শচীন নাকি লারা, কে সেরা?

কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে এই দুই মহান ব্যাটসম্যানকে আলাদা করা সম্ভব না। লারা ছিলেন ক্রিকেটের ঈশ্বরপ্রদত্ত এক প্রতিভা, অন্যদিকে, শচীন তাঁর আত্ননিবেদন আর একাগ্রতা দিয়ে স্থান করে নিয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীদের মণিকোঠায়। 

সর্বকালের সেরার প্রশ্নটা সব সময়ই ঘোলাটে। ভিন্ন যুগে, ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন মানসিকতার দুজন ক্রিকেটারের সাথে তুলনা করা বরারবই দু:সাধ্য। তবে একই সময়ে খেলা দুজন ব্যাটসম্যান কিংবা বোলারের মাঝে তুলনা করা সম্ভব। 

একই সময়ে খেলা এমন দুজন ব্যাটসম্যান হলেন ভারতের শচীন টেন্ডুলকার এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা। ক্যারিয়ারে যখনই একে অন্যের মুখোমুখি হয়েছেন প্রতিবারই উঠে এসেছে দুজনের মধ্যকার সেরার বিতর্ক। আসুন দেখে নেয়া যাক, পরিসংখ্যানের বিচারে কে সেরা – ক্রিকেট ঈশ্বর নাকি ক্রিকেটের রাজপুত্র। 

প্রথমেই আসা যাক, রাজকীয় ফরম্যাট টেস্টের প্রসঙ্গে। ১৩১ টেস্টে ৩৪ শতক আর ৪৮ অর্ধ-শতকে ৫২.৮৮ গড়ে লারার সংগ্রহ ১১৯৫৩ রান। টেস্টের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৪০০ রানের রেকর্ডও তাঁর দখলে। অন্যদিকে, ২০০ টেস্টে মাঠে নেমে ৫১ শতক আর ৬৮ অর্ধ-শতকে ৫৩.৭৮ গড়ে শচীনের সংগ্রহ ১৫৯২১ রান। তবে ভারতীয় এই ব্যাটারের ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ অপরাজিত ২৪৮ রান।   

যদি আরেকটু বিশ্লেষণ করে বিদেশের মাটিতে কেবল শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে তাঁদের পারফরম্যান্স বিচার করি তবে হয়তো আরেকটু স্পষ্ট হওয়া যাবে। সেই সময়ের সেরা দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সমান চারটি করে সেঞ্চুরি আর হাফ-সেঞ্চুরিতে ১৯ ম্যাচে ৪১.৯৭ গড়ে লারার সংগ্রহ ১৪৬৯ রান। অন্যদিকে, ২০ ম্যাচে ছয় সেঞ্চুরি আর সাত হাফ-সেঞ্চুরিতে ৫৩.২০ গড়ে শচীনের সংগ্রহ ১৮০৯ রান। 

নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে  যথাক্রমে ৪০৬, ৮৪১ এবং ১২৬৮ রান করেছেন লারা। এই দলগুলোর বিপক্ষে মোট সাতটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ক্যারিবিয়ান বরপুত্র। অন্যদিকে, শচীন রান করেছেন যথাক্রমে ৮৪২, ১১৬১ এবং ১৫৭৫। এই দলগুলোর বিপক্ষে তাঁর মোট সেঞ্চুরির সংখ্যা ১১টি। এছাড়া পাকিস্তানের বিপক্ষে লারার ৬২৬ রানের বিপরীতে শচীনের সংগ্রহ ৪৮৩ রান। 

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, প্রতিপক্ষের মাঠে লারার তুলনায় শচীন বেশি ধারাবাহিকভাবে রান করেছেন। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই তিনি রানের ধারা বজায় রেখেছেন। তবে বড় ইনিংস খেলার বিচারে আবার লারা এগিয়ে। তাঁর যেখানে নয়টি ডাবল সেঞ্চুরির পাশাপাশি একটি করে ত্রিপল সেঞ্চুরি এবং চারশো রানের ইনিংস আছে, শচীনের সেখানে সর্বোচ্চ ইনিংসই ২৪৮ রানের। ভারতের এই তারকা ব্যাটারের ডাবল-সেঞ্চুরি সংখ্যা ছয়টি।  

অন্যদিকে, সাদা বলের ক্রিকেটে ২৯৯ ওডিয়াইতে ৪০.৪৮ গড়ে লারার সংগ্রহ ১০৪০৫ রান। এই ফরম্যাটে ১৯ সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৬৩ হাফ-সেঞ্চুরি আছে তাঁর। অন্যদিকে, ৪৬৩ ম্যাচে ৪৪.৮৩ গড়ে শচীনের সংগ্রহ ১৮৪২৬ রান। ৪৯ সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৯৬ হাফ-সেঞ্চুরি আছে তাঁর।  

বড় দলগুলোর মাঝে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে চার সেঞ্চুরি আর ১৩ হাফ সেঞ্চুরিতে ৫২ ম্যাচে ৪০.৪৪ গড়ে লারার সংগ্রহ ১৯০১ রান। অন্যদিকে, ৪৭ ম্যাচে এক সেঞ্চুরি আর দশ হাফ- সেঞ্চুরিতে ৫৩.২০ গড়ে শচীনের সংগ্রহ ১৮০৯ রান। এছাড়া ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোনো সেঞ্চুরি না থাকলেও ২৪ ম্যাচে পাঁচ হাফ-সেঞ্চুরিতে লারার সংগ্রহ ৭১৪ রান। অন্যদিকে, ২৬ ম্যাচে তিন সেঞ্চুরি আর চার হাফ-সেঞ্চুরিতে শচীন করেন ১০৫১ রান। 

নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার  বিপক্ষে যথাক্রমে ৪১৩, ৪৬৫ এবং ৭২৯ রান করেছেন লারা। অন্যদিকে, একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে শচীনের সংগ্রহ যথাক্রমে ৮২১, ৪৮০ এবং ১৪৫৩ রান। 

মজার ব্যাপার হলো, ওডিয়াইতে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের লারার রেকর্ড অতিমানবীয় হলেও টেস্টে একই ভেন্যুতে তুলনামূলক ভালো করেছেন শচীন। এছাড়া পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট এবং ওডিয়াই দুই ফরম্যাটেই লারা বেশ এগিয়ে। অন্যদিকে, শচীন ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট এবং ওডিয়াইতে বেশি রান করেছেন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুজনেই প্রায় একই হারে রান করেছেন। 

কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে মাপলেই চলে না। লারা যখন ক্রিকেটটা খেলতে শুরু করেছেন, ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সূর্য তখন অস্তগামী। বেশিরভাগ সময়ে দেখা যেত ক্যারিবীয়দের ব্যাটিং পুরোটাই লারা নির্ভর। প্রতিপক্ষ জানতো কেবল লারাকে থামাতে পারলেই হেরে যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাছাড়া বেশিরভাগ সময়েই দেখা যেত রানের কোটা ৫০ পেরোনোর আগেই তিন কিংবা চার উইকেট পড়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের, তখন পাহাড়সম চাপ নিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে হত লারার। ফলে চাপমুক্ত ব্যাটিং কোনোদিনই সম্ভব হয়নি লারার। 

অন্যদিকে, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই শক্তিশালী ভারতীয় এক ব্যাটিং লাইন আপ পেয়েছেন শচীন। শুরুর থেকেই তাঁর পাশাপাশি ভারতীয় ব্যাটিংয়ে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, বীরেন্দর শেবাগ, ভিভিএস লক্ষণদের মতো ব্যাটসম্যানদের। ফলে ওয়ান ম্যান আর্মির চাপটা কখনো নিতে হয়নি তাঁকে। তবে চাপ যে একেবারেই ছিল না শচীনের সেটা বলার উপায় নেই, ভারতের দেড়শো কোটি জনতার ঈশ্বরের চাপটা কেবলমাত্র তিনিই জানতেন। 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটা শচীনের দখলেই। টেস্ট কিংবা ওডিয়াই কোনো ফরম্যাটেই তাঁর চেয়ে বেশি রান কিংবা সেঞ্চুরি করতে পারেননি কেউই। ২০১২ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১১৪ রানের ইনিংস খেলে একশো সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। যদিও আশ্চর্যজনকভাবে সেই ম্যাচে ভারতের দেয়া ২৯০ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জিতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। 

অন্যদিকে, টেস্টে বেশকিছু ম্যারাথন ইনিংস খেলার রেকর্ড রয়েছে ব্রায়ান লারার। গ্যারি সোবার্সের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ৩৬৫ রানের রেকর্ড ভেঙে ৩৭৫ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন। এরপর অজি ওপেনার ম্যাথু হেইডেন সেই রেকর্ড ভেঙে দিলে লারা পুনরায় ৪০০ রানের ইনিংস খেলে নিজের করে নেন রেকর্ডটা। এছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অপরাজিত ৫০১ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ড তাঁর দখলে। 

কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে এই দুই মহান ব্যাটসম্যানকে আলাদা করা সম্ভব না। লারা ছিলেন ক্রিকেটের ঈশ্বরপ্রদত্ত এক প্রতিভা, অন্যদিকে, শচীন তাঁর আত্মনিবেদন আর একাগ্রতা দিয়ে স্থান করে নিয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীদের মণিকোঠায়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link