যে মোহনবাগানের কাছে ড্র করে গত মৌসুমের এএফসি কাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল বুসন্ধরা কিংস, এবার ভারতের সেই দলটির কাছে হেরে প্লে অফ থেকেই বাদ পড়তে হয়েছে আবাহনী লিমিটেডকে। অখচ বাংলাদেশের ফুটবলকে বদলে দেবার লক্ষ্য নিয়েই কলকাতায় গিয়েছিলো ধানমন্ডির জায়ান্টরা। কিন্তু ৩-১ গোলের পরাজয় আরও বেশি হতাশ করেছে ফুটবলপ্রিয়দের।
এবার সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মাঠে নামতে যাচ্ছে বসুন্ধরা কিংস। টানা তৃতীয়বারের মতো এশিয়ার ক্লাব ফুটবলের আসরে ব্যর্থ ঢাকা আবাহনী। ২০২০ ও ২০২১ সালের মতো এবারো এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে খেলতে পারেনি বাংলাদেশের পেশাদার ফুটবলের সবচেয়ে সফল দলটি। এবার পালা বসুন্ধরার।
আগামী ১৮-২৪ মে কলকাতায় অনুষ্ঠিতব্য গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংসের প্রতিপক্ষ মালদ্বীপের মাজিয়া এফসি, ভারতের এটিকে মোহনবাগান এবং একই দেশের গোকুলাম এফসি। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দল ইন্টার জোন সেমিফাইনালে খেলবে। চলমান বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে মৌসুমের প্রথম দুই ট্রফি জেতায় আবাহনীর কাছে সবার প্রত্যাশা ছিল এএফসি কাপেরও প্রিলিমিনারি এবং প্লে-অফ পর্বে উৎরে গ্রুপ পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে।
আবাহনীর বিদায়ের পর এখন বসুন্ধরা কিংসের ওপর দায়িত্ব এসেছে লাল-সবুজদের সুনাম পুনরুদ্ধার করা। পাশাপাশি সাফ অঞ্চলের ক্লাব ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো। কিন্তু কলকাতার মাঠ থেকে কি মনে রাখার মতো সাফল্য বয়ে আনতে পারবে এই মৌসুমে এখনো কোনো ট্রফি না জেতা বসুন্ধরা। গত আসরে অল্পের জন্য গ্রæপ চ্যামিম্পয়ন হয়ে জোনাল সেমিফাইনালে খেলতে পারেনি অস্কার ব্রুজোনের শীষ্যরা। এই স্প্যানিশ কোচ এবারের মিশনকে আরো চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন।
তার মতে, এবারের চার দলই অনেকটা সমপর্যায়ের। কাউকে দুর্বল ভাবার খুব একটা সুযোগ নেই। তেমনি এককভাবে কাউকেই শক্তিশালী ভাবছেন না তিনি। গোকুলাম এফসি ভারতীয় আই লিগের শীর্ষ দলআর মালদ্বীপের মাজিয়াও তাদের লিগে পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে রয়েছে। আর মোহনবাগান তো নিজেদের মাঠে হাজারো দর্শকের সমর্থণ নিয়ে খেলবে। এর আগে আবাহনী ২০১৯ সালে গ্রæপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সময় কলকাতার কোনো ক্লাবকে পায়নি। চেন্নাই আর পাঞ্জারের ক্লাবকে হারিয়ে সর্বোচ্চ সাফল্য পেয়েছিল। এবার এএফসি কাপের গ্রæপে দুই বাংলার ক্লাবের লড়াই বলতে হচ্ছে।
এর আগে আবাহনীর পরাজয়েল ম্যাচে বাংলাদেশ-ভারতের ফুটবল দ্বৈরথটা বেশ পুরনো। একটা সময় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও এখন আর সে অবস্থা নেই। ম্যাচের আগে অনেক বারুদে কথা শোনা গেলেও শেষে পরাজয় নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় বাংলাদেশকে। যদিও ২০১৯ সালে কাতার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে জয়ের খুব কাছে গিয়েও সেটিকে ধরে রাখা যায়নি। জাতীয় দলের পাশাপাশি উত্তেজনাটা টের পাওয়া যায় ক্লাব দলের মধ্যকার ম্যাচেও।
যেমন করে এএফসি কাপের প্লে অফ ম্যাচে আবাহনী-মোহনবাগান ম্যাচ নিয়ে যতটা উত্তাপ মাঠের বাইরে ছিল, মাঠের খুব বেশিকিছু কিছু কি দেখা গেছে? অনেকটা অসহায় আত্বসমর্পন করেছে বাংলাদেশের ক্লাবটি। ৩-১ গোলের পরাজয় আবারো বুঝিয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের পার্থক্যটা। অথচ গতবার বসুন্ধরা কিংসকে টপকে গ্রæপ চ্যাম্পিয়ন হলেও এটিকে মোহনবাগান এবার প্লে অফ খেলেছিল। আবাহনীরও একই অবস্থা ছিল। কিন্তু প্রত্যাশার খুব কাছাকাছি কি পৌছাতে পেরেছিল নাবীব নেওয়াজ জীবনের দল। ম্যাচের আগে এই লড়াইকে ভারত-বাংলাদেশের লড়াই বললেও সেখানে বাংলাদেশের প্রভাবটা কি খুব বেশি কিছু ছিল? বাংলাদেশের ফুটবলে দৈন্য চেহারাটা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
