বেনজেমা চাইলে চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ গানটা উচ্চস্বরে গাইতেই পারেন।
কে জানে ফ্রেঞ্চ বা স্প্যানিশে এমন কোনো গান থাকলে হয়তো এখন গাইছেন। গানটা যে এখন বেনজেমার জন্যই। ৫ বছর পর ফ্রেঞ্চ দলে ফেরত আসা ‘হিরো’স রিটার্ন’-এর থেকে কম কিছু নয়।
তিনদিন আগেও যদি কেউ বলতেন এই বছরের ইউরোতে ফ্রান্স দলের লিড স্ট্রাইকার হবেন করিম বেনজেমা, তবে যে কেউ হেসে উড়িয়ে দিতো। বেনজেমার ফ্রেঞ্চ দলের ঢুকবার সকল রাস্তা ততদিন ছিল বন্ধ। ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেনি যে ফ্রেঞ্চ জার্সিতে আবার তাকে দেখা যাবে। অন্তত দেশম থাকাকালীন সময়ে তো নয়ই।
বেনজেমাও যেনতেন কেউ নয়, ফ্রেঞ্চ ইতিহাসে থিয়েরি অঁরির পর বেনজেমার মতন ভয়ানক স্ট্রাইকারের আবির্ভাব হয়নি। জিনেদিন জিদানের অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের পর যখন ফ্রেঞ্চ দলের দরকার ছিল সামনে থেকে একজনের লিড করার, সেখানে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন অঁরি।
বিশ্বকাপ ইউরো মিলে মাত্র ২ পয়েন্ট এনে দিয়েছিলেন তিনি। তাই ২০১২ ইউরোতে যখন ফ্রান্সের স্ট্রাইক ফোর্সের দায়িত্ব পড়লো বেনজেমার উপর, তখন থেকেই চিত্র পাল্টাতে শুরু করলো বলে। আগের বার মাত্র এক পয়েন্ট নিয়ে শেষ করা ফ্রান্স কাটালো গ্রুপ পর্বের বাঁধা। আর সেখান থেকেই শুরু হলো ভ্যালবুয়েনা আর বেনজেমার বন্ধুত্ব!
২০১৪ বিশ্বকাপ ছিল বেনজেমার প্রমাণ করার মৌসুম। জাতীয় দলে বেনজেমা কতটা জাত খেলোয়াড় তার প্রমাণ ছিল বিশ্বকাপের মঞ্চ। কোয়াটার ফাইনালে চ্যাম্পিয়নস জার্মানির কাছে বাদ হওয়ার আগ পর্যন্ত বেনজেমাই ছিলেন ফ্রান্সের মূল চালিকা শক্তি। বিশ্বকাপ মঞ্চে করেছিলেন ৩ গোল!
ততদিন পর্যন্ত সকল কিছু ঠিকই চলছিল। নিজেদের পরিপূর্ণ দল হিসেবে গড়ে তুলছিল ফ্রান্স, দিদিয়ের দেশমের অধীনে প্রত্যেকেই নিজেদের জায়গা খুঁজে পেয়েছিল যেন। তরুণ দলের নেতা হয়ে উঠছিলেন করিম বেনজেমা নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নিয়ে।
কিন্তু সেসময়ই এক উড়ো খবর এসে জুটলো বেনজেমার গায়ে। সময়টা ২০১৫, নভেম্বর মাস। ফ্রান্স তখনও পরের ইউরোর জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় অভিযোগ আনলেন বেনজেমার ফ্রেঞ্চ দলের সতীর্থ ম্যাথিউ ভ্যালবুয়েনা। ভ্যালবুয়েনার দাবি, করিম বেনজেমা তাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন।
তাঁর ভাষ্য মতে করিম বেনজেমা ও ফ্র্যাঙ্ক রিবেরি মিলে তার কাছে মোট ১০ হাজার ইউরো দাবি করেছেন। নইলে তার এবং তার স্ত্রীর আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও-টেপ ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবেন। আর এই অর্থ সরাসরি তাদের না দিয়ে তাদের ছোট বেলার বন্ধু করিম জেনাত্তির কাছে দিতে হবে।ভ্যালবুয়েনার এই দাবিতে যেন ফুঁসে উঠল ফ্রেঞ্চ জনতা। বলা বাহুল্য সে সময় বেনজেমার কাছাকাছি পর্যায়ে জনপ্রিয়তা ছিল তার। মাঠের ভেতরে বাইরে বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল তাদের। কিছ কিছু ক্ষেত্রে ভ্যালবুয়েনা জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বেনজেমাকে। হাজার হলেও শরণার্থী হিসেবেই এই ফ্রান্সে আগমন বেনজেমার। ফলে কোপটা পরলো এই দুজনের উপরেই। দেশম নিজেই নির্দেশ দিলেন দু’জনকে দলের বাইরে রাখার। শুরু হলো বেনজেমার নির্বাসন!
নির্বাসনটা সোজা ছিল না বেনজেমার জন্য। রিয়ালের একপক্ষ বেনজেমাকে একই দাবিতে বিক্রি করে দেওয়ার কথাও বলেছিল। কথা উঠেছিল তাকে রিপ্লেস করার । ঝড়টা গিয়েছে ফর্মের উপর দিয়ে। ২০১৭ তে এসে পুরো লিগ মৌসুম শেষ করেছেন ৫ গোল নিয়ে। পুরো মৌসুমে মাত্র ১৩ গোল।
দলে অবদান নিয়ে বিন্দুমাত্র কথা নেই, কিন্তু গোল মুখে আসলেই যেন নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছিলেন না বেনজেমা। জিনেদিন জিদান নিজের শিষ্যর উপর থেকে হাল ছাড়েননি। দু’জনেই একই পথের দিশারী। আলজেরিয়া থেকে পালিয়ে এসে ফ্রান্সে নিজেদের জীবন গড়েছেন। শিষ্যের কষ্ট বুঝেছিলেন জিদান, তাই একটু বেশিই চোখে চোখে রাখতেন তাকে। এ নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। বেনজেমা সেই বিশ্বাসের প্রমাণ দিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে গোলে করে।
অন্যদিকে ফ্রান্সও এগিয়ে যাচ্ছিল বেনজেমাকে ছাড়াই। বেনজেমার কপি-পেস্ট হয়ে দলে প্রবেশ করেছিলেন অলিভিয়ের জিরু। তাকে মূল স্ট্রাইকার বানিয়ে কোনো গোল, শট অন টার্গেট ছাড়াই বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিলেন দিদিয়ের দেশম। এমবাপ্পে, গ্রিজম্যান, ডেম্বেলেদের ভিড়ে বেনজেমাকে সেদিন কারো মনেই পড়েনি।
তবে বেনজেমা ছিলেন নিজের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত, তার সকল ধ্যান-জ্ঞ্যান ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। রোনালদোর শূণ্যস্থানের জন্য এতদিন ধরে তৈরি করা গ্যারেথ বেল ফুটবলে মন হারিয়েছেন, ফলাফল? বেনজেমাকে হাল ধরতে হলো ট্রাঞ্জিশনে থাকা রোনালদোহীন রিয়ালের। বেনজেমা হাল ছাড়েননি। ম্যাচের মাঝে হাতের আঙ্গুলে চিড় ধরেছে, অপারেশন করাননি বসে থাকতে হবে বলে।
সেই বামহাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে এখনও খেলে যাচ্ছেন তিনি, এই হাত আর কখনও ঠিক হবে না। আর দুই মৌসুমের মাথায় সেই ব্যান্ডেজই হয়ে উঠেছে রিয়ালের আইকন। রিয়াল মাদ্রিদ মহিলা দলের স্ট্রাইকার কোসাভ্রে আসলিনি প্রতি ম্যাচে নামেন হাতে সাদা ব্যান্ডেজ প্যাচিয়ে।
দুই মৌসুমের মাথায় রিয়ালের ভরসার পাত্র করিম বেনজেমা। যে বেনজেমাকে বিক্রির জন্য প্রতি ম্যাচ শেষ রব তুলতো সমর্থকেরা, সেই বেনজেমা আর ভরসার পাত্র। মাঠে থাকা মানেই গোলের আশা করা। রিয়ালের টানা দ্বিতীয় লিগ জয়ের কারিগর হতে যাচ্ছেন তিনি।
অন্যদিকে তিন বছর আগে বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্সকে নিয়েও খুব একটা আশা করা যাচ্ছে না এবার। এই দলে স্টারের অভাব নেই বটে, কিন্তু ইতিহাস ঘাটলেই বোঝা যায়, বিশ্বকাপ থেকে আরেক বিশ্বকাপে ট্রাঞ্জিশন না করলে মূল্য চুকাতে হয় দলকে। ২০০৬ এর বিশ্বজয়ী ইতালি থেকে ২০১০ এর ভঙ্গুর। ২০১০ এর বিশ্বজয়ী স্পেন থেকে ২০১৪ র ভগ্নদশা স্পেন।
আর ২০১৪ সালে জার্মানি থেকে ২০১৮’র জার্মানি। দলে পরিবর্তন না আনার ফলাফল উচ্চমূল্যে দিতে হয়েছে অনেক দলকে। দিদিয়ের দেশম সেটা চাচ্ছেন না। আর ফ্রান্সের এই দল নিয়ে আরো সাফল্য না আনতে পারলে চাকরিটা হারাতে হতে পারে একসময়ের সতীর্থ জিদানের কাছে!
তাই দেশম মুখগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছেন। খুব একটা ভালো মৌসুম যায়নি গ্রিজম্যান, ডেম্বেলের। এমবাপ্পেও বেশ অনেকটা সময় চোটে কাটিয়েছেন, ফ্রেঞ্চ লিগ জমজমাট হলেও তার খেলায় তেমন ছাপ পরেনি বিশেষ। অন্যদিকে সব দলের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে গিয়েছেন বেনজেমা, ফলাফলটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু সে বাঁধা পেরোতে হলে পার করা লাগতো দেশমের পাহাড়সমান ইগো।
বছর কয়েক আগে ফ্রেঞ্চ সাংবাদিক বেশ ঘটা করে লিখেছিলেন, বেনজেমার ন্যাশনাল ক্যারিয়ার শেষ। তার জবাবে বেনজেমাও বলেছিলেন, ‘আমার ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার আমি বুঝে নিবো। তোমার এত কথা বলতে হবে না। সময় আসলে দেখা যাবে কে ভুল আর কে ঠিক।’
দিদিয়ের দেশম প্রকাশ্যে বেনজেমার সমালোচনা করেছেন, বলেছেন জাতীয় দলে তার রাস্তা বন্ধ। সেই বেনজেমা দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরেছেন। এতটাই প্রতাপের সাথে ফিরছেন যে কোচ নিজে বলেছেন, ‘বেনজেমা ফিরছে বেঞ্চে বসে থাকার জন্য নয়।’
ফিরতে না ফিরতেই অভিবাদন পেয়েছেন এমবাপ্পের কাছ থেকে। থিয়েরি অঁরি, আর্সেন ওয়েঙ্গাররা তো সেই কবে থেকেই তাকে দলে ফেরাতে উৎসুক।
বেনজেমার আনন্দ সবচেয়ে বেশি তার সন্তানদের জন্য। তার দুই সন্তানের বুঝ হওয়ার পর থেকে তাদের বাবাকে দেখে এসেছে ফ্রেঞ্চ মানুষজনের শত্রু হিসেবে। সেই দলে ভালোবাসার সাথে ফেরার মতন আনন্দ কীই বা হতে পারে?