বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ হিসেবে অ্যালান ডোনাল্ডের সময়কাল পেরিয়েছে এক বছর। গত বছরের মার্চে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তো প্রোটিয়া এ কোচ তাঁর কোচিংয়ের এক বছরের সময়কালে কেমন করলেন? খেলোয়াড়ী জীবনে ‘সাদা বিদ্যুৎ’ হিসেবে পরিচিতি ছিল অ্যালান ডোনাল্ডের।
তো কোচিংয়ে এসেও কি কোনো চমক দেখাতে পারলেন তিনি? ডোনাল্ডোর দীক্ষায় বাংলাদেশের পেসাররা ঠিক কতটুকু উন্নতি ঘটাতে পারলো? ওটিস গিবসনের উত্তরসূরি হিসেবে গিবসনকে কি সত্যিই ছাপিয়ে যেতে পারলেন অ্যালান ডোনাল্ড?
অসংখ্য প্রশ্ন। তাই বিস্তর বিশ্লেষণের দাবি রাখে এত সব প্রশ্নের জট খুলতে। প্রথমত, ধরেই নেওয়া যেতে পারে পেসারদের উন্নতির জন্য প্রচুর খেটেছেন ডোনাল্ড। কিন্তু সে সব কিছু প্রতিফলন আবার মাঠে না দেখা গেলে অনেকাংশেই শ্রমটা পণ্ডশ্রম হয়ে যায়।
তাই পেসারদের উন্নতি, অবনতির চিত্রটা দিনশেষে তাদের পারফর্মেন্সেই ধরা পড়বে। একই সাথে, অ্যালান ডোনাল্ড কোচ হিসেবে কতটুকু সফল কিংবা ব্যর্থ সেটার মাপকাঠিও পেসারদের মাঠের পারফর্মেন্স।
এখন দেখা যাক সফলতা নাকি ব্যর্থতা, কোন নিক্তিতে অ্যালান ডোনাল্ড ভারী হয়ে ওঠেন।
গত এক বছরে অর্থাৎ অ্যালান ডোনাল্ডের সময়কালে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফলতম পেসার কে? কোনো রকমের পরিসংখ্যানের তোয়াক্কা না করে সবার সম্ভাব্য উত্তরই হবে, তাসকিন আহমেদ।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। তাসকিন অবশ্যই সফল। কিন্তু সব ফরম্যাটের হিসেবে উইকেট সংখ্যার বিচারে নামটা এবাদত হোসেন। শেষ এক বছরে বাংলাদেশি পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২ টি উইকেট নিয়েছেন তিনি।
আর এই ৩২ টি উইকেট নিতে তিনি ৬ টি টেস্ট, ৫ টি ওয়ানডে ও ৪ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। যার মধ্যে তাঁর ওয়ানডে পরিসংখ্যান সবচাইতে দুর্দান্ত, ৫ ম্যাচে নিয়েছেন ১৩ টি উইকেট।
গত বছরের শুরুতে কিউইদের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট জয়ের নায়ক ছিলেন এবাদত। তবে, এই পরিসংখ্যানে এবাদতের সে ম্যাচের উইকেট সংখ্যা যুক্ত করা হয়নি। কারণ অ্যালান ডোনাল্ড বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন তারও মাস দুয়েক পর।
এবাদতের পর এ সময়কালে সর্বোচ্চ ৩০ টি উইকেট নিয়েছেন তাসকিন। আর এর জন্য তাসকিন ম্যাচ খেলেছেন ২৫ টি। যার মধ্যে ৯ ওয়ানডেতে ১৪, ৩ টেস্টে ৩ আর ১৩ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১৩ টি উইকেট নিয়েছেন তিনি।
তবে উইকেট সংখ্যা এক পাশে রাখলে, ডোনাল্ডের এ সময়কালে বাংলাদেশের পেস বোলিংকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাসকিন। প্রত্যাশা অনুযায়ী উইকেট হয়তো পাননি, কিন্তু প্রতি সিরিজেই প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের উপর লাইন , লেন্থ আর পেস দিয়ে চড়াও হয়েছেন। প্রতিপক্ষের জন্য হয়েছেন আতঙ্কের এক নাম।
অ্যালান ডোনাল্ডের সময়ে তাসকিন, এবাদতরা উড়তে থাকলেও এই এক বছরে মোটাদাগে হতাশ করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান। এই মুহূর্তে দলে থাকা বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট তাঁর। অথচ গত এক বছরে প্রতিপক্ষের উইকেট শিকার করতেই যেন ভুলেই গেছেন তিনি।
