অজি-অচলায়তন ভাঙা তাঁরা তিন

ঐতিহাসিক সবকিছু স্মৃতির আঙিনার খুব কাছেই থাকে। তাই কার্ডিফকে কখনও ভুলে যেতে পারিনা। এতবছর পরেও সেই কার্ডিফই বিশ্ব ক্রিকেটে বড়কিছু করার প্রেরণা যোগায়। কার্ডিফ ম্যাচের সদস্যরাই স্মৃতিতে ভেসে এসে স্বপ্ন দেখায়। দলের বাইরে দীর্ঘদিন অবস্থান করেও তাই এখনও আশরাফুল আমাদের হৃদয়ের খুবই কাছের। যাকে বারবার কাছে চায় কোটি ভক্তের হৃদয়।

ঐতিহাসিক কার্ডিফের সবুজ গালিচা এখনও সেই ইতিহাসের পক্ষেই কথা বলে। মাশরাফির শুরুর শিকারের পর, ব্যাট হাতে জবাব দিতে নেমে অজি বোলারদের শাসন করা আশরাফুলের শতক। সেই শতকে ভর করেই মোড়লের বিপক্ষে জয়। বিশ্ব ক্রিকেটের মূর্তিমান আতঙ্ক ম্যাকগ্রা আর গিলেস্পির ঘাম ছুটিয়ে আশরাফুলের পুল, কাভার ড্রাইভ আর স্কুপে বুঁদ হয়েছিল সেদিন দেশের কোটি ক্রিকেট সমর্থক। যখন কল্পনাও করা যেতোনা, তখন অসম্ভবকে সম্ভব করা সেই নায়ক মোহাম্মাদ আশরাফুল।

অজিরা নানান টালবাহানা করে। অযথা অজুহাতে দূরে থাকতে চায় বাংলাদেশ থেকে। আমন্ত্রণ জানালেও গ্রহণ করতে আপত্তি জানায়। তাইতো, নিরাপত্তার অজুহাতে দল ঘোষণা করেও শেষ মূহুর্তে বাংলাদেশ সফর বাতিল করে ২০১৫ সালে। হাজার চেষ্টা করেও সেবার আনা যায়নি তাদের। বিতর্ক দূরে রাখতে বাংলাদেশ অনুষ্ঠিত ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও দল পাঠায়নি তারা। তাতে তো আর বিশ্ব আসর থেমে থাকেনি। বাকিরা ঠিকই এসে সফরে করে গেছে।

শত নাটক পেছনে ফেলে ২০১৭ তে দুই টেস্ট খেলতে বাংলাদেশে অবশেষে অজিরা। মিরপুরের মাঠে বরাবরই বাংলাদেশ শক্ত প্রতিপক্ষ হলেও টেস্টে তো অজিদের সাথে ছেলেখেলা চলেনা। তাও যদি অঘটন ঘটানো যায় আরকি! যদিও সেই আশায় সমর্থকরা নিশ্চিত খেলা দেখতে না বসলেও মিরপুর তো এক বিচিত্র জায়গা। তার উপর আছে আমাদের এক সব্যসাচী ক্রিকেটার। তিনি সাকিব আল হাসান।

টেস্টের বিস্ময়ের জন্ম তার হাত ধরেই। দুই ইনিংসে দু’বার পাঁচ উইকেট আর ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসের ৮৪ রান। তাতেই কোমড় ভেঙে যায় অজিদের। টেস্টেও আমাদের অজি বধ। এক যুগ পর জয় এলো ক্যাঙারুদের বিপক্ষে টাইগারদের। বাঘের রাজাদের এমন পারফরম্যান্সে বিস্ময় প্রকাশ করে ক্রিকেট বোদ্ধাদের বন্দনায় ভাসায় সেদিন পুরো দলকে। স্পিন ট্র‍্যাকে ভড়কে দিয়ে সেবারের ম্যাচ জয়ের নায়ক বাংলাদেশে জান বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান।

