অন্যান্য দিনের মতোই ওপেনিংয়ে ছিলো দূরবস্থা। সৌম্যের কাভার ড্রাইভ আর পুল শটে আত্মবিশ্বাস ফেরত পাওয়া বাংলাদেশের হাল ধরতে হয়েছিলো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। হয়েছিলেন ইতিহাসের প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপ সেঞ্চুরিয়ান। সাকিবের ব্যাটিং ব্যর্থতায় মিডেল ওভারে মুশফিকের হার না শতক ছুঁই ছুঁই ইনিংস।
বোলিংয়ে পেসারদের একচ্ছত্র দাপট। আর শেষ ওভারে রুবেলের সেই বিধ্বংসী ইয়োর্কার এখনও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে৷ কান এখনও নাসের হুসেনের সেই লাইনগুলো স্পষ্ট শুনতে পায়। কিশোর বয়সে সারাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে অনুষ্ঠিত হওয়া এসএসসি পরীক্ষার চাপ নিয়ে দেখা ছয় বছর আগের সেই ম্যাচের স্মৃতি কখনো ভোলার নয়।
পুরো বিশ্বকাপেই ছিলো ওপেনারদের নড়বড়ে অবস্থা। এক ওপেনারের ইনজুরিতে আরেক ওপেনার কে দেশ থেকে উড়িয়ে এনেও লুটে নেওয়া যায়নি ফায়দা। জেমস অ্যান্ডারসনের ফাঁদে দুজনেই পা দিলেন। একজন ব্যাকফুট ডিফেন্সে আর আরেকজন ফ্রম ফুট ডিফেন্সে। তবে ফাঁদে পা তারা দিলেন-ই।
শুরুর দুই ওভারে দলীয় রান ১০ না পেরোতেই দুই অভিজ্ঞ ওপেনার তামিম-কায়েস সাজঘরে পাড়ি জমিয়ে ফেললেন। পরপর দুই স্বাগতিকের কাছে হেরে টুর্নামেন্টের শুরুতেই খাদের কিনারায় চলে যাওয়া ইংল্যান্ডের বাঁচা-মরার ম্যাচে ক্ষুধার্ত মনোভাব ম্যাচের শুরুর দুই ওভারেই স্পষ্ট হয়েছিলো।
ওপেনারদের ব্যর্থতায় পুরো বিশ্বকাপেই চোখ জুড়ানো স্কয়ার কাট আর কাভার ড্রাইভে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইনিংসে দলের আত্মবিশ্বাস ফেরাতেন সৌম্য সরকার। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগানোর জোর এই কারণেই বোধহয় সবসময় দেয়া হয় ক্রিকেটে। অ্যান্ডারসন, ব্রড, ওকস কিংবা জর্ডান – সবাইকেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে মোকাবেলা করেছেন সৌম্য।
অপর প্রান্তে থাকা অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তখনও মাঠে থিতু হতে না পারলেও! উইকেট বিলিয়ে দেননি। বিশ্বকাপের পূর্বে ওজন কমিয়ে এসেছেন তো মাঠে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার জন্যেই। নিজের প্রথম বাউন্ডারি ব্যাটের কানায় লেগে পেয়েছিলেন বটে! তবে ১১ তম ওভারে পয়েন্ট অঞ্চল দিয়ে ব্রডকে হাঁকানো নিজের দ্বিতীয় বাউন্ডারি তে নতুন কিছু হওয়ার আভাস দিয়েছিলেন।
সৌম্য-রিয়াদ জুটিতে আশা দেখছিলো বাংলাদেশ। আমার মতো এসএসসি পরীক্ষার চাপ মাথায় নিয়ে খেলা দেখা কিশোররা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে থাকে এই জুটির সাবলীল ব্যাটিং দেখে। মঈন আলীর শর্ট পিচ ডেলিভারি কে পেছনের পায়ে ভর করে কাউ কর্ণারে ছয় হাঁকিয়ে সৌম্য ভয়ানক কিছুর আশা দিচ্ছিলেন।
কিন্তু কয়েক ওভার পেরোতেই জর্ডানের দূর্দান্ত বাউন্সার লিভ করতে গিয়ে বডি ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে গ্লাভসে লেগে বাটলারের হাতে ধরা পড়েন সৌম্য ৪০ রানে। সৌম্যের পর সাকিব মাঠে এসে বিদায় নেন মঈন আলীর নিরামিষ স্পিনে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে।
একশো’র আগে চার উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে এসে মুশফিক অনায়াসেই মোকাবেলা করতে থাকেন ইংলিশ সিমারদের৷ মুশফিকের আগমনে আরো ক্ষুরধার হয় একপ্রান্ত আগলে রাখা রিয়াদের উইলো। যেই বাউন্সারে সৌম্য কে হটিয়েছিলেন জর্ডান সেই বাউন্সারে রিয়াদের কাছে বাউন্ডারি ছাড়া হলেন এবার। মুশফিক-রিয়াদ জুটি মাঠে ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে শুরু করে। মাঠের চারপাশে চার-ছয়ের পসরা সাজিয়ে দলের ইনিংস বড় করতে থাকেন এ দুজন।