সব ফরম্যাট মিলিয়ে গত এক বছরে ২৯ টি ম্যাচ খেলেছেন। অথচ নামের পাশে যোগ করতে পেরেছেন মাত্র ২২ টা উইকেট। গত এক বছরে অ্যালান ডোনাল্ডের জন্য তাই বড় এক হতাশার নাম হয়ে ছিলেন মুস্তাফিজ।
তবে তাঁর এমন হতাশাজনক পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে দিনশেষে কপাল পুড়বে বাংলাদেশেরই। কারণ সামনেই ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এমন বড় আসরে ভাল কিছু করতে হলে পুরনো মুস্তাফিজকেই সবার আগে প্রয়োজন।
গত এক বছরের মুস্তাফিজ যদি ডোনাল্ডের ব্যর্থতা হয় তাহলে খালেদ আহমেদ হবে প্রোটিয়া এ কোচের অন্যতম সফলতা। খালেদ শুধু লাল বলের ক্রিকেটই খেলেন। আর তাতে বেশ খানিকটা সফল তিনি। শেষ এক বছরে ৮ টেস্টে ২০ টা উইকেট নিয়েছেন। যার মধ্যে একটা ফাইফার আর একটা ৪ উইকেটও ছিল।
বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম আপাতত দলের বাইরেই রয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি- কোনো সিরিজের স্কোয়াডেই জায়গা হয়নি। তবে গত এক বছরের একাদশে বেশ নিয়মিত মুখই ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে ১৮ টা ম্যাচ খেলেছেন। খুব একটা খারাপ করেননি। তবে বলার মতো তেমন সফলতাও পাননি। সব মিলিয়ে নিজের ঝুলিতে জমা করেছেন ১৮ টা উইকেট।
শরিফুল এই মুহূর্তে দলে না থাকলেও হাসান মাহমুদ ঠিকই স্কোয়াডে নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের কোনো ম্যাচের একাদশে যদিও জায়গা হয়নি। তবে তরুণ এ পেসার গত এক বছরে বল হাতো বেশ ধারাবাহিকই ছিলেন।
খুব বেশি ম্যাচে সুযোগ হয়নি। তবে যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন তাতে একদম নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। ওয়ানডে আর টেস্ট, এই দুই ফরম্যাট মিলিয়ে গত এক বছরে ১২ ম্যাচে নিয়েছেন ১৬ টি উইকেট। যার মধ্যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেই নিয়েছেন ১৩ টি উইকেট। যা গত এক বছরে বাংলাদেশি পেসারদের মধ্যে তাসকিনের সাথে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশের প্লেয়িং কন্ডিশন বিবেচনায় পেসাররা বরাবরই সুযোগ কম পান। প্লেয়িং ইলেভেনে অনেক সময় বাংলাদেশকে একজন পেসার নিয়েও খেলতে দেখা গিয়েছে। সময়ের বিবর্তনে অবশ্য সেই সংস্কৃতি থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ।
বিদেশের মাটিতে সর্বেসবা হয়ে ওঠে পেসাররাই। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সিরিজ জয়- এ দুই মুহূর্তই এসেছিল পেসারদের কল্যাণে। তাই অ্যালান ডোনাল্ডের আমলে পেসারদের উন্নতির ছাপ স্পষ্টই ছিল।
তবে অন্য পেসারদের সম্ভাবনাময় যাত্রার বিপরীত পথে হেঁটেছেন মুস্তাফিজুর রহমান। শেষ এক বছরে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন ফিজ। চাপ কমাতে লাল বলের ক্রিকেট থেকে আপাতত দূরেই আছেন। তারপরও বাকি দুই ফরম্যাটে অচেনা মুস্তাফিজের বিবর্ণ রূপ দিনকে দিন যেন স্বাভাবিক বলয়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
সে বলয় থেকে বের হওয়ার উপায়টা নিশ্চিতভাবেই পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড খুঁজছেন। একই সাথে হয়তো এটা ভেবেও তিনি বিস্ময়ে ডুবে যান যে, ঠিক তাঁর সময়েই কেন দেশসেরা পেসার নিজেকে হারিয়ে ফেললেন।
কারো কাছেই এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে এর মাঝে আশঙ্কা জাগে, এটা অনুমিতই ছিল নাকি স্রেফ একটা ব্যাড প্যাচ? এই প্রশ্নের মোক্ষম জবাবটা বোধ করি মুস্তাফিজই ভালভাবে দিতে পারবেন।