ক্যাপ্টেন বনাম ক্যাপ্টেন

দু’জনের মধ্যে অমিল প্রচুর।

একজন বহিরঙ্গে বিপ্লবী, ট্যাটু-শোভিত, স্টাইল-আইকোনোচিত, সোচ্চার, অকুন্ঠ, বলদৃপ্ত আধুনিক; আবার একইসঙ্গে কেতাবি-ঘরানার টেকনিকে অকুন্ঠ আস্থা রাখেন। মনে করেন ট্রেনিং-ই একমাত্র ভাইব্রেনিয়ামের ঢাল যা আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়কে বয়স, চোট-আঘাত, উল্টোদিকের কম্পিউটার-অ্যানালিস্ট ইত্যাদি বিপক্ষের থেকে বাঁচাতে পারে। নির্মেদ-ছিপছিপে শরীরে অফ-ফর্ম থাবা বসলেও, ফিটনেসের অভাব হয় না। কভার ড্রাইভের সময় পা একদম বলের পিচ পর্যন্ত যায়। অসম্ভব দ্রুত সিঙ্গল-ডাবল-ট্রিপল শুধু নিতে পারেন, তা-ই নয়, নিতে বেশি ভালোওবাসেন।

অন্যজন দৃশ্যতই সাবেকী, চরম রেবেলিয়ান কাজকর্মের সময়েও মুখে সলজ্জ হাসি, ঠিক যেমন হাসি মুখে মেখে শোলে-তে জয় হোলির নাচ নাচতে নাচতে থেমে যান। জীবনযাপন থেকে ঈশ্বরবিশ্বাস সবকিছুতেই বেশ সনাতনপন্থী হয়েও এঁর টেকনিক নিয়ে বিস্তর প্রশ্নচিহ্ন সেই অঙ্কুরোদগমের সময় থেকেই। মুখে সিস্টেমের কথা বললেও, তাঁর খেলোয়াড় জীবনের পাতা ওল্টালে বোঝা যায়, ট্রেনিংয়ের চেয়েও ন্যাচারাল ট্যালেন্টের প্রতিই তাঁর বেশি আস্থা।

ক্যারিয়ারের গোড়া থেকেই শরীরের ঊর্ধ্বভাগ যথেষ্ট নমনীয় নয়, এবং নিম্নভাগ যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তাই পুল করার সময় কোমর বিসদৃশভাবেই ঘোরে না, একদিবসীয় ম্যাচে মাঝের ওভারগুলিতে স্পষ্ট হয় দৌড়ে রান নেওয়ায় তাঁর স্পষ্ট অনীহা। কভার ড্রাইভের সময় পা বলের পিচে নিয়ে যাওয়াটা আবশ্যিক বলে কোনোদিনই মনে করেননি ইনি।

দু’জনের মধ্যে মিলও কম নয়।

দু’জনেই মাঠের মধ্যে বলদর্পী অধিনায়ক। নিজের আধিপত্যকে শুধু পদাধিকার নয়, নিজের জন্মগত অধিকার বলেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। প্রবলতম প্রতিস্পর্ধী – চূড়ান্ত পরাক্রমী বিপক্ষের সামনেও কণামাত্র হীনম্মন্যতার রেশ নেই। ফুটওয়ার্ক অর নো-ফুটওয়ার্ক – কভার-ড্রাইভে দুজনেই সম্রাট।

শুধু ক্যাপ্টেন হিসেবে ম্যাচ জিতেই সন্তুষ্ট নন – নতুন ক্রিকেট লিগ্যাসি তৈরিতে উদগ্রভাবে আগ্রহী। টিমের আনুগত্য জিতে নেওয়ায় প্রশ্নাতীত এবং বন্ধুবেশী ব্রুটাস সহ-অধিনায়কের উপস্থিতি নিয়ে দুজনেরই গোপন আক্ষেপ থাকতে পারে বলে কল্পনা করা যায়। ট্যাটু অর নো ট্যাটু – জার্সি খুলে ওড়ানোর ঔদ্ধত্য দুজনেরই ভিতর টইটম্বুর।

