খেলাধুলা মানেই সাফল্য আর ব্যর্থতা, খেলাধুলা মানেই সৌভাগ্যের চিৎকার কিংবা দুর্ভাগ্যের আর্তনাদ। কেবল প্রতিভা আর পরিশ্রমই এখানে যথেষ্ট নয়, সৌভাগ্যও দরকার। ঠিক এজন্যই সকল রকম যোগ্যতা থাকার পরও কেউ কেউ যথেষ্ট সুযোগ পান না জাতীয় দলে।
তেমন এক গাদা মুখ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটেও দেখা যায়। বিশেষ করে নব্বই দশক কিংবা তার পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ান দলটা এতটাই অজেয় ছিল যে, তখন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) দরজার কড়া নাড়ছিলেন সম্ভাবনাময় এক গাদা ক্রিকেটার। এদের কেউ কেউ সুযোগ পেয়েছেন অল্প বিস্তর, কেউ আবার একদমই পাননি। এদের নিয়ে চাইলে একটা পুরো টেস্ট একাদশই বানিয়ে ফেলা যায়।
- মাইকেল ডি ভেনুটো
২৫ হাজারের ওপর রান, ৬০ টি সেঞ্চুরি – পুল, হুক কিংবা কাট – সব জায়গাতেই অনন্য তিনি। তবুও ব্যাগি গ্রিনের স্বপ্ন পূরণ হয়নি তাসমানিয়ার হয়ে শেফিল্ড শিল্ডের মাইকেল ডি ভেনুটোর। নয় ওয়ানডে খেলে করেছেন দু’টি হাফ সেঞ্চুরি। টেস্ট ক্রিকেটে কখনোই খেলতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে।
- জেমি কক্স
নব্বই দশকের শেষের দিকে কিংবা এরপরেও অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপে জায়গা করে নেওয়াটা ছেলের হাতের মোয়া ছিল না। তাই তো, শেফিল্ড শিল্ডের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (১০,৮২১) হয়েও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে কখনো খেলতে পারেননি জেমি কক্স। অথচ, ৫১ টি সেঞ্চুরি-সহ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আঠারো হাজারের ওপর রান করেন তিনি।
যাকে জাতীয় দলে নেননি নির্বাচকরা, সেই কক্সই পরে নির্বাচক বনে যান। তিনি একবার বলেন, ‘আমাকে এক যুগ ধরে নির্বাচকরা হতাশ করেছে। আমি মনে করি, সেই ঘটনাই আমাকে নির্বাচক হিসেবে সবচেয়ে শক্ত করেছে।’
- মার্টিন লাভ
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর রান প্রায় ১৭ হাজার। সেঞ্চুরি ৪৫ টি, হাফ সেঞ্চুরি ৭৮ টি। সর্বোচ্চ ইনিংসটা ৩০০ রানের। ২০০৯ সালে মেলবোর্নে কুইন্সল্যান্ডের হয়ে শেষবার যখন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাঠে নামেন সেবারও প্রথম ইনিংসে ৪১, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১০৪ রান। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টেও সেঞ্চুরি করেন মার্টিন লাভ।
সেখানে লাভকে ভালবাসার সুযোগ কোথায় অজিদের। আজকের দিনে হলে হয়তো, দিব্যি ৪০-৫০ টা টেস্ট অন্তত খেলে ফেলতে পারতেন। কিংবা কে জানে, যে প্রতিভা নিয়ে তিনি এসেছিলেন আরো অনেক দিনই হয়তো সার্ভিস দিতে পারতেন জাতীয় দলকে। অথচ, মাত্র পাঁচ টেস্টেই ক্যারিয়ার শেষ হয় মার্টিন লাভের।
- ব্র্যাড হজ (অধিনায়ক)
ব্র্যাড হজ ২২৩ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে প্রায় ৪৯ গড় নিয়ে ১৭ হাজারের ওপর রান করেন, সেঞ্চুরি ৫১ টি। টেস্টের অভিষেকে করেন ৬০ রান। তিন ম্যাচ বাদে করেন ২০৩ রান, পার্থে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ম্যাচে তাঁকে সামলাতে হয় শন পোলক, মাখায়া এনটিনি, চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট কিংবা আন্দ্রে নেলদের।
কিন্তু, দুই টেস্ট বাদেই বাদ পড়েন। আরো দুই বছরের অপেক্ষা। যখন ফিরে যখন অবশেষে খেলার সুযোগ পান, তখন দুই ইনিংসে করেন যথাক্রমে ৬৭ ও ২৭। ব্যাস, এখানেই শেষ। ছয় টেস্টে ৫৬ ছুঁইছুঁই গড়ে ৫০০’রও পর রান নিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয় হজের। এছাড়া খেলেন ২৫ টি টেস্ট ও ১৫ টি ওয়ানডে।
- স্টুয়ার্ট ল (সহ-অধিনায়ক)
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে স্টুয়ার্ট ল’র সেঞ্চুরির সংখ্যা ৭৯ টি। অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে এই ফরম্যাটে বর্তমানের এই প্রতিষ্ঠিত কোচের চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করেছেন কেবল পাঁচ জন। অথচ, খেলতে পেরেছেন মাত্র একটা টেস্ট।
কেন পারেননি? কারণ, তাঁর খেলা ওই এক টেস্টেই অভিষেক হয় এক কিংবদন্তির। তিনি রিকি পন্টিং। টেস্ট না হলেও ওয়ানডেতে মোটামুটি সুযোগ পান ল। ৫৪ টি ৫০ ওভারের ম্যাচে একটা সেঞ্চুরি ও সাতটা হাফ সেঞ্চুরি করেন তিনি।
- জেমি সিডন্স
শেফিল্ড শিল্ডে তিনি ১০,৬৪৩ রান করেন, অথচ, তাঁকে কখনো দেখাই যায়নি টেস্ট ক্রিকেটে। দেখা যাবে কি করে! জেমি যখন অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে বিরাট বিরাট সব স্কোর করে চলেছেন – তখন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিং লাইন আপের সবাই একেকজন কিংবদন্তি। অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিং – কে নেই!
