বার্নলির বুলেট!

২০০১-০২ কাউন্টি ক্রিকেট মৌসুম। বিখ্যাত ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টি দল একজন ভালো বিদেশি পেসারের খোঁজ করছে। সেই সময় স্থানীয় খেলোয়াড়দের খোঁজখবর রাখেন এমন একজন দলীয় কর্তা জন স্ট‍্যানওর্থের চোখে পড়ে গেলো বার্নলির এক তরুণ পেসারকে, যে ইতোমধ্যেই তার অসাধারণ গতির জন্য ‘বার্নলি বুলেট’ নামে পরিচিত হয়েছে পরিচিতি মহলের মধ্যে।

স্ট‍্যানওর্থ দলের কোচিং বিভাগের পরিজনদের অনুরোধ করলেন ছেলেটিকে একবার পরীক্ষা করে নেওয়া হোক। তরুণ সসম্মানে উর্ত্তীর্ণ হলো পরীক্ষায়, বড়ো মাপের সব খেলোয়াড়দের সাথে ড্রেসিং রুম ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ এসে গেলো তাঁর। কিন্তু এতেই সে থেমে থাকবার পাত্র নয়, চোখে ভাসছে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বাইশগজে নামবার।

নিজের প্রথম ‘প্রথম সারি’র মৌসুমে সবাইকে গতি, সিম ও স‍্যুইংয়ে বিপক্ষ দলের ব্যাটিং লাইন আপকে গুড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। বিশেষ করে সবার নজরে এলো তার মারাত্মক গতিতে ধেয়ে আসা ইনস‍্যুইং ইয়োর্কার গুলো। এক মৌসুমেই স্বপ্ন পূরণ বার্নলি ফুটবল ক্লাবের সেই অন্ধভক্ত তরুণ পেসারটির।

২০০২ সালের শেষের দিকে ডাইন আন্ডারে অ্যাশেজের মধ্য পর্যায়ে যখন ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ পেসার‍রা যখন চোটে কাবু, আবার একই সাথে চলছে অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার সাথে বিখ্যাত ত্রিদেশীয় ওয়ানডে ভিবি সিরিজ ; তখন ইংলিশ ওপেনার মার্কাস ট্রেসকোথিক যিনি ওই তরুণকে ইস্তক চেনেন, দলীয় অধিনায়ক নাসের হুসেইনকে পরামর্শ দিলেন ছেলেটিকে পরখ করবার জন্য।

না শুরুটা ভালো হয়নি, কিন্তু প্রতিযোগিতা যত এগোতে থাকলো নিজেকে চেনাতে আরম্ভ করতে থাকলো। ২০০৩ এর বিশ্বকাপেও দেখা গেলো তাকে। নিজেকে সেই চেনানোর পালা শেষ  হলো ২০০৩ সাথে লর্ডসে যখন জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টেই এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট তুলে নিলেন।

শুরু হলো এক জীবন্ত কিংবদন্তী হওয়ার পথ চলা, এক  জেমস ‘জিমি’ অ্যান্ডারসন হওয়ার পথ চলা, ‘লাল চেরি’তে সিম-স‍্যুইংয়ে বিশ্বকে সন্মানিত এবং আশ্চর্যিত করে দেওয়ার পথ চলা।

ওইভাবে শুরু হওয়ার পরও কিন্তু প্রথম কয়েক বছর ক্যারিয়ার খুব মসৃণ ছিলনা। অনিয়মিত সেই পারফরম্যান্স কিন্তু পথ দেখাচ্ছিল না যে তিনি বর্তমানে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলবেন কিংবা পেসার হিসেবে বড়ো ফরম্যাটে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উইকেট সংগ্রাহক হবেন, সঙ্গে ছিল প্রবল চোটপ্রবণতা। আর উপমহাদেশের মাটিতে পারফরম্যান্স তো কহতব‍্য ছিল না, সাথে যোগ হয়েছিল ইংল্যান্ড বোলিং কোচের পরামর্শে নিজের সহজাত বোলিং অ্যাকশন পাল্টানোই।

বদলটা শুরু হয় ২০০৭ সালের পর, যখন নিজের পুরোনো অ্যাকশনকে ভিত করে নতুনভাবে ফিরে আসেন। সঙ্গে জুটি বাঁধেন তার বহু যুদ্ধের সাথী যা বর্তমানেও এগিয়ে চলেছে – স্টুয়ার্ট ব্রড। পেস কমিয়ে সিম স‍্যুইং ও কন্ট্রোলের উপর জোর দিতে শুরু করেন। পরের মৌসুমেই জায়গা করে নেন ‘উইজডেনের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারে’র তালিকায়।

এরপর শুধুই এগিয়ে চলা, আর বিপক্ষের কাছে দু:স্বপ্ন হয়ে ওঠা। এতো দিন সিম, স‍্যুইং প্রধান অস্ত্র ছিলই, এরপর তূণীরে যোগ হয় রিভার্স স‍্যুইং, যার জন্য তিনি এখনো জহির খানকে কৃতজ্ঞতা দেন। যে উপমহাদেশে তার রেকর্ড খুবই সাধারণ ছিল, রিভার্স স‍্যুইং তা এক অন্য মাত্রা এনে দেয়।।

এতোকিছুর মাঝে তাঁর ব্যাটিং দক্ষতা নিয়ে কথা না বললেই নয়। একজন প্রকৃত ১০-১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হয়েও নিজের উইকেট কখনো ছুঁড়ে দিতে দেখা যায় না, যা ম্যাচের ফলাফলে বহুবার ওলটপালট এনে দিয়েছে। ২০১৪ তে ট্রেন্টব্রিজে জো রুটের সাথে শেষ উইকেটে জুটি বেঁধে সেই অসাধারণ পার্টনারশিপ কিভাবে ভুলে যাবো।

ওই ইনিংস আবার ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে সময়ের হিসেবে দীর্ঘতম ইনিংস ছিল। এর সাথে যোগ হবে অসাধারণ গ্রাউন্ড ফিল্ডার হিসেবে প‍রিচিতি। ক্যাচিং পজিশন বিশেষ করে স্লিপ ক্যাচিংয়ে এনার দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তা পেসার হোক কিংবা স্পিনারদের বিপক্ষে।।

এতো কিছু অর্জন করবার পরও ক্ষিদে যে তাঁর মেটেনি, তাঁর আন্তর্জাতিক সিরিজের মাঝে ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশগ্রহণের মাঝেই বোঝা যায়। কয়েকদিন আগেই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০০০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন। আজো যে প্রতিপক্ষের টপ অর্ডার উপড়ে ফেলতে জানেন – তা প্রমাণ করেন প্রতিনিয়তই। এজন্যই তিনি অনন্য, এজন্যই তিনি চিরসবুজ। দাপটের কোনো বয়স হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link