ভয়ডরহীন অ্যাপ্রোচ, পাওয়ার হিটিং, স্ট্রাইকরেট— টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একজন ব্যাটারের সত্যিকারের ব্যাটার হয়ে ওঠা হয় এই রেসিপিতেই। কিন্তু এই রেসিপি মেনে ব্যাট করেনই বা কজন? টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখনও অ্যাঙ্করিং রোলে ব্যাট করা ব্যাটারের ছড়াছড়ি। র্যাঙ্কিং নামক সাম্রাজ্যে তাদের রাজত্ব আবার প্রায় ধ্রুব হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যাঙ্করিং রোল প্লে করার ব্যাটাররা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য কতটা ক্ষতিকর? শতাংশের হিসেবে তাদের সেই ভূমিকা আদৌ কতটুকু দলের সফলতা এনে দিতে সক্ষম হয়?
এ ক্ষেত্রে অনেকেই ম্যাচ পরিস্থিতিকে সামনে টেনে আনবেন। অনেক সময় কোনোমতে ১০০ পেরোনো স্ট্রাইকরেট নিয়েও ম্যাচজয়ের নায়ক হওয়া যায়। আবার কোনো সময় দেড়শো ছোঁয়া স্ট্রাইকরেটও ম্যাচ জেতাতে ব্যর্থ হয়।
তবে ব্যাপারটা হলো, পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং করা আর সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যাটিং করা— এই দুটোর মধ্যে একটা ফারাক আছে। যেমন অনেকেই ম্যাচ পরিস্থিতিটা ভালভাবে রপ্ত করতে পারেন। আবার অনেকের সক্ষমতাতেও আটকে থাকে, তার ব্যাটিংয়ের ধরনটা কেমন, অ্যাঙ্করিং রোল প্লে নাকি পাওয়ার হিটিং?
একটা উদাহরণ তুলে আনা যাক। পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে ৪৭ বলে ৫৯ রানের ইনিংস খেলেছেন বিরাট কোহলি। এই ইনিংস খেলার পথে তিনি পঞ্চাশে পৌঁছান ৪২তম বলে। কোহলির এমন ইনিংসেও অবশ্য দলের কেনো ক্ষতি হয়নি। যথারীতি জয়টা তাদেরই এসেছে। তাই এমন পরিস্থিতিতে বিরাটের ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও অবান্তর।
কিন্তু ঠিক এমন একটা ইনিংসেই গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ম্যাচ হেরেছিল ভারত। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে ৪০ বলে ৫০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। অথচ সে ম্যাচে বিরাট বাদে যে তিনজন ফিফটি পেয়েছিলেন তাদের ইনিংগুলো ছিল যথাক্রমে ৩৩ বলে ৬৩, ৪৭ বলে ৮৬, ৪৯ বলে ৮০। একটু গভীরভাবে ম্যাচটাতে নজর দিলে দেখা যাবে, বিরাটের ঐ অ্যাঙ্করিং রোলই ভারতকে ম্যাচ থেকে নিরবে ছিটকে দিয়েছে।
আরেকটা উদাহরণও টেনে আনা যেতে পারে। জশ বাটলার বরাবরই এই সংস্করণে মারকুটে ব্যাটিং করে থাকেন। টি-টোয়েন্টিতে তার ১৪৪ স্ট্রাইকরেট সেই প্রমাণই দেয়। কিন্তু লখনৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে হারের দায়টা অনেকাংশেই দেয়া যেতে পারে বাটলারকে।
১৫৫ রানের লক্ষ্যে ইনিংসের শুরু থেকেই নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ ব্যাটিং করতে থাকেন বাটলার। ৪১ বলে খেলেন ৪০ রানের ইনিংস। আর ঐ মন্থরতম ইনিংসেই সহজ জয়ের পথে হাটতে থাকা রাজস্থানের ইনিংসে হঠাতই ছন্দচ্যূতি হয়।
এবারের আইপিএলে অ্যাঙ্করিং রোলে ব্যাট করায় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছেন লোকেশ রাহুল। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার, কেভিন পিটারসেন কোনো রকম রাখঢাক না রেখেই বলে দিয়েছেন, পাওয়া প্লে’তে লোকেশের ব্যাটিং সবচাইতে বিরক্তিকর দৃশ্য।