তবে, একবার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন টেস্ট দলের। ১৯৮৮ সালে ক্যারিয়ারের একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচটা খেলেন। এরপর তিনি পাকস্থলীর বিচিত্র এক রোগে এক বছরের জন্য ছিটকে যান। তবে, ইনজুরি থেকে ফিরেও তিনি আলোচনায় ছিলেন। তবে, ১৯৯১-৯২ মৌসুমে মার্ভ হিউজের এক বাউন্সারের পর ইতি ঘটে স্বপ্নের।
- টম মুডি
কোচ হিসেবে খ্যাতনামা তিনি। হতে পারতেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারদের একজনও। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২১ হাজারের ওপর রান ও পেস বোলিংয়ে ৩৬১ টি উইকেট ছিল তাঁর। কিন্তু, ক্যারিয়ার থামে মাত্র আট টেস্টেই। এই অল্প সুযোগেই দু’টি সেঞ্চুরি ও তিনটি হাফ সেঞ্চুরি করেন। দু’টি উইকেটও নেন।
ওয়ানডেতে আরেকটু বেশি খেলেন। ৭৬ টি ওয়ানডের ক্যারিয়ারে ১২০০’র ওপর রান ও ৫২ টি উইকেট আছে তাঁর।
- ক্রিস হার্টলি (উইকেটরক্ষক)
নি:সন্দেহে তিনি ইতিহাসের সেরা উইকেটরক্ষক যার কখনোই জাতীয় দলে খেলার সৌভাগ্য হয়নি। ড্যারেন ব্যারির সাথে এখানে তাঁর লড়াই হতে পারে। তবে, রান কিংবা ডিসমিসাল – সব দিকেই এগিয়ে থাকবেন হার্টলি। তিনি শেফিল্ড শিল্ডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডিসমিসালধারী (৫৬৪) উইকেটরক্ষক। ব্যাট হাতে ১০ টি সেঞ্চুরি-সহ করেছেন ছয় হাজারের ওপর রান।
২০০৮-৯ মৌসুমে জাতীয় দলের একদম কাছেই চলে এসেছিলেন। তবে, শেষ মুহূর্তে ব্র্যাড হ্যাডিনের পাশে দ্বিতীয় উইকেটরক্ষক হিসেবে ডাক পান গ্রাহাম মানু।
- অ্যান্ডি বিকেল
৪৩০ টি উইকেট নিয়ে শেফিল্ড শিল্ডের সর্বকালের সেরা উইকেটশিকারীদের তালিকায় ওপরের দিকেই আছে অ্যান্ডি বিকেলের নাম। কিন্তু, গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পি আর ব্রেট লি-রা থাকায় খুব লম্বা সময় খেলতেই পারেননি অস্ট্রেলিয়া দলে।
সাত বছরের ক্যারিয়ারে খেলেছেন মোটে ১৯ টেস্ট! তবে ওয়ানডে খেলেছেন ৬৭ টি। ওয়ানডেতে ৪৭১ রান আর বল হাতে ৭৮ উইকেট। ১৯ টেস্টে ৩৫৫ রান আর ব্যাট হাতে ৫৮ উইকেট – এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় বিকেলকে।
- ডেমিয়েন রাইট
তাসমানিয়া দলে ডেমিয়েন রাইট ছিলেন অ্যান্ডি বিকেলের সঙ্গী। ১৬ বার পাঁচ উইকেট, মোট উইকেট ৪০৬ টি। ২০ টি হাফ সেঞ্চুরি, একটি সেঞ্চুরি, প্রায় চার হাজার রান – কোনো কিছুই যথেষ্ট হয়নি ব্যাগি গ্রিনের জন্য। শুধু টেস্ট না, কোনো ফরম্যাটেই খেলতে পারেনি তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। এই ডেমিয়েন রাইট আজকাল কোচ হিসেবে বেশ সফল। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব- ১৯ দলের কোচিংও করিয়েছেন।
- স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল
ইতিহাসের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার। কিন্তু, সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনারের জন্ম যে একই সময়ে। হ্যাঁ, টেস্টে তিনি ২০৮ উইকেট নিয়েছেন বটে, তবে সক্ষমতা ছিল ৫০০’র ওপর উইকেট নেওয়ার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিয়েছেন ৭৭৪ টি উইকেট।
ম্যাকগিল ওয়ানডেতেও একই রকম দুর্ভাগা। তিন ম্যাচ খেলে নেন ছয় উইকেট। ইকোনমি রেটও মাত্র সাড়ে তিন! এই তিন ম্যাচের একটাতে আবার ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতেছিলেন।
- দ্বাদশ ব্যক্তি: মাইকেল বেভান
ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা কিংবদন্তি তিনি। ম্যাচ জিতে মাঠ থেকে বের হওয়াকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে, জেতেন দু’টি বিশ্বকাপ। কিন্তু, টেস্ট ক্রিকেটটা তাঁর জন্য ছিল না কখনোই।
মোটে ১৮ টি টেস্টে সুযোগ পেয়ে ছয়টি হাফ সেঞ্চুরি করেন। উইকেট নেন ২৯ টি। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যাডিলেড ওভালে এক ম্যাচেই ১০ উইকেট নিয়ে বাজিমাৎ করেন। তবে, আক্ষেপটা আরো বাড়বে যখন শুনবেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এই বেভানই প্রায় ৫৮ গড়ে করেন ১৯ হাজারের বেশি রান।