এই ম্যাচে আসলে একটা দল হিসেবে খেলতে পারেনি ধানমন্ডির জায়ান্টরা। যদি বলা হয় রক্ষনভাগই ডুবিয়েছে আবাহনীকে, তাহলে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবেনা। যা যা ভুল হতে পারত সবই ভুল হয়েছে এই ম্যাচে! চায়নিজ সুপার লিগে খেলা ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার ডোরিয়েলটন পড়ে গেলেন ইনজুরিতে। মিডফিল্ডে ক্রিয়েটিভি দেখাতে পারতেন যিনি, সেই ইমন বাবুও চোট নিয়ে ছিলেন মাঠের বাইরে।
বাংলাদেশ একটা দারুণ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পেতে পারত, সেই মোহাম্মদ হৃদয় চোটে না পড়লে খেলতেন এই মাচে। সবমিলিয়ে অনেক সমস্যা নিয়েই মাঠে নামে আকাশী-নালী জার্সিধারীরা। এই ধরনের ম্যাচে আবাহনীকে সেটা অনেক সাহায্যও করত। কে জানে হয়ত সল্ট লেকের ম্যাচটা বের করেও আনতে পারত মারিও লেমোসের শীষ্যরা। এছাড়া রাইটব্যাক এ সুশান্ত ত্রিপুরা এক লাল কার্ডে প্রথমে বসুন্ধরা কিংস ভুগেছিল সর্বশেষ মৌসুমে।
এবার দল পাল্টে তিনি আবাহনী গেলেন, কিন্তু এএফসি কাপে সেই লাল কার্ডের সাসপেনশনটা টেনেই আনতে হলো। আবাহনীর রক্ষণের দুর্বলতাটা প্রায় পুরোটাই ওই রাইটব্যাক পজিশন দিয়ে চলে গেল। এএফসি কাপে একটা দলকে যে ইন্টেনসিটির ম্যাচ খেলতে হবে, সেই ইন্টেসিটিতে মোহনবাগান সবসময় খেলে অভ্যস্ত। ইন্ডিয়ান সুপার লিগ-আইএসএলে নিয়মিতই তাদের এমন ম্যাচ খেলতে হয়। আবাহনী দ্বিতীয়ার্ধে অনেকটা ভয়ডরহীন ফুটবল খেলে। ড্যানিয়েল কলিনড্রেস সেখানে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিলেন।
যার সুত্র ধরে জুয়েল রানা গোলে বল অন টার্গেটে রাখতে পারলে ২-২ ব্যবধান হওয়ারই কথা ছিল। একপেশে প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধে তাই আবাহনী খুব বেশি কাজে লাগাতে পারেনি। এখন এএফসি কাপের গ্রুপ ডি-তে তাই বাংলাদেশের একটাই ক্লাব, সেটা বসুন্ধরা কিংস। গোকুলাম কেরালা, মাজিয়া এফসি, এটিকে মোহনবাগান বাকি তিন দল। সল্টলেকে মে মাসে আরও বড় সমর্থন আশা করতে পারে মোহনবাগান। বসুন্ধরা কিংসের তিনটা ম্যাচই ওই স্টেডিয়ামেই খেলতে হবে। দেখা যাক কতটা কি হয়।
কারণ এশিয়ার ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম সেরা এই আসরে বসুন্ধরাই বাংলাদেশের আশার প্রদীপ হয়ে টিকে আছে। কোস্টারিকান কলিনড্রেসের গোলটা আবাহনীর আশার অক্সিজেন হওয়ার পর ম্যাচে ফিরতে হলে দরকার ছিল আরেকটি গোল। এমন সময়ই কি না ফাঁকা পোস্টে বল পেয়েও সেটিকে জালে জড়াতে পারলেন না জুয়েল রানা। তাতে পারল না আবাহনীও। দুই বাংলার মর্যাদার লড়াইয়ে একপেশে জয় দিয়ে পেশাদার লিগে সবচেয়ে সফল দলটির স্বপ্ন ভাঙল মেরুন-সবুজের এটিকে মোহনবাগান।
ড্যানিয়েল কলিনড্রেস, রাফায়েল আগুস্তো, নাবীব নেওয়াজ জীবনদের সঙ্গে যোগ দিয়ে এএফসি কাপের জন্য আবাহনীর শক্তি বাড়িয়েছিলেন বসনিয়ান নেদো তুর্কোভিচ। ইনজুরির কারণে ডোরিয়েলটন গোমেজ না থাকলেও এই আক্রমণভাগ দিয়েই ঐতিহ্যবাহী মোহনবাগানকে তাদের মাটিতেই হারানোর পরিকল্পনা করেছিলেন পর্তুগিজ কোচ লেমোস।
আক্রমণভাগে শক্তি বাড়াতে গিয়ে খানিকটা হয়তো মনোযোগের অভাব পড়েছিল রক্ষণভাগে। ইনজুরি জর্জর আর জোড়াতালির রক্ষণটা ধসে পড়ল এএফসি কাপে বাছাইপর্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই! ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের জায়গা বের খেলতে না দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অধিকাংশ সময় অরক্ষিত থাকলেন স্বাগতিক ফরোয়ার্ডরা, বিশেষ করে তিনটি গোলের সবকিট করা ডেভিড উইলিয়ামস। এই অস্ট্রেলিয়ান একাই ধসিয়ে দিলেন আবাহনীর রক্ষণভাগকে।