দ্য ম্যাজিশিয়ান অব মিলান

১৯৭৯ সালে শেষবার ইউরোপিয়ান ফুটবলে ট্রফি জয়ের পর সময়টা ভালো যাচ্ছিল না ইতালির বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব এসি মিলানের। ইতালীয় ‘রোসোনারি’দের সামনে ১০ বছর ট্রফি জয়ের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল যোগ্য ফুটবল দর্শনের অভাব।

১৯৮৬ সালে মিলানের সভাপতি পদে নিযুক্ত হলেন সিলভিও বার্লুসকোনি। সিলভিও’র উদ্যোগেই ১৯৮৭ সালে মিলানের দায়িত্ব দেওয়া হয় কোচ আরিগো সাচ্চিকে। কিন্তু গোঁড়া ইতালীয় মিডিয়ার সমালোচনার রোষ যায় অখ্যাত সাচ্চি’র ওপর। মিলানের হটসিটে সাচ্চি’র মতো অখ্যাত কোচের আবির্ভাব যেন পছন্দ হয় নি কারও।

মিডিয়ার প্রশ্নের জবাবে সাচ্চি জানান, বিখ্যাত জকি হওয়ার জন্য পূর্বে ঘোড়া হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। তবু বার্লুসকোনির জেদেই নিজের কাজ শুরু করেন সাচ্চি। সেই বছরই মিলানে যোগ দেন দুই ওলন্দাজ তারকা রুদ খুলিত ও মার্কো ভ্যান বাস্তেন।

১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই দলের প্র্যাকটিসের খোলনলচে বদলাতে শুরু করলেন সাচ্চি। তিনি ফুটবলে প্রথম নিয়ে এলেন ‘কালেক্টিভ ইন্টালিজেন্স’ স্ট্র্যাটেজি। সদ্যসমাপ্ত মেক্সিকো বিশ্বকাপে ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনার একক প্রতিভায় বুঁদ হয়ে থাকা ফুটবল দুনিয়াকে সাকি যেন আস্তে আস্তে দেখাতে শুরু করলেন ফুটবল বিজ্ঞানের অন্য এক পথ।

ম্যাচের আগে প্র্যাকটিসে সংবাদমাধ্যম এবং হাজার হাজার মিলান সমর্থক দেখল এক অভাবনীয় দৃশ্য। সম্পূর্ণ একটি ফুটবল ম্যাচ সাচ্চি খেলালেন নিজের দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে। কিন্তু সেই ম্যাচে রইল না কোন ফুটবল, সাচ্চি’র মতানুসারে ৯০ মিনিট ১১ জন খেলোয়াড় প্রতিমুহুর্তে যাতে ঠিক কোন জায়গায় বলের অবস্থান তা কল্পনা করার অবস্থায় থাকে তাঁর জন্যই এই প্র্যাকটিস।

১৯৮৮ সালে কিছুটা ব্যাকফুটে থেকেই সিরি ‘এ’ এবং ইউরোপিয়ান কাপে নামল মিলান। কিন্তু, সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে আসল কার্যত অপ্রতিরোধ্য স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু চতুর সাচ্চি এই ম্যাচের আগেই মিলানে সই করিয়ে নিলেন আরেক ডাচ তারকা ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডকে।

এই মিলান দল যেন ক্রমেই হয়ে উঠতে লাগল বিপক্ষের ত্রাস। ফ্রাঙ্কো বারেসি, পাওলো মালদিনি, রাইকার্ড, খুলিত, ভ্যান বাস্তেন-রা বার্নাব্যু ও সান সিরো মিলিয়ে দুই লেগে ৬-১ গোলে পরাজিত করলেন মাদ্রিদকে। সে বছর ইউরোপিয়ান চাম্পিয়ন হল মিলান।

তৃতীয় বারের জন্য চ্যাম্পিয়ন হলেও থেমে থাকলেন না সাচ্চি। ফ্যাবিও কাপেলোকে সহযোগী হিসেবে নিয়ে ফুটবল দুনিয়ায় বিপ্লব নিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর হলেন তিনি। ১৯৮৯ সালে ফের ইউরোপ সেরা হয়ে সমস্ত সমালোচনার জবাব দিলেন সাচ্চি। বিশ্ব ফুটবলে যে মিলান ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল সেই মিলানই হয়ে উঠল ইউরোপীয়ান ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ।

৪-৪-২ ফর্মেশনে তুখোড় আক্রমণের ঝড় তুলে তিনি বুঝিয়ে দিলেন পুরোনো ‘লিবেরো’ তত্ত্বের দিন শেষ। তিনি প্রথম বৈজ্ঞানিক ভাবে দেখিয়ে দিলেন ম্যান মার্কিং নয় ডিফেন্ডারদের নোটবুকে আসল অস্ত্র হল জোনাল মার্কিং স্ট্র্যাটেজি। বিশ্বফুটবলে অখ্যাত এই ইতালিয়ান হয়ে উঠলেন ‘দ্যা প্রফেট অফ ফুসিগন্যানো’।

সেদিনের মিলান যে ফুটবল বিপ্লবের সূচনা করেছিল সাচ্চি হাত ধরে তাই যেন আগামী দুই দশক শাসন করল ইউরোপের ফুটবলকে। ফিফা্র সর্বশ্রেষ্ট ফুটবল দলের তালিকায় আর্সেনালের ‘দ্য ইনভিনসিবল’ এর পরেই দুই নম্বরে ঢুকে পড়ল সাচ্চির মিলান।

প্রায় ২০ বছর তিকিতাকা নামক আর এক ফুটবল বিপ্লবের নায়ক জাভি হার্নান্ডেজ তাই বলেই ফেললেন, ‘আমরা গর্বিত যে সাচ্চির মিলানের সাথে আমাদের তুলনা করা হয়েছিল এক সময়ে।’

ফুটবল ইতিহাসে যে সেই দল ছিল প্রকৃত অর্থেই এক রূপকথার গল্প যার নায়ক ছিলেন আরিগো সাচ্চি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link