অর্জুন টেন্ডুলকারের জন্য এটা একটা খুব অপ্রিয় একটা প্রশ্ন।
অবশ্য তিনি যে পরিচয় ও নাম নিয়ে দুনিয়াতে এসেছেন, তাতে তাঁকে এই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে শুনে যেতে হবে। এই বাস্তবতা তিনি নিজেও অনেকদিন ধরে জানেন। তার বাবাও এই বাস্তবতার সাথে পরিচিত। সেই প্রথম যখন মুম্বাই অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পেলেন, তখন থেকেই অর্জুনকে এই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে যে, বাবার কারণেই কী তিনি ক্রিকেটের প্রমোশনগুলো পাচ্ছেন।
সমস্যা হলো, অর্জুন কোনো ভাবেই শচীন টেন্ডুলকারের মতো ক্ষণজন্মা প্রতিভা নন। শচীনের কথা বাদ দিন। শচীনের মতো ভারত তো বটেই, দুনিয়াতেই আর ক’জন এসেছেন। উদাহরণের জন্য বলা যায়, আবেশ খান, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, খলিল আহমেদ বা এই টি নটরাজন বা শার্দুল ঠাকুরের মতো প্রতিভাধর বলেও অর্জুন নিজেকে প্রমানিত করতে পারেননি। তিনি সাধারণ একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার। এই ধরুন, রোহান গাভাস্কারের মতো মিডিওকর বলতে পারেন।
আর এখানেই ট্রাজেডিটা লুকানো।
কালোর্ত্তীন প্রতিভাধর বাবার মিডিওকোর ছেলে হওয়ার যন্ত্রনাটা রোহান গাভাস্কার, সন্দীপ রায় খুব ভালো করে জানেন। এমনিতে অর্জুনের মতো ছেলে অনেকেই মুশতাক আলী ট্রফি খেলছেন। ওখানে যারা খেলে সবাই এমন কিছু বিরাট কোহলি বা মায়াঙ্ক আগারওয়াল বা পৃথ্বী শ নন। একটা দেশের শত শত ক্রিকেটার তো আর টপ লেভেলের হয় না। সেখানে মধ্যম সারিরও একটা জায়গা থাকে। এমনকি মধ্যম প্রতিভার হয়েও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে দেশকে কিছু দেওয়ার উদাহরণও আছে। এই রবিন সিংয়ের কথা মনে করে দেখুন। কিংবা অজয় জাদেজারও আহামরী প্রতিভা ছিল না।
কিন্তু অর্জুনের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, তিনি মধ্যমমানের পারফরম্যান্স দিয়ে বাঁচতে পারবেন না। তাকে বারবারই লড়াই করতে হবে শচীনের সর্বগ্রাসী ছায়ার সাথে। বারবারই প্রশ্ন করা হবে, অতো বড় বাবার ছেলের পারফরম্যান্স এমন কেন? বারবারই প্রশ্ন তোলা হবে, বাবার নামে কারণে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন না তো অর্জুন?
এই প্রশ্নটা প্রথম উঠলো অর্জুন যখন ওয়েস্ট জোন অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পেলেন।
সে সময় টুইটারে একটা খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, অর্জুনকে দলে নেওয়ার জন্য প্রতিভাধর প্রনব ধানওয়ান্ডেকে অবহেলা করা হয়েছে। এই দল গঠনের কিছুদিন আগে ধানওয়ান্ডে হাজার রানের এক ইনিংস খেলে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। ফলে তাকে রেখে অর্জুনকে দলে নেওয়ায় অনেকেই নেপোটিজমের গন্ধ খুজে পেলেন।
শেষ পর্যন্ত ওই দলের বিবৃতি দিতে হয়েছিলো। তারা বলেছিলেন, ধানওয়ান্ডে কোনো কাঠামোর মধ্যে ছিলেন না। তাই তাকে দলে নেওয়া হয়নি। আর ধানওয়ান্ডে বনাম অর্জুন, এমন কোনো বিবেচনা তাদের ছিলো না। ধানওয়ান্ডে দলে ঢুকলে ব্যাটসম্যান হিসেবে অন্য কারো জায়গায় ঢুকবেন।