ক্রিকেটের এই ক্ষুদ্রতম সংস্করণে এমন অ্যাঙ্করিং রোলে ব্যাটে আরো অনেক নামী ব্যাটার রয়েছেন। এই যেমন বাবর আজম আর মোহাম্মদ রিজওয়ান। বিগত বছরগুলোতে এ দুই ব্যাটারের ব্যাটে চেপে পাকিস্তান প্রচুর ম্যাচ জিতেছে। তবে তাদের প্রতি ম্যাচেই সাবধানী শুরু দলকে অনেক সময় বিপদেও ঠেলে দিয়েছে।
হ্যাঁ। পরিসংখ্যানে এ দুই ব্যাটারের ত্রুটি বের করাই যেন এক মুশকিলের ব্যাপার। দুই ব্যাটারেরই ৪০ এর উপরে ব্যাটিং গড়। এর সাথে নিয়মিত বিরতিতে অর্ধশতক, শতক হাঁকানোর কীর্তি তো আছেই। রেকর্ডে সমৃদ্ধ হচ্ছে, সময়ের সাথে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন দুজনই। কিন্তু যেটা হচ্ছে না সেটা হলো, টি-টোয়েন্টির আদর্শ সংজ্ঞা মেনে সিংহভাগ ম্যাচে আক্রমণত্বক ব্যাটিং।
বাবর, কোহলি, লোকেশ—সময়ের সেরা ব্যাটার বলেই বিবেচিত হন। কিন্তু ভিন্ন একটা পরিসংখ্যানের মারপ্যাচে তাদের সীমাবদ্ধতাও খুবই বাজেভাবে বেরিয়ে আসে। সেই পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বিরাট কোহলি টি-টোয়েন্টিতে তার ক্যারিয়ারে যতগুলো ফিফটি পেয়েছেন তার ৬৬ ভাগ ফিফটিই পেয়েছে ৩৫ বা তার বেশি বল হজম করে।
বাবর আজমের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা আরো ভয়ানক। তিনি তার ক্যারিয়ারের ৭১ ভাগ ফিফটিই পেয়েছেন ৩৫ বা তার বেশি বল খেলে। লোকেশ রাহুলের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটা ৫৮ ভাগ। আর শিখর ধাওয়ান ৬৬ ভাগ ফিফটি পূরণ করেছে ৩৫ এর বেশি বল খেলে।
এই পরিসংখ্যান গুলোই প্রমাণ করে, টি-টোয়েন্টিতে তাদেরকে সফল তকমা দিলেও, তারা মূলত কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলে নিরব ঘাতকের ভূমিকাতেও কাজ করেন। হয়তো দলের পরাজয়ে পিছনে একজন ব্যাটারের অ্যাঙ্করিং রোলে ব্যাটিং করাকে সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় না। অনেক সমশ সেগুলো আড়ালে থেকে যায়। কিন্তু এই সব ইনিংস গুলো চুপিসারে একটি দলকে অনেক সময়ই বাজে অবস্থায় ফেলে দেয়।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবাইকেই কি তবে পাওয়ার হিটার হতে হবে? মোটেই তা নয়। ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝে ব্যাটিং করার যথার্থতা অবশ্যই আছে। তবে এই রয়েশয়ে শুরু, উইকেটে থিতু হওয়া, দলের ইনিংস সংহত করার লক্ষ্যে উইকেট আগলে রাখা- এমন প্রবণতা কিংবা নেতিবাচক মানসিকতা সিংহভাগ সময়েই দলের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।
একজন ব্যাটার যদি প্রথমে ব্যাট করে ১২০ স্ট্রাইকরেটে খেলেন তবে প্রতিপক্ষের দেয়া ২০০ রানের লক্ষ্যে তিনি কি সেই একই অ্যাপ্রোচে খেলবেন? মোটেই তা নয়। কিন্তু এখানে সমস্যাটা হলো, আক্রমণাত্বক ইনিংস খেলার অনভ্যস্ততায় ঐ ব্যাটারের পাওয়ার হিটিংয়ে ব্যাট হাতে দারুণ কিছু করে দেখানোর সম্ভাবনা খুবই কম।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এ জন্যই যেকোনো ম্যাচে অ্যাঙ্করিং রোল দলের জন্য বিপদজনক। হয়তো সব ম্যাচে সেই ব্যাপারটা ধরা পড়বে না। তবে একটা দলের কোনো শিরোপা জয়ের দৌড়ে শত প্রতিকূলতাময় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেটার গলদটা ঠিকই বেরিয়ে আসবে।