গ্লেন ম্যাকগ্রা হাসছেন। আমি থাকলেও লাভ হত কি আদৌ? মনে হয় না। কথার মধ্যে একটা অদ্ভুত বাউন্স মেশানো থাকে পিজিয়নের। চট করে পুল করা যায় না। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। কোনো অজি তারকা এমন আদৌ কি বলতে পারেন? চ্যাপেল-বোর্ডারের দেশের লোক প্রতিপক্ষকে সমীহ করছেন? স্ট্রেঞ্জ!
কিন্তু বললেন। ওয়ার্নি আর পিজিয়নের সাঁড়াশিতে সুরভিত ভারতের অসুবিধা হবার প্রশ্ন নেই কারণ ভারত এবার অনেক তৈরী। পিচ ড্রাই, গোলার মতো পেস গাব্বা-মেলবোর্ণে। রিভিউ সিস্টেম তো দূরস্ত-গলায় কাঁটার মতো বাকনার। শচীনের ক্যাপ্টেন্সিতে ভরাডুবির পর সৌরভ দলটাকে নিয়ে এসেছেন স্রেফ একটা মস্তানি করতে।
জেতা হারা পরের ব্যাপার, অস্ট্রেলিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে স্টিভের অস্তরাগে তোমাদের সিডনির বিকেলকে রঙিন করার অনেক আগেই আমরা ফ্লাডলাইট জ্বেলে দিতে পারি৷ সেই মাস্তানিটা শেবাগের মতো। বেপরোয়া। দক্ষিণ আফ্রিকায় সেঞ্চুরি, ঠিক আগের নিউজিল্যান্ড সফরে একমাত্র ভারতীয় হিসেবে সেঞ্চুরি, আর অস্ট্রেলিয়ায় এসে মেলবোর্ণ আর সিডনিতে লি-গিলেসপিকে পিটিয়ে একটা প্রায় ডবল সেঞ্চুরি আর একটা ৭২!
গ্রেগ আর ইয়ান চ্যাপেল ব্যাপারটা নিয়ে যতই নাক সিঁটকাক, পা নড়ে না বলুক, কুছ পরোয়া নেহি, বীরু ছিল-আছে-থাকবে!
দরকারে সৌরভ পারলে এমসিসি ক্রিকেটবুকটাই ফেলে দেন ছুঁড়ে। এক হাতে তুলে নেন ব্রিয়ারলির ক্যাপ্টেন্সির বাইবেল। পন্টিং আর স্টিভ মাথা চুলকেও বুঝতে পারলেন না অজিত আগারকারের ধাঁ ধাঁ টা। অ্যাডিলেডে স্লোয়ার ইনসুইং ফেলে ফেলে লোকটা ৬ উইকেট নিয়ে বেড়িয়ে গেল। দ্রাবিড়ের মাথায় দুটো বাউন্সার আছড়ানোর পরেও কানে গ্লাভস বুলিয়ে একটা ডাবল সেঞ্চুরি মেরে শান্ত পায়ে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন। এসব দেখে স্লিপের পাশ থেকে ক্যাটিচ চোখ টিপছেন৷ স্লেজ ছাড়া ফার্স্ট সেশন? নৈব নৈব চ!
সৌরভ বলে দিলেন, পাত্তা দিও না। পান্টার আর মার্টিন, সুযোগ এলেই হেইডেন- পার্থিবকে টার্গেট করছে। লি ফিরেই শুরু করলেন আগুনের গোলা। ‘কানের পাশে চিন মিউজিক শোনাবো’- সৌরভ যেন বলছেন- ‘চিন মিউজিক দেখেছ বন্ধু, নিধুবাবুর টপ্পা তো শোনো নি…’
সচিনকে খোঁটা মারছে – যেন স্টিভের ক্রিকেট সমাধির পাশে তুমিও ভারী এম আর এফ-টা রেখে দাও। তাঁকে চাপটা ফেস করতে হচ্ছে ত্রিমুখী, রান পেতে হবে, গাভাস্কারের রেকর্ড নিয়ে একটা অদৃশ্য লড়াই- আর কবে? সেই ছাই থেকে ফিনিক্স হয়ে ২৪১!
ভারত অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে মাস্তানি করল ঐ প্রথম। গ্যাবায় সৌরভ, অ্যাডিলেডে দ্রাবিড়, মেলবোর্নে বীরু আর সিডনিতে শচীন। ব্যাকড্রপে লক্ষ্মণ থেকে আগারকার, সিডনির কুম্বলে- সাজানো নবাবের যুদ্ধক্ষেত্রে মিরজাফর স্টিভ বাকনার। অজি পূণ্যভূমিতে ব্র্যাডম্যানের মুখের গ্রাস কেড়ে দেশে ফিরতে দিল না লোকটা৷ অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম এত সক্রিয় আগে হয়নি। ভারতের শেষ তিনটে অজি সফরের পর বেচারারা ভাবেনি ভারতে এমন পালটা দেবে।
ঐ শুরু৷ সিরিজটা জেতা হল না। কিন্তু জেতার বীজটা পোঁতা হয়ে গেল। বিরাট বোর্ডার-গাভাস্কার তুললেন গতবার। চেতেশ্বর পূজারা সেই লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার শেষ পীঠস্থানের মতো টেস্ট ব্যাটিং স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ালেন। রাহানে দুটো ঝকঝকে ইনিংস খেলে গেলেন। এবার লড়াই আরও কঠিন। স্মিথ-লাবুশেনের সাথে ত্রিমুখী পেস আক্রমণ, লিঁওর ভেলকি – তবে স্লেজিং নেই। আ কাম এন্ড কম্পোজড টেস্ট ম্যাচ। সেই ‘গুঁড়িয়ে দেবো’র ঔদ্ধত্য শুষে নিয়েছে কোকাবুরা। তবু উইলো কাঠের গন্ধ, টেস্ট ক্রিকেট আর ব্র্যাডম্যানের দেশে পা রাখার যে ত্রিমুখী রোমাঞ্চ- সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। আ বিট অফ ওয়ার্মথ, উষ্ণ লড়াই, গোলাপের যুদ্ধ!
রঙিন পৃথিবীর শেষ আস্তানা চিরকাল ধূসর, সাদাকালো, পূজারা আর দ্রাবিড়ের মতো শান্ত সেই মোহানার ধার, সবুজের ওপর লালবল আর শুইয়ে রাখা ব্যাট- রণাঙ্গনের গোলা-বারুদ যেখান থেকে ক্রিকেট রোম্যান্টিসিজমের শুরু, যেখানেই রোম্যান্টিসিজম শেষ!