অপূর্ব সেনগুপ্ত: ‘বিস্ময়কর’ এক টেস্ট ক্যারিয়ার

পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে রঞ্জি ট্রফিতে সার্ভিসেস দলগুলোর খুব দাপট ছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিমু অধিকারীর নেতৃত্বে টানা দুইবার ফাইনাল খেলে সেনাবাহিনী দল। সেই দল থেকেই পরবর্তীতে ভারত পায় পাঁচজন টেস্ট ক্রিকেটার। চন্দ্রশেখর গাধকারি, রমন সুরেন্দ্রনাথ, ভেনটাপ্পা মুড্ডিয়া, নারায়ণস্বামী এবং অপূর্ব সেনগুপ্ত। আমাদের এই আজকের গল্পটা পাঁচজনের শেষজন অপূর্ব সেনগুপ্তকে নিয়েই।

১৯৩৮ সালে লখনৌতে জন্মগ্রহণ করা অপূর্ব কিশোর বয়সেই যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। সেখানে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ ম্যাচগুলোতে ভালো খেলার সুবাদে বড়কর্তাদের নজরে পড়েন তিনি। সে সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী রঞ্জিতে সার্ভিসেস দল গড়ছিল। অপূর্বও সুযোগ পেয়ে যান সেই দলে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে অপূর্বর। ক্যারিবীয়দের সেই দলে ছিলেন ভয়ংকর দুই পেসার রয় গিলক্রিস্ট এবং ওয়েস হল। নিজের অভিষেক ম্যাচেই গিলক্রিস্টকে দারুণভাবে সামলে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করেন তিনি। এ ম্যাচ দিয়েই মূকত সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন তিনি। দুই মাস পরেই দিল্লীর বিপক্ষে ম্যাচে ৩২ রানে নেন ছয় উইকেট।

ক্রিকেট মাঠে অপূর্ব ছিলেন পরিপূর্ণ এক ক্রিকেটার যাকে যেকোনো অধিনায়কই দলে পেতে চাইবেন। ডানহাতে ইনিংস উদ্বোধন করার পাশাপাশি দারুণ লেগস্পিন করতেন তিনি। লেগস্পিন, গুগলি, ফ্লিপারের মায়াজালে আবদ্ধ করে সাজঘরে ফেরত পাঠাতেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। পাশাপাশি যোগ করুন স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে তার অতুলনীয় দক্ষতা। সবমিলিয়ে সবাই অপেক্ষা করছিলেন অপূর্বও জাতীয় দলে ডাক পাবার জন্য।

তার জাতীয় দলে অভিষেক নিয়েও হয়েছিল নানা নাটক, জল্পনা-কল্পনা। ১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভারত সফর শুরুই হয়েছিল নানা নাটকের মধ্য দিয়ে। প্রথমে গুলাম আহমদেকে অধিনায়ক নিযুক্ত করা হলেও প্রথম টেস্ট শুরুর আগে সেই দায়িত্ব পান পলি উমরিগড়। সেই অভিমানেই কিনা মাদ্রাজে তৃতীয় টেস্ট শুরুর আগে হুট করে অবসরের ঘোষণা দেন গুলাম আহমেদ।

অন্যদিকে নিয়মিত আরেক ওপেনার বিজয় মাঞ্জেরেকারও তখন ইনজুরিতে। এমতাবস্থায় প্রধান নির্বাচক লালা অমরনাথ এবং অধিনায়ক উমরিগড় বসেন বিকল্পদের নাম নিয়ে। জেশু প্যাটেল, কৃপাল সিং, মনোহর হার্দিকার, অপূর্ব সেনগুপ্তের নাম ছিল সেই তালিকায়। অধিনায়কের চাওয়া ছিলেন হার্দিকার অন্যদিকে প্রধান নির্বাচক চাইছিলেন প্যাটেলের অভিষেক ঘটাতে।

মতবিরোধের এক পর্যায়ে টেস্টের আগের দিন রাতে অধিনায়কত্ব থেকে ইস্তফা দেন উমরিগড়। ম্যাচ শুরুর ১৫ মিনিট আগেও জানতেন না কে যাবেন টস করতে। অবশেষে তাড়াহুড়ো করে ভিনু মানকড় যান টস করতে, নানা ঘটনার পর অভিষেক ঘটে অপূর্ব এবং কৃপাল সিংয়ের। হতভম্ভ অপূর্বকে মিনিটপাঁচেকের মাঝেই ব্যাট-প্যাড পড়ে নেমে যেতে হয় মাঠে।

আর সেখানে অপেক্ষা করছিলেন ওয়েস হল-রয় গিলক্রিস্টরা। এ যেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বাঘের মুখে গিয়ে পড়া। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছিল, পুরো টেস্ট জুড়েই নিজের হতবিহবল ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি অপূর্ব। আউট হন এক এবং আট রান করে। ঘটনাচক্রে খেলা সেই টেস্টই একমাত্র হয়ে আছে অপূর্বর ক্যারিয়ারে।

১৯৫৯-৬০ মৌসুমে রঞ্জিতে অপূর্ব তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম কাটিয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের বিপক্ষে সেমিফাইনালে খেলেছিলেন অপরাজিত ১৪৬ রানের ঝলমলে এক ইনিংস। ১৯৬৭ সালে মাদ্রাজের বিপক্ষে রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনালই ছিল অপূর্ব ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। সে ম্যাচে শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরমনের বলে আউট হবার আগে করেছিলেন ৩১ রান।

পরিসংখ্যান আপনাকে কখনোই বলবে না অপূর্ব কতটা ভালোমানের ব্যাটসম্যান ছিলেন। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে ক্যারিয়ারের সেরা সময়ের অনেকটাই তাকে কাটাতে হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে, সুযোগ পাননি খেলার। য়ার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেই সেই বিরতির ছাপ স্পষ্ট। নিজের প্রথম দুই মৌসুমে যেখানে তিনি রান করেছেন ৪২.২৫ গড়ে।

পরে ফিরে এসে আর কখনোই ফিরে পাননি আগের ধার, পরের ছয় বছরে রান করেছেন মাত্র ২১.২৩ গড়ে। অবশ্য সেনাবাহিনী কর্মকর্তা হিসেবে দারুণ সফল তিনি, পদ্দোন্নতি পেয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে। কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বস্বরূপ জিতেছেন পরম ভিস্মিত সেবা মেডেল এবং অতি ভিস্মিত সেবা মেডেল। দায়িত্ব পালন করেছেন কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা দেশে।

সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর পরিবারের সাথে দিল্লীতে বসবাস করতেন অপুর্ব সেনগুপ্ত। সেখানেই স্থানীয় এক হাসপাতালে ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর দেহত্যাগ করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link