অজিরা আবারও বাংলাদেশে আসবে। এবারের ফরম্যাটটা টি-টোয়েন্টি। বিপত্তি সেখানেই। কেননা, এই ফরম্যাটের সাধারণ জ্ঞানটুকুও আত্মস্থ করা হয়নি এখনও ঠিকঠাক। পেশিশক্তির জায়গায় থাকবে অজিরা এগিয়ে, আমাদের চেয়েও তাদের পারফর্মার বেশি। তাই জিতবে তো তারাই। এবার আর মিরপুরের উইকেটেও তাদের বিপক্ষে হাসিমুখের দেখা মিলবেনা বলেই ধারণা সবার। দিন যতই সামনে এগোতে থাকলো ততোই অজিদের সম্ভাবনাই চোখে ধরা পড়ছিলো। যার কারণ, কিউইদের মাঠে নাকানি-চুবানি খেয়ে টি-টোয়েন্টির আত্মবিশ্বাস তো তলানীতে।

যাই হোক, অজিরা আসার আগে এবার ভিন্ন শর্ত জুড়ে দিলো। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নাজুক আর অজিরা আবার এসবে বেশ সচেতন। ছাড় দেওয়া পাত্র নয় মোটেও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। একের পর এক কঠিন শর্তে নাজেহাল করে ছাড়লো। সবশেষ পানির বোতল মাঠে না ঢোকা আর গ্যালারিতে আছড়ে পড়া বল পুনরায় মাঠে না আসার শর্ত আরোপ করে বাড়াবাড়ি করে বসে। সমর্থকরা ক্ষোভে ফুঁসছিল। খেলোয়াড়রা ফুঁসেছে কিনা জানা নেই।

ফুঁসে থাকলেও প্রকাশ করেনি হয়তো। বাড়বাড়িটা অবজ্ঞার পর্যায়ে চলে গেছে। মাঠের খেলার আগে মানসিক খেলাটা শর্ত দিয়ে খেলেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। তবে, কাজে দেয়নি। দিনের শেষ হাসিটা বাংলাদেশেরই হয়েছে। মিরপুরের স্লো উইকেটে আবারও কাটা পড়লো হলুদ জার্সির খেলোয়াড়রা। উইন্ডিজের মাঠে অসহায়ত্বের ধারা বজায় থাকলো বাংলাদেশের মাটিতেও।

বোলিং আক্রমণে স্বভাবসুলভ অস্ট্রেলিয়া থাকলেও ব্যাটিংয়ে ছিলোনা। তাইতো মেহেদি হাসানের প্রথম বলেই পা ফঁসকে যায়। পরের ওভারের আঘাত নাসুমের। এরপর সাকিবের। অজিরা অল-আউট হয়ে ম্যাচ হেরেছে ২৩ রানে। ফিলিপ, ওয়েইডকে ফেরানোর পর অ্যাগারকে অ্যাগারের ভুলেই। এরপর তুলে নিলেন দিনের সবচেয়ে দামি উইকেট মিশেল মার্শকে। তাতেই জয় নিশ্চিত বাংলাদেশের। স্পিন ট্র‍্যাকে অস্ট্রেলিয়াকে নাজেহাল করে বাংলাদেশের এবারের শেষ হাসির নায়ক নাসুম।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সব ফরম্যাটেই এখন সমান সংখ্যক একটি করে জয়। আগের দুই জয়ের নায়ক আশরাফুল আর সাকিবের সাথে নতুন নায়কের নাম যোগ হলো নাসুম। এখনও চার ম্যাচ বাকি। সিরিজটা নিজেদের করে নেওয়ার আসল কাজটাই এখনও পড়ে আছে। তাই ন্যাসেরও দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। যেমনটা সাকিব নিয়মিত করেন। আজও করলেন। অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারানোর মূল নায়ক হয়েও যিনি ক্ষান্ত হননি। শিকারী চোখ আজও তার তীক্ষ্ণ ছিলো। নাসুমকেও হতে হবে ঠিক তাই।

তিন ফরম্যাটে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম তিনটি জয়েই ভিন্ন তিন নায়ক। এটা নিশ্চিত একটা মাইলফলক। অস্ট্রেলিয়ার বাঁধা টপকানোর তিন নায়ক। আসছে দিনে হয়তো নতুন অনেক ইতিহাস রচনা হবে ক্রিকেটে। তবে, এই ইতিহাসটা টিকে থাকবে সব সময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link