আসলে খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেল বা ফেসবুকে খেলা-সম্বন্ধীয় গ্রুপগুলিতে যেভাবে চর্চিত হয়েছে, বিষয়টা হয়তো ঠিক তেমন নয়। এই বিতর্কের শিরোনাম অন্তত কখনোই ‘কোহলি বনাম গাঙ্গুলি’ হওয়ার কথা নয়। বরং হওয়া উচিত, ক্যাপ্টেন বনাম ক্যাপ্টেন!

কারণ, এই বিতর্কের ঘূর্ণাবর্তে ভেসে না গিয়ে, তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, আসলে এর কারণ দুজনের ক্রিকেট-দর্শনের বৈসাদৃশ্য নয়, বরং তার অদ্ভুত সাদৃশ্যই এই ডুয়েলের টেমপ্লেট!

জন বুকানন যখন স্টিভের অস্ট্রেলিয়ার কোচ হিসেবে প্রায় ক্রিকেট-কল্পগাথায় রূপান্তরিত হচ্ছেন, সেই সময়েই যেন ওয়ার্ন একবার বলেছিলেন, ‘ক্রিকেট টিমের কোচ/ম্যানেজার হল সেই লোকটা যে টিম-বাসে করে টিমের সঙ্গে প্র্যাকটিসে যায় এবং হোটেলে ফেরে।’

এমনিতে যত বিরোধই থাক, বেহালাবাসী ভদ্রলোক এই বিষয়ে মোটামুটি সহমত পোষণ করেন, এ রীতিমতো হলফ করে বলা যায়। আর কোহলি? কোচ সম্বন্ধে তিনি কী ভাবেন, ক্রিকেট টিমে কোচের অধিকার সম্বন্ধে তাঁর কী মনোভাব, সেটা বোঝার জন্য একবার অনিল কুম্বলে এপিসোডটা মনে করলেই হয়।

ক্রিকেট লম্বা সময়ের খেলা। সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটেও ফিল্ডিং টিমকে একটা গোটা ফুটবল ম্যাচের চেয়েও লম্বা সময় মাঠে কাটাতে হয়। সেখানে ক্যাপ্টেনই প্রথম এবং শেষ কথা। মাঠের বাইরে বসে থাকা কোচের সেই সংঘাতময় নাটকে ভূমিকা কতটুকুই বা? সৌরভ এবং বিরাট দুজনেই তাই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, ক্রিকেটে টিমটা ক্যাপ্টেনের। যেহেতু মাঠের মধ্যে হওয়া বিপর্যয়ের সিংহভাগ দায় তার, তাই মাঠের বাইরে টিম-সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রেও তার মতই চূড়ান্ত।

সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই চ্যাপেলের সঙ্গে সৌরভের বিরোধ। সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অনিলায়নের বদলে বিরাটরাজ চালু।

আর সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই… আসলে কী হয় জানেন, ‘রাজাই সর্বশক্তিমান’ – এই মন্ত্র যদি স্বয়ং রাজার মস্তিষ্কের কোষে-কোষে প্রবাহিত হতে থাকে অষ্টপ্রহর – তাহলে একসময় সেটা বদলে গিয়ে ‘আমিই সর্বশক্তিমান’ হয়ে যায়। ‘রাজা’ যে ওই পদটির নাম, আমার নাম নয়, তা অনেক সময়েই আমরা ভুলে যাই। মনের মধ্যে গেড়ে বসে, ‘আমাকে চ্যালেঞ্জ জানানো যায় না!’ – এই মনোভাবটি।

মহারাজ গাঙ্গুলি এবং কিং কোহলি – দুজনেরই মনের মধ্যে এই দর্প প্রতিধ্বনিত হয় সবসময়।

কর্ণের অঙ্গরাজ্যের রাজ্যাভিষেকেই যেমন কৌরব-পাