচের সন্ধান পেয়ে গিয়েছেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। জিনেদিন জিদানের বিদায়ের পর থেকেই শুরু রিয়ালের কোচ খোঁজা শুরু। কিন্তু জিদানের বিদায়টা কোনোভাবেই সুখকর ছিল না, বরং তার লেখা খোলা চিঠি আরো বাজে অবস্থানে ফেলে দিয়েছে রিয়ালকে।
ফলে কোচদের আগ্রহও ছিল কিছুটা কমতির দিকে। কিন্তু সে সময়ে এসে রিয়াল ফিরিয়ে এনেছে তাদের পুরাতন তারকাকে। রিয়ালের ডাগআউট রাঙাতে ফেরত এসেছেন কার্লো আনচেলত্তি। রিয়ালের এই সময়ে আনচেলত্তির ইনক্লুশনটা একপ্রকার পলিটিক্যাল মুভই বলা যায়।
ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের অবস্থান রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের কাছে বেশ নড়বড়ে। সমর্থকদের কাছ থেকেও কথা শুনতে হচ্ছে তাকে। জিদানের বিদায়টা সুখকর হয়নি, অনেক নাটকীয়তা চলছে অধিনায়কের কন্ট্রাক্ট নিয়ে। আর তার মাঝে যে কোচই আসতেন, তাকেই পরতে হতো সমালোচনার মুখে। কিন্তু সেসময় পেরেজ এমন একজনকে রিয়ালকে এনেছেন যাকে রিয়াল কেন, কোনো দলের কোনো সমর্থকই ঘৃণা করতে পারবেন না।
সেই সাথে আনচেলত্তি এমন একজন কোচ যিনি ড্রেসিংরুম সামলাতে পারেন। প্রতিটি খেলোয়াড়ের সাথে বন্ধুও হতে পারেন আবার কোচও হতে পারেন। রিয়ালের শর্টলিস্টে থাকা অন্যসব কোচদের মধ্যে এই গুণের বেশ অভাব ছিল। শুধু তাই নয়, আনচেলত্তি শুধু খেলোয়াড় নয় বোর্ডের সাথেও বেশ ভালো সম্পর্ক রাখেন।
এই মুহূর্তে রিয়াল বোর্ডের জন্যও সেরকম একজনকেই দরকার ছিল। আনচেলত্তি ছিলেন রিয়ালের জন্য সবদিক দিয়ে পারফেক্ট। শেষবার কার্লো আনচেলত্তি এসে শুরু করেছিলেন রিয়ালের স্বর্ণযুগ। হোসে মরিনহোর রেখে যাওয়া রিয়ালকে পেয়ে সময় নেননি, রিয়াল মাদ্রিদের ১২ বছরের অপেক্ষা ভেঙেছিলেন তিনি।
জিতিয়েছিলেন ‘লা ডেসিমা’ চ্যাম্পিয়নস লিগের সংখ্যা দুই অঙ্কের ঘরে পৌছে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরের মৌসুমটা আর সেরকম হয়নি, ফলে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কোপের মুখে পরতে হয় তাকে। শিরোপা দিতে না পারায় পরের মৌসুমেই বরখাস্ত হন আনচেলত্তি।
আনচেলত্তির সাথে বিচ্ছেদ হলেও মনের মিলটা ছিল রিয়ালের। যে কারণে হন্যে হয়ে কোচ খুঁজে বেড়ানো রিয়াল যখন তাকে খবর দিলো, উড়তে ঊড়তে রিয়ালে ফেরত এলেন তিনি। এর আগেও পিএসজি ইউরোপজয়ের স্বপ্ন নিয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছিল দলকে, বিশাল প্রজেক্ট বানিয়েছিলেন দলের সাথে মিলে। কিন্তু রিয়ালের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি এই ইতালিয়ান।
এবারও একই ব্যাপার। এভারটনকে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলানোর স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছিলেন যাত্রা। কিন্তু এক মৌসুমের মাথাতেই তিনি চলে আসলেন রিয়ালের ডাকে। রিয়ালের প্রতি তার ভালোবাসার অন্ত নেই, কিন্তু ভঙ্গুর রিয়ালকে কী আবারও আগের জায়গাতে নিয়ে আসতে পারবেন আনচেলত্তি? নাকি পেরেজের বলি হতে হবে তাকে আগের মতন?
আনচেলত্তির আগের এই এইবারের দলের মধ্যে পার্থক্য প্রচুর। ২০১৪ সালে যখন প্রথম এসেছিলেন তখন পেয়েছিলেন মোরিনহোর রেখে যাওয়া রিয়ালকে। সে দলে ছিল তারকায় ভরপুর। তার কাছে ছিল বিবিসি, মাঝমাঠে ডি মারিয়া, মদ্রিচ, জাবি আলানসো। ডিফেন্সেও রামোস-পেপে।
কিন্তু সেই রিয়াল আর এই রিয়ালের মধ্যে পার্থক্য অনেক। এই রিয়ালে এখন এত তারকা নেই, বরং রিয়ালজুড়ে আছে প্রচুর ইয়াংস্টার আর ইনজুরি। এই রিয়ালে সমস্যা চারিদিকে। এই কার্লো আনচেলত্তির সামনে সব সমস্যার সমাধান করে শিরোপার দেখা দিতে হবে। তিনি কি পারবেন?
আনচেলত্তির সামনে মূল সমস্যা হলো রিয়ালের অ্যাটাক। করিম বেনজেমা আনচেলত্তির সময় থেকে বেশি লিথায়ল। সে জায়গাতে একটা ভালো সুবিধা পাবেন তিনি। কিন্তু বেনজেমা বাদে নাকি অ্যাটাকারদের অবস্থা বলার মতনই না। ভিনিসিয়ুস, অ্যাসেন্সিও, রদ্রিগো; কেউই রিয়ালের সেরা তারকা নন। এমনকি নিজেদের দিনেও তাদের খেলাটা পারফেক্ট হয় না।
আনচেলত্তির অধীনে সবসময়ই তারকাবহুল দল থাকে, স্পিডি উইঙ্গার থাকেন। আগেরবার তার মূলশক্তি ছিল দুই উইঙ্গে রোনালদো আর বেল। কিন্তু এখন রোনালদো নেই, বেলও ফুরিয়ে গিয়েছেন। আর নতুন তারকারাও আপ টু দ্যা মার্ক খেলতে পারছেন না। তাই আনচেলত্তিকে ডাগআউটের কড়া মাস্টার হতে হবে যদি তাদের থেকে ভাও কিছু বের করতে চান। সেটা কতটুকু করতে পারবেন সেটাও একটা প্রশ্ন।
মাঝমাঠে আনচেলত্তির ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার প্রচুর অস্ত্র আছে। সেদিক দিয়ে সমস্যা নেই কিন্তু বড় সমস্যা দলের অধিনায়কের চলে যাওয়া। রামোসের রিয়াল ছাড়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এই সময়ে নতুনদের সামনে থেকে লিড দেওয়ার জন্য রামোসের মতন তারকা আর কেউ নেই। এই মুহূর্তে রামোস দল ছেড়ে দিলে দলের লিডার খুঁজে পেতেও বেশ বেগ পেতে হবে তাকে।
আনচেলত্তির সবচেয়ে সমস্যা সম্ভবত তার রোটেশন পদ্ধতিতে। আনচেলত্তি একটা ফিক্সড স্কোয়াড নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। সেটা সব জায়গাতেই। তার ট্যাক্টিসে একজনের জায়গা আরেকজনকে ফিল করতে হয়। যে কারণে আগেরবার মদ্রিচকে হারিয়েই পুরো মৌসুম জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল রিয়ালকে। এবার সেটা নিশ্চয় করতে চাইবেন না। যে কারণে রোটেশনেও বড়সর একটা পরিবর্তন আনতে হবে তাকে। নইলে তার কপালে শনিই লেখা আছে।
তবে আশার কথা এই যে রিয়ালের এই দলে আরো তারকা আসছেন, আরো তারকা চলেও যাবেন। ইউরোর আগে আর ইউরোর পরে রিয়ালের স্কোয়াড এক থাকছে না। আর এই স্কোয়াডকে সমৃদ্ধ করার জন্য আনচেলত্তির মতন কোচ এই সময়ে খুব কমই আছে।
এই আনচেলত্তিই রোনালদোকে পুরুদুস্তর উইঙ্গার থেকে স্ট্রাইকার বানিয়েছিলেন, ট্রান্সফর্ম করেছিলেন আজকের রোনালদোতে। সে জিনিসটা যদি ভিনিসিয়ুস বা রদ্রিগোকে করতে পারেন, তবে আনচেলত্তির সামনে ভালো কিছুই লেখা আছে।
ধারে থাকা ব্রাহিম ডিয়াজ, মার্টিন ওডেগার্ডও তার ট্যাক্টিসে বসে যাবেন খাপে খাপ। আনচেলত্তির তাই খেলোয়াড় বাজিয়ে দেখতেও বিন্দুমাত্র সমস্যা হবে না। সেই সাথে তো তার ওল্ডগার্ড বেল, বেনজেমা, ক্রুস, মদ্রিচ, ভারানে, সার্জিও রামোসরা আছেনই।
আনচেলত্তির সাথে রিয়ালে ফেরত এসেছেন রিয়ালের পুরাতন ট্রেইনার অ্যান্তোনিও পিন্টুস। সেই সাথে নিজের সহকারী হিসেবে নিয়েছেন আলভেরো আরবেলোয়াকে। দু’জনেই রিয়ালের ঘরের মানুষ। আনচেলত্তি না থাকার সময়ে রিয়ালকে কাছে থেকে দেখেছেন।
আরবেলোয়া ইতোমধ্যে নিজেকে প্রমাণ করেছেন রিয়ালের অনুর্ধ্ব-১৪ দলে কোচ হিসেবে। জিতিয়েছেন শিরোপা। জিদানের মতন আরেকজন রিয়াল মাদ্রিদ লিজেন্ড হাতেকলমে শিখতে যাচ্ছেন আনচেলত্তির কাছ থেকে, এর থেকে সুখকর ব্যাপার মাদ্রিদিস্তাদের জন্য আর কী-ই বা হতে পারে?
আনচেলত্তির সাথে রিয়ালের চুক্তি ৩ বছরের। কিন্তু সকলেই জানে এই ক্লাবে ট্রফি দিতে না পারলে মৌসুম শেষের পত্রপাঠে বিদায় বলবেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। ৬১ বছর বয়সে দ্বিতীয়বারের মতন ড্রিম জব পাওয়া আনচেলত্তির টিকে থাকতে হলে ভালো কিছু করে দেখানোর বিকল্প নেই।