এরপর অর্জুন যখন যুব দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে গেলো, তখনও এসব প্রশ্ন উঠলো। এবার সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে সিনিয়র দলে আসার পরও অর্জুনকে নিয়ে একই প্রশ্ন। কার্যত প্রথম ম্যাচে অত্যন্ত সাদামাটা পারফরম্যান্সের পর প্রশ্নটা আরও বড় হয়ে উঠেছে।
নির্বাচকদের বারবারই অর্জুনকে নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। সমালোচকরাও এসব ব্যাখ্যায় খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। তারাও অর্জুন যে ‘বিশেষ সুবিধা’ পাচ্ছেন, এটা প্রমাণ করতে বদ্ধ পরিকর।
হ্যা, কিছু ‘বিশেষ সুবিধা’ তো অর্জুন পাচ্ছেনই।
বাবার শচীন হওয়াতে দুনিয়ার সেরা সেরা খেলোয়াড়কে ছোটবেলা থেকে দেখছেন, তাদের কাছ থেকে টিপস নিতে পারছেন। তাকে নেটে বোলিং দেখিয়ে দিয়েছেন ওয়াসিম আকরাম স্বয়ং। এখন রাজস্থানের কোনো গ্রামের এক অমিত সম্ভাবনাময় পেসার নিশ্চয়ই মাথা কুটে মরলেও ওয়াসিমকে খুজে পাবেন না। অর্জুন বড় হয়ে উঠতে না উঠতেই তাঁর জন্য ব্যক্তিগত কোচ রাখা হয়েছে, বাসায় বিশ্বের সবচেয়ে উচু মানের অনুশীলন সুবিধা ও ইনডোর তৈরি করা হয়েছে তার জন্য।
মহারাষ্ট্রের দিন আনি দিন খাই পরিবারের অসামান্য সম্ভাবনাময় ছেলেটি শত কষ্টেও এসব সুবিধা স্বপ্নে দেখতে পাবে না। কিন্তু অর্জুন এসব পাচ্ছেন। তিনি বিনা চেষ্টায় আরব আমিরাতে গিয়ে মুম্বাইয়ে ইন্ডিয়ান্সের নেটে বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যানকে বল করে আসছেন। অবশ্যই তিনি এসব সুবিধা বাবার জন্য পাচ্ছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতে অর্জুনের দোষ কোথায়?
আপনার বাবার এমন ক্ষমতা থাকলে আপনিও এসব সুবিধা নিতেন। আর বাবা শচীনেরই বা এতে দোষ কোথায়? আমার ক্ষমতা থাকলে আমি আমার ছেলের জন্য এর চেয়েও বেশি আয়োজন করে দিতাম। এখন দেখার ব্যাপার হলো, শচীন তার ছেলেকে কোনো দলে সুযোগ পাইয়ে দিতে কোথাও প্রভাব খাটাচ্ছেন কি না? কিংবা কেউ শচীনের ছেলে বলে আসলেই কোনো দলে অর্জুনকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে কি না?
কিংবদন্তি ক্রিকেটার দিলীপ সরদেশাইয়ের ছেলে, সাংবাদিক রাজদ্বীপ সারদেশাই বলছিলেন, এসব সুবিধাও আসলে কোনো পার্থক্য গড়ে দিতে পারে না, ‘আপনি অমিতাভ বচ্চনের ছেলে হন, কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে; তাতে কিছু যায় আসে না। ক্রিকেটে টিকে থাকতে গেলে আপনাকে পারফরমই করতে হবে। শেষ পর্যন্ত উইকেটে কেউ আপনার হয়ে কথা বলবে না।’
এটাই আসলে চূড়ান্ত কথা।
অর্জুনের এখন সব ফেলে ওই ২২ গজেই তাকাতে হবে। বাবার নাম হয়তো তাকে কিছু ফ্যাসিলিটিজ জোগাড় করে দেবে। বাবার নাম সেই সাথে প্রতিনিয়ত তাকে বিব্রত করবে। তবে একবার যদি নিজে কিছু করতে পারেন, লোকে ভুলে যাবে যে, তিনি কার ছেলে।
উদাহরণ চোখের সামনেই আছে। মানুষ একটু মনে রাখেনি যে, মহিন্দর অমরনাথ ছিলেন লালা অমরনাথের ছেলে। তিনি ঠিকই বাবাকে ছাপিয়ের গিয়েছিলেন। আবার সেই লালা অমরনাথেরই আরেক ছেলে সুরিন্দর চাপা পড়েছিলেন বাবা-ভাইয়ের নামের নিচে।
এখন অর্জুন ঠিক করবেন, তিনি কোন পথ বেছে নেবেন। তবে, এখন পর্যন্ত এটা বলা যায় যে, বাবার পরিচয়ের সুবাদে হলেও তিনি বাকিদের চেয়ে সুযোগটা বেশিই পাবেন!