এক সত্যিকারের মহারাজা

সমাপতনের আলো বড় অদ্ভুত হয়। ১৯৯২ সালে সত্যজিৎ যখন অনারারি অস্কার বুকে আগলে ধরছেন, যখন বাঙালিকে বিশ্বদর্শন করানো চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে কালের নিয়মে ঠিক সেই সময় ২৩ বছরের এক ছেলে লড়ছেন তাঁর দেশের ব্যাটন রক্ষা করতে। কীসের ব্যাটন?

এর উত্তরে সংখ্যাটা এক থেকে বেড়ে বেড়ে পৌঁছে যায় ১৬ তে। লাগাতার টেস্ট সিরিজ জয়ের সংখ্যা। লয়েডীয় পৃথিবীর শেষ আলো যখন রিচার্ডসনের হাতে পড়ে প্রায় নিভন্ত,ক্রিকেট দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় শক্তির হস্তান্তর অবশ্যম্ভাবী, ওয়াঘ-ওয়ার্ণের দাপটে ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে মাথা চাড়া দিতে চাইছে ক্যাঙারুর দেশ তখন ক্যারিবিয়ান দূর্গের শেষ এম আর এফ ব্যাটটার কাছে এসে থমকে যাচ্ছে সমস্ত লড়াই- কে এই লারা?

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সান্তা ক্রুজ ভ্যালির সবুজ বাদাম গাছের বনের এক ছোট্ট শহরে জন্মানো এক বিস্ময় যিনি নব্বই-এর দশকে হয়ে উঠছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায়- ‘মাইকেল জর্ডান অফ ক্রিকেট’!

ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে যিনি ২৫ বছর বয়সে ডারহ্যামকে পিটিয়ে তুলে ফেলছেন ৫০১ রান যা আজও বিশ্বরেকর্ড,যিনি টেস্টে ২০০৪ সালে এক ইনিংসে তুললেন ৪০০ রান যা অটুট প্রায় দু যুগ পরেও, যিনি অনায়াসে সিডনির মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকে নিয়ে ছেলেখেলা করে তুলছেন ২৭৭ রান আর সিডনির ক্রিকেট গালিচার প্রেমিক হয়ে নিজের মেয়ের নাম রেখে দেন সিডনি- কিন্তু ব্রায়ান লারার আসল সংজ্ঞা কি এখানে আছে আদৌ?

আমার কাছে ব্রায়ান লারা সেই ক্যারিবিয়ান দস্যু, সেই সত্যজিতের দুর্ধর্ষ ভিনগ্রহের প্রাণী যিনি নব্বই-এর দশকে বেপরোয়া হয়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়া বা পাকিস্তানকে মৌনতা দিয়ে যেন বুঝিয়ে দিতেন, ‘যতই লম্ফঝম্প করো, আমি তোমাদের দেখিয়ে দেব ক্রিকেটের আসল রাজা কে!’

প্রিন্সের উপাধি তাঁর মুকুটে এসেছে অনেক পরে, তার আগেই সিডনিতে ডাবল সেঞ্চুরি করে তিনি বাঁচাচ্ছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, ৯৮-৯৯ তে ঐতিহাসিক সে ইনিংস ১৫৩ রানের যাকে উইসডেন টেস্ট র‍্যাংকিং ব্র‍্যাডম্যানের ২৭০-এর পরেই স্থান দিয়েছে, একটার পর একটা ম্যাচ উইনিং ইনিংস নিঃশব্দে খেলে গেছেন লারা – আর ভিভ-লয়েডের মতো গোলা-বারুদ ছাড়াই প্রায় একা কুম্ভে লড়ে ঐ ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জের দেশটাকে টিকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন একনম্বরে, একটা দীর্ঘ দীর্ঘ সময় এই লড়াই করতে করতে তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের শৈশবের সুপারস্টার!

এম আর এফ-এর শচিনত্বে আমরা একমাত্র ভাগীদার করতে পারি ব্রায়ান চার্লস লারাকে, এ আমাদের শৈশবের অলিখিত নিয়ম। আজ কে যেন লিখেছেন ১৯৬৯ সালে সত্যজিৎ যখন সিনেমায় গুপীকে দিয়ে বলাচ্ছেন ‘মহারাজা তোমারে সেলাম’ তখন হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে জন্ম নিচ্ছে এক সত্যিকারের মহারাজ!

এ হৃদয়পুরমাঝে তোমার আগমন তো রাজার মতোই লারা, আজ সত্যজিৎ রায়ের জাদুর জগতে কোনো অন্ধকার দ্বীপের হীরের টুকরোর মতো জ্যোতি ছিটকে আসছে সেই এম আর এফ- ব্যাট থেকে, গুপী-বাঘার যেমন ম্যাজিক জুতো, যেমন ফেলুদার মগজাস্ত্র, যেমন অপুর স্বপ্ন দেখা চোখ তেমনি সত্যজিতীয় দুনিয়ায় তুমি চুপি চুপি তোমার ব্রহ্মাস্ত্র, একটা উইলো কাঠের যন্ত্র হাতে এসে দাঁড়িয়েছিলে অনেকদিন,আমরা হয়ত লক্ষ্য করিনি কেউ।

ঐ যে সমাপতনের আলো বড় অদ্ভুত হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link