মাঠে নেমে শুরু থেকেই ইংলিশ বোলারদের উপর চড়াও হন মুশফিক। স্লগ সুইপ, পুল শট, স্কয়ার কাটে দিশেহারা করে দেন প্রতিপক্ষ কে। অন্যপ্রান্তে রিয়াদ তখন আশরাফুল ও তামিম কে টপকে বিশ্বকাপের সেরা সংগ্রহের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
৪৩ তম ওভারের ব্রডের তৃতীয় বল কে পয়েন্টে ঠেলে দিয়ে একটি রান নিয়ে ইতিহাসের প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপ শতক পূর্ণ করেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। অন্যপ্রান্তে ডাইভ দিয়ে পৌঁছে রিয়াদের প্রাপ্তিতে উল্লাসটা আগে মুশফিক করলেন। অন্যদিকে রিয়াদের উচ্ছ্বাস তখন বাঁধভাঙা। হাওয়ার খামে করে প্রিয়জন কে করলেন ভালোবাসা উৎসর্গ। ডাগআউটে সতীর্থরা দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাতে ভুললেন না।
৪৫ তম ওভারে রান আউট হয়ে ফেরত যাওয়ার আগে ১৩৯ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলে দলের ভিত শক্ত করে দিয়ে যান রিয়াদ। এরই সাথে অবসান ঘটে মুশফিক-রিয়াদের ১৪১ রানের জুটি। রিয়াদের আউটের পর মুশফিকও আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি মাঠে।
দ্রুত রান বের করতে গিয়ে ব্রডের স্লোয়ারে পরাস্ত হয়ে ফেরত যান ৮৯ রানে। শেষ পর্যন্ত মাঠে টিকতে পারলে একই ম্যাচে দুই শতকের দেখা পেতো বাংলাদেশ। পরবর্তী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সাব্বির ডাউন দ্যা উইকেটে এসে কাউ কর্ণারে ছয় হাঁকিয়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দেন ব্রডের বুকে। নির্ধারিত পঞ্চাশ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেট হারিয়ে ২৭৫।
জবাবে ব্যাট করতে নামা ইংলিশ দুই ওপেনার ইয়ান বেল ও মঈন আলীর মাঝে বাঁচা মরার লড়াইয়ের কোনো চাপ দেখা যায়নি। নিজেদের স্বাভাবিক খেলাই খেলতে থাকেন তারা। দুই ওপেনারের ব্যাটে ছিলো আত্মবিশ্বাসের তীব্র ছোঁয়া। মাশরাফি ও রুবেল কে বেশ ভালো সামলে যাচ্ছিলেন দু’জন।
প্রথম ৭ ওভারেই ইংল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪৩ রান। বোলিংয়ে আরাফাত সানি কে নিয়ে আসেন অধিনায়ক মাশরাফি। লক্ষ্য একটাই! স্পিন দিয়ে ইংল্যান্ডের টপ অর্ডার ভেঙে দেওয়া। লক্ষ্য সফল হলো, তবে বোলারের কৃতিত্বে নয়! দুই ব্যাটসম্যানের ভুল বোঝাবুঝি তে। রান আউট হয়ে ফিরে যেতে হলো মঈন আলীকে।
নতুন ব্যাটসম্যান অ্যালেক্স হেলসের ব্যাটেও দেখা মিলছিলো নির্ভরতার ছোঁয়া। দ্রুত রান সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাঠে এসেই। দ্রুত চারটি চার হাঁকিয়ে অভিজ্ঞ ইয়ান বেল কে যৌক্তিক সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাঁধ সাধেন টাইগার কাপ্তান। দূর্দান্ত এক সিম আপ ডেলিভারিতে বোকা বানান হেলস কে।
কাভার ড্রাইভ করতে গিয়ে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান সাজঘরে। হেলস ফিরে গেলেও মাঠে টিকে অর্ধশতক আদায় করে নেন ইয়ান বেল। দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেদিন ইয়ান বেল। শুধুমাত্র অর্ধশতকেই তাকে থামানো যাবেনা তাকে অতিচককপ্রদ কিছু ছাড়া, বোঝাই যাচ্ছিলো সেটা।
দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে এসে একেবারে চমকপ্রদ কিছুই করেছিলেন রুবেল। দিনের সবচেয়ে গতিময় বোলারও ছিলেন সেদিন রুবেল। তার অসাধারণ এক বাউন্সারে বোকা বনে যান ইয়ান বেল, ব্যাটের এইজ হয়ে ধরা পড়েন মুশফিকের হাতে। ক্যাচ নিতে বেগ পেতে হয় মুশফিক কে। কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিতকরণ ম্যাচে মুশফিকও কোনো ভুল করেননি ক্যাচ লুফে নিতে। একই ওভারের চতুর্থ বলে পুনরায় বাউন্সারে পরাস্ত করেন ইংলিশ অধিনায়ক মরগ্যানকে।
এক্ষেত্রে স্কয়ার লেগে থাকা ফিল্ডার সাকিব আল হাসানের কৃতিত্ব সর্বাধিক। রুবেলের বাউন্সারে মরগানের পুল করা বল অনায়াসেই বাউন্ডারি মুখী হচ্ছিলো ছয়ের ঠিকানায়। মূহুর্তের মধ্যেই ফাইন লেগে থাকা সাকিব কয়েক পা এগিয়ে ছয় হতে যাওয়া বল কে লুফে নিয়ে অবাক করে দেন সবাই কে।
বাঁহাতি সাকিবের জন্য ডান পাশে তথা নিজের বিপরীত পাশের রানিং ক্যাচ লুফে নেওয়া এতোটা সহজ ছিলোনা, কিন্তু তিনি বেশ সহজেই ক্যাচটি তালুবন্দি করেছিলেন। এই কারণেই বোধহয় সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনন্য এক বিজ্ঞাপন।
জো রুটের সাথে মাঠে সঙ্গ দিতে ব্যর্থ হন জেমস টেলর। তাসকিন কে শাফল করে অফসাইডে খেলতে গিয়ে স্লিপে ইমরুল কায়েস কে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন। ততক্ষণে বড় পরাজয়ের শঙ্কায় ইংল্যান্ড। গ্যালারিভর্তি কেবল বাংলাদেশি দর্শকদের উন্মাদনাই নজরে আসছিলো।
অ্যাডিলেডের গ্যালারি পূর্ণ দখলে ছিলো লাল-সবুজ সেনাদের। নতুন ব্যাটসম্যান বাটলারের আগমন, অন্যদিকে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক-কোচদের কপালের ভাঁজ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক খেলতে থাকেন বাটলার। ম্যাচের হাল ধরার আগেই চাপমুক্ত হয়ে যাওয়া যাকে বলে আরকি। বাটলার সাবলিল থাকলেও, ফিরতি স্পেলে বোলিং করতে এসে দারুণ এক ডেলিভারিতে জো রুট কে সাজঘরের পথ দেখান অধিনায়ক মাশরাফি।
ছয় উইকেট হারিয়ে কোমড় ভেঙে যাওয়া ইংল্যান্ড ব্যাটিং লাইন-আপের বিপক্ষে জয়ের আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকা বাংলাদেশীদের অপেক্ষা দীর্ঘ করতে থাকে বাটলার-ওক্স জুটি। এই দুই ব্যাটসম্যানের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিংয়ে প্রথমবারের মত ম্যাচে পরাজয়ের শঙ্কা তৈরি হয় বাংলাদেশের। জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ইংল্যান্ড। দুই ব্যাটসম্যানের ৭৫ রানের জুটি ভাঙেন তাসকিন বাটলার কে ফিরিয়ে। বাটলার এক কথায় আত্মঘাতি শট খেলেই উইকেট বিলিয়ে এসেছিলেন। পরের বলে রান আউট হয়ে ফিরে যান ক্রিস জর্ডান। রান আউটের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে।
মাঠে জমে যাওয়া ওকসকে সঙ্গ দিতে আসেন অভিজ্ঞ স্টুয়ার্ট ব্রড। টেস্টে যার আছে শতক। অর্থ্যাৎ ইংল্যান্ডের জয়ের আশা তখনও ফুরিয়ে যায়নি। তাসকিনের বাউন্সারে মিড উইকেটে ছয় মেরে সমীকরণ সহজও করে ফেলেন তিনি। একই ওভারে লং অনে ক্যাচ তুলে দেন ক্রিস ওকস। লং অনে থাকা তামিম ইকবালের হাত ফসকে বেরিয়ে যায় সে বল৷ আচমকা কালো
মেঘে ঢেকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয় বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনার আকাশে৷ পরের ওভারের প্রথম বলেই স্টুয়ার্ট ব্রড কে বোল্ড করে জয় কাছে টেনে আনেন রুবেল। পরের বলে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের ইয়োর্কার এন্ডারসনের ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপর ফিল্ডার ইমরুল কায়েসের হাতে যায় মাটি ঘেঁষে। পরের বলেই বিধ্বংসী এক ইয়োর্কারে জেমস অ্যান্ডারসনকে বোল্ড করে ইতিহাস রচনা করেন রুবেল হোসেন।
প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নাম লেখায় বাংলাদেশ। উল্লাসে রুবেল ছুটে চললো অ্যাডিলেডের সবুজ গালিচার প্রান্তর ধরে, এ এক আবেগের ছুটে চলা! তাকে ঘিরে বাকি সতীর্থদের উল্লাস। একের পর এক ঝাপিয়ে পড়ার গল্প। অ্যাডিলেডের সবুজ গালিচা সাক্ষী হয়ে রইলো ইংল্যান্ড বধের ঐতিহাসিক গল্পের। রিয়াদ-রুবেলের অতিচমকপ্রদ পারফরম্যান্সের পাশাপাশি কমপ্লিট টিম ওয়ার্কের ফসল বিশ্বকাপ ইতিহাসে বাংলাদেশের এই সেরা জয়ের।