বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে স্মরণীয় জয়

তবে এই জয়টা থাকবে। জয়ের মতো জয় হয়ে থাকবে। ইতিহাসটা থাকবে। মুমিনুল হকের দল টেস্টের চ্যাম্পিয়নদের তাদের দেশে গিয়ে হারিয়েছে, এই গৌরবটা থাকবে। বিশ্ব ক্রিকেটেও বাংলাদেশের একটু সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে, বহুদিন পর। আর এই দলটা, দু:সময়ের চক্রে থাকা দলটা একটু আত্মবিশ্বাসের রসদ পাবে। হাঁসফাঁস করতে থাকা দলটা একটু অক্সিজেনের স্বাদ পাবে।

টেস্ট জয় বা ড্র করা বহুদূর, নিউ জিল্যান্ডে গিয়ে এবার বাংলাদেশ লড়াই-টড়াই কিছু করতে পারবে, এরকম ভাবার লোকও খুব একটা ছিল না।

বাংলাদেশ ২১ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলছে, একটি জয় সেখানে সাধারণ ঘটনাই হওয়ার কথা। কিন্তু যাবতীয় বাস্তবতা বলবে, ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিস্ময়গুলোর একটি উপহার দিয়েছে মুমিনুল হকের দল।

এই নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাঠে হারানো ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলির একটি। দেশের মাঠে তারা সবশেষ ছয় টেস্ট জিতেছে টানা। সবকটিই বিশাল ব্যবধানে। পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত সেখানে গিয়ে সিরিজে হোয়াইটওয়াশড হয়ে ফিরেছে।

এই সিরিজের আগে দেশের মাঠে টানা ১৭ টেস্টে হারেনি নিউজিল্যান্ড। সবশেষ ২৩ টেস্টে হার স্রেফ একটি। উপমহাদেশের দেশগুলোর খতিয়ান দেব? পাকিস্তান এখানে সবশেষ জিতেছে ২০১১ সালে। ভারত সবশেষ জিতেছে ২০০৯ সালে। শ্রীলঙ্কা সবশেষ জিতেছে ২০০৬ সালে। এবং বাংলাদেশ, দ্বিপাক্ষিক সিরিজে কোনো সংস্করণেই কখনও কোনো ম্যাচ জেতেনি এখানে।

সেই অধরা ভুবনেই ধরা দিল একটি টেস্ট জয়। ব্লাডি টেস্ট ভিক্টরি ইন নিউজিল্যান্ড! সেই জয়টাও কোন সময়ে?

দেশের ক্রিকেটে যখন চরম দুর্দশা, মাঠের ভেতরে-বাইরে নানা বিতর্ক, সফরে নেই সাকিব-তামিমের মতো অভিজ্ঞ দুজন, অনভিজ্ঞ টপ অর্ডার এবং নিউ জিল্যান্ড যখন আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন, মানে টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এসব বিরুদ্ধ প্রেক্ষাপট, এই প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতা, এরকম কঠিন বাস্তবতা, সবকিছুর মিলিয়েই সবসময়ের সেরা জয় এটি।

ম্যাচ জুড়ে যেভাবে খেলেছে বাংলাদেশ, প্রথম দিন অনেক পেছনে পড়েও শেষ বিকেলে ফিরে আসা, বল বাই বল আর সেশন বাই সেশন খেলা, ওল্ড ফ্যাশন ঘরানার আশ্রয়ে খেলাটাকে গভীরে টেনে নেওয়া, প্রয়োজনের সময় জুটি গড়া, ধৈর্য ধরে উইকেট নেওয়া, শেষ দিনেও ক্লিনিক্যাল বোলিং, এমনকি বদলি নেমে তাইজুলের দুর্দান্ত ক্যাচ, সব মিলিয়ে ম্যাচের নানা বাঁকে যেভাবে নিজেদের মেলে ধরে এই সাফল্য এসেছে, সেসব কারণেও এই জয়টা স্পেশাল।

না, রূপকথার এই জয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের রূপ বদলাবে না। একটি জয়ে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের পরাশক্তি হয়ে উঠবে না। সত্যি বলতে, কোনো শক্তিই হয়ে উঠবে না হয়তো। দেশের ক্রিকেটের অবকাঠামো শক্তিশালী হবে না, বছরজুড়ে সারা দেশে অনুশীলনের সুবিধা বাড়বে না, শীর্ষ ৩০-৩৫ ক্রিকেটারের বাইরে অন্যদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসবে না, আঞ্চলিক ক্রিকেট কাঠামো আলোয় আসবে না, ভালো মানের কোনো একাডেমি গড়ে উঠবে না, বোর্ড সভাপতি হামবড়া কথা বাদ দিয়ে ক্রিকেটের ভিত ও অবকাঠামো উন্নয়নে এবং দূরদর্শী পরিকল্পনায় মন দেবেন না, এত এত বছর পরও দেশের ক্রিকেটের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না। হবে না। হবে না। হবে না।

শুধু জাতীয় দল নিয়ে পড়ে থাকলে যে দেশের ক্রিকেট বলে কিছু থাকে না, দেশের ক্রিকেটের ভিত শক্ত না করলে যে জাতীয় দল কখনোই শক্তিশালি হয় না, এই বোর্ড তা জানে না। বা জেনেও করে না। আগের কোনো বোর্ড করেনি। এই বোর্ড টানা ৯ বছরেও সেসব করেনি। সামনে করার আশাও দেখি না। কাজেই দেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক চিত্র বদলাবে না। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে টেস্টে মাঝারি মানের শক্তিও হতে পারবে না।

তবে এই জয়টা থাকবে। জয়ের মতো জয় হয়ে থাকবে। ইতিহাসটা থাকবে। মুমিনুল হকের দল টেস্টের চ্যাম্পিয়নদের তাদের দেশে গিয়ে হারিয়েছে, এই গৌরবটা থাকবে। বিশ্ব ক্রিকেটেও বাংলাদেশের একটু সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে, বহুদিন পর। আর এই দলটা, দু:সময়ের চক্রে থাকা দলটা একটু আত্মবিশ্বাসের রসদ পাবে। হাঁসফাঁস করতে থাকা দলটা একটু অক্সিজেনের স্বাদ পাবে।

খুব, খুব ভালো লাগছে মুমিনুল হকের জন্য। টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি তার আবেগ তীব্র। ভালোবাসা প্রচণ্ড। দলের ওপর তার বিশ্বাসও গভীর। সেটা শুধু অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বাসের খাতিরে বিশ্বাস নয়, মন থেকেই। বরাবরই। তার অনেক সমালোচনা হয়েছে। হয়। সেসব সঙ্গত কারণেই। সমালোচনার মতো অনেক কিছুই হয়েছে। তবে তার বাস্তবতাও তো সহজ ছিল না।

তিনি সহজাত অধিনায়ক নন। অধিনায়কত্ব যখন পেয়েছেন, তখন আসলে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল হুট করে। তিনি সহজাত নেতা নন। পরিস্থিতির কারণে ঠেকে শিখছেন। তিনি সহজাত বক্তাও নন। কিছুদিন আগেও যে কোনো প্রশ্নে ছোট্ট দু-এক লাইনে নির্লিপ্ত জবাব দিতেন। অধিনায়ক হয়ে নানা কিছু বলতে গিয়ে অযৌক্তিক, হাস্যকর অনেক কিছু মাঝেমধ্যেই বলে ফেলেছেন। সমালোচনা করেছি আমরা। সবই ঠিক, তাকে কথা বলাও শিখতে হচ্ছে।

সেসব শেখার জন্য দেশের ক্রিকেটের পরিস্থিতি আদর্শ নয়। সিস্টেম আদর্শ নয়। অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে সম্ভাব্য সেরা দলটাকেও কমই পেয়েছেন তিনি। তাকে শিখতে হচ্ছে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে। তাকে দাঁড়াতে হচ্ছে অনেক হোঁচট খেয়ে। তাকে এগোতে হচ্ছে অনেক লড়াই করে। আশা করি, এই জয়ে তিনি আরও পরিণত হবেন, আরও কতৃত্ব পাবেন ও নেবেন, আরও আত্মবিশ্বাসী হবেন।

এই জয়ের সবচেয়ে বড় ব্যাপার, একজন-দুজনের অসাধারণ নৈপুণ্যে নয়, বেশ কজনের সম্মিলিত পারফরম্যান্সে এসেছে এই জয়। আশা করি, মুমিনুল হকের দল আস্তে আস্তে টিম বাংলাদেশ হয়ে উঠবে।

আবারও বলছি, দেশের ক্রিকেটের মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না এই জয়ে। তবে আমরা যারা ক্রিকেট নামক খেলাটাকে ভালোবাসি, শতবার পদদলিত হয়েও মাথাটা তুলে মাঠে উঁকি দেই, বারবার ধাক্কা খেয়েও সম্মোহিতের মতো এগিয়ে যেতে চাই, তাদেরকে অবিশ্বাস্য ভালো লাগার এক অনুভূতি উপহার দিয়েছে এই জয়।

দলের সবার জন্য ভালোবাসা।

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...