‘শেষ করেছিলে তো?’ – কতদিন কেউ জিজ্ঞেস করে না। ইতিহাস পরীক্ষার শেষে মা জিজ্ঞেস করত। খুব বড় প্রশ্ন এলে। অথচ আমি জানি ইতিহাস বিষয়টা শেষ করে ফেলা অত সোজা নয়। যেমন ফাস্ট বোলারের রান আপ। সকালে প্রথম স্পেলে বুটমার্ক একটা সাল লিখে দেয়।
আরো পড়ুন
- যেভাবে শক্ত ছিলেন সিরাজ
- বুকের কান্না ঢাকি আমি
- বাইশ গজে বাবার মুখ…
- বুকের ভেতর আগুন পুষি আমি
- জীবনের শেষে স্বপ্নের শুরু
ধরা যাক ঐ অবধি প্রাচীন যুগ। তারপর সেকেন্ড স্পেলে তা নেমে আসে মধ্যযুগে। এই যে একযুগ থেকে অন্যযুগ ছুটে যাওয়া এটা সবাই পারে না। সিরাজ বলে একটা বোলারকে আমরা চিনতাম। সিরাজ বল করলে আমরা হাসতাম। সিরাজ অনেকটা ছুটে আসত। একবেলার মনখারাপ বয়ে বয়ে আনত। ফেলে দিত অন্য মহাদেশে। সেই মনখারাপের ভিসা নেই।
ব্যাটসম্যান ছুঁড়ে দিল বাউন্ডারির বাইরে। সিরাজ একটা রান আপ শেষ করে পরের রানআপে চলে যায়। নি:শব্দে। সিরাজের বাবা অটো চালাতেন। সিরাজ ক্রিকেট খেলার আগে অনেকটা পথ ছুটত। এমনটা আমি দেখেছিলাম ধান্যকুড়িয়ার নারানকে। উপন্যাসে। নারান ছুটতে চেয়েছিল। বুড়ো বয়সে কি আর অত ছোটা যায়? তবু ও ছুটেছিল। জেতার চেয়ে শেষ করা অনেক কঠিন কাজ। নারান শেষ করতে চেয়েছিল একটা দৌড়।
সিরাজও তেমন। ওর দু আঙুলের ফাঁকে লালচেরি বল চেপে বসে। তার ভেতর ও ভরে দেয় জীবন। পিচে ড্রপ খেয়ে কেঁপে উঠছে সিরাজের ঘর, বাবার মুখ, প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ। সিরাজকে আমরা ধরিনি হিসেবে। হিসেব একদিন ওকে ধরে ফেলেছে স্কোরবোর্ডে। সিরাজের জীবন দুলে দুলে চলে যাচ্ছে কিপারের হাতে।
ফাস্ট বোলারের রান আপ সিরাজ জানে। আমাদের একজীবনে একটা উচ্ছ্বাস কিংবা বিষাদ অবধি পৌঁছোনো জরুরী। মাঝখানে অনন্ত রানআপ। সিরাজ একজন ঐতিহাসিক। সিরাজের চোখ দিয়ে জল পড়ে। আমরা দেখি সক্কলে। সিরাজ কাঁদে নি। সব জলকেই কান্না বলতে নেই। সিরাজ বল করে। বলই করে৷
আমাদের হাসি আর মৌনতা হাওয়ার মতো পালটে পালটে যায় কানের পাশ দিয়ে। বাবা ডাক দিয়ে ওঠে হঠাৎ! সমস্ত উইকেটের পিছনে আর বাবাকে দেখতে পায় না ও। সব পিছুটান সিরাজ বয়ে বয়ে ছোটে, নারানের মতো ও শুধু শেষ করতে চায় একটা দৌড়, ব্যস!
কে জানে কোন আলোর ভেতর মতি নন্দী লিখছিলেন। তবে আমরা ফিরে যাই গোড়ার কথায়। ‘শেষ করেছিলে তো?’ – এ প্রশ্ন আসলে নারানের স্ত্রী মহামায়ার। গল্পের শেষে ক্লান্ত নারান বসেছিল ওর পাশে। তেঁতুলপাতার মতো কেঁপে উঠছিল নারানের মুখ, নরম অসুখ কিংবা সুতো ওঠা সিম নড়ে উঠছিল হাওয়ায় হাওয়ায়।
বানজারার খুপরি ঘরের সিরাজ আর ধান্যকুড়িয়ার নারানের জুতোর দাগ এখনো লেগে আছে সবুজের গায়ে। সেখান থেকে বেঁকে যাচ্ছে জীবন, সে নিজেই যেন হাসতে হাসতে বলছে –
‘এইটুকু পথ দৌড়োতে পারব না! যতদিন পারি হুসহুস করে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলব।’