ইংল্যান্ড ভারতীয়দের প্রিয় দল হওয়ার কথা নয়। ইংরেজরা কোন কাজ করলে আমাদের ডিফল্ট প্রতিক্রিয়া সাধারণত তার বিরুদ্ধে যাবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবুও ওদের টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি অ্যাপ্রচের ভারতের ক্রিকেট প্রেমীদের প্রতিক্রিয়া দেখে দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত, কিছুটা কৌতুক বোধ করছি।
বাজবল – এই নামটার জন্মের ইতিহাস সঠিক না জানলেও (ইংল্যান্ডের কোচ ম্যাককালামের ডাকনাম ‘বাজ’ – এবং এই দর্শনের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছেন বলেই সম্ভবত এই নাম) যতটুকু বুঝলাম এটা স্রেফ ব্যাট হাতে দুমদাম পেটানো নয়, বরং একটা নতুন ক্রিকেট দর্শন।
এই দর্শনের কয়েকটি মুখ্য সিদ্ধান্ত হচ্ছে – পশ্চাতাপ না করা, সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, কোনভাবেই ড্র-এর উদ্দেশ্যে না খেলা, অসাফল্যের চিন্তা না করা এবং খেলাটাকে উপভোগ করা। একজন সাধারন দর্শক ও ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে এই দর্শন আমি মনে প্রানে সমর্থন করি।
এতদিন যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট উপভোগ করতাম তা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ক্রিকেটার খেলতেন বা খেলেন, এখন একটা পুরো দল সেই ক্রিকেট সব ম্যাচে খেলবে – এই খবরে খুশি না হয়ে পারা যায়? এ যেন সেহওয়াগ, গিল্ক্রিস্ট, ভিভ, লারা, কপিল, বোথাম, পান্তদের নিয়ে তৈরি একটা দল, নয় তারা বিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিয়ে জিতবে, অথবা সেই চেষ্টায় পরাজয় বরন করবে।
কিন্তু এই ধরনের খেলায় ক্রিকেটীয় যুক্তি কী? আমার মনে হয় যুক্তি বেশ জোরালো। টেস্টের তুলনায় একদিনের এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্যে সম্পূর্ণ অন্য মানসিকতা ও টেকনিক প্রয়োজন – এই কথা বহুল প্রচলিত। কিন্তু সবাই এই এডজাস্টমেন্ট সহজে করতে পারেন না।
এর ফলে প্রায়ই দেখা যায় একটা ফরম্যাটে কোন ক্রিকেটার ঠিকঠাক খেলছে কিন্তু অন্যটায় সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারছে না। উদাহরণ হিসেবে বিরাট এবং সূর্যের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু যদি এই এডজাস্টমেন্টের প্রয়োজন না থাকে? অর্থাৎ, যদি টি-টোয়েন্টি এবং একদিনের ক্রিকেটের আক্রমণাত্মক ব্যাটিঙের মনোভাব যদি টেস্ট ক্রিকেটেও ক্যারি করা হয়? সম্ভবত এই চিন্তা থেকেই বাজবল নামের পরীক্ষার উৎপত্তি। এবং সেই পরীক্ষায় ইংল্যান্ড এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট সফল।
কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রায় একই ধরনের উইকেটে ৫০ ওভারে একটা দল অনায়াসে ৩০০ রান করে ফেলছে অথচ টেস্ট খেলতে গেলে সেই একই উইকেটে ২০০ করতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। দেখে আমার প্রায়ই মনে হত, টেস্টেও একদিনের মত ব্যাট করলে তো পারে দলগুলো।
সমস্যা উইকেট বা টেকনিকের চেয়েও মানসিকতায় বেশি – আমাদের মস্তিষ্কে ড্রিল করে বারবার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে টেস্টের ব্যাটিং মানে প্রথম দুই ঘণ্টা বোলারদের দাও, পরের সময়টুকু তোমার হবে। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে এই মনোভাবে সুইচ করা সহজ নয়।
বিরাটকে টেস্টে স্ট্রাগল করতে দেখে আমার বারবার মনে হয়েছে একদিনের বা টি-টোয়েন্টির মেজাজে ব্যাট করলে ফর্মে ফিরতে অসুবিধে হবে না বিরাটের। আমি নিশ্চিত, এই ধরনের কথা আরও অনেকেরই মনে হয়েছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সানি কিন্তু ফর্মে ফেরার জন্যে এই পথেই হেঁটেছিলেন। তবু আজও সবার কাছে ফর্মে ফেরার জন্যে সচিনের ২৪১ বেশি গ্রহণযোগ্য টেমপ্লেট।
এছাড়াও ক্রিকেটের একটা বানিজ্যিক দিক আছে। টেস্ট ম্যাচ যদি পরপর ড্র হয় তাহলে কিন্তু তার অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সচিন সহ অনেকেই প্রত্যেক ইনিংসে ওভার বেঁধে দেওয়ার সাজেশান দিয়েছেন যাতে ফলাফল নিশ্চিত করা যায়। ড্র-এর জন্যে খেলা – এই ক্রিকেট দর্শন আজকের যুগে নিতান্তই অচল।
আজকে হয়ত অনেকে ৮০’র দশকের ড্র ম্যাচগুলোতে রোমান্স খুঁজে পান কিন্তু সাধারন ক্রিকেট দর্শক তখনও তা দেখে যথেষ্টই বিরক্ত হত। সানির বিরুদ্ধে ইডেনে বিক্ষোভ বা বিভিন্ন ক্রিকেট মাঠে ‘রবি শাস্ত্রী হায়-হায়’ স্লোগান সেই বিরক্তিরই প্রকাশ। তুলনায় শ্রীকান্ত বা কপিলের উইকেট ছুঁড়ে আসা অনেক বেশি প্রশ্রয়ের চোখে দেখতেন সাধারন মানুষ (বোদ্ধাদের কথা আলাদা)।
অনেকের ধারণা ভারতের পিচে ইংল্যান্ড এই ক্রিকেট খেলতে সমর্থ হবে না। হতেও পারে। স্লো, ধুলোভর্তি পিচে স্ট্রোক খেলা সহজ নয়। আমি কিন্তু চাইব এখানেও ইংল্যান্ডের এই ক্রিকেট সাফল্য পাক। কারণ ভারতের জয়ের চেয়েও ক্রিকেটের এই বিবর্তন বেশি প্রয়োজনীয়। এবং ক্রিকেটপ্রেমী হিসবে দেশপ্রেমের ঊর্ধ্বে উঠতে আমি সবসময়ই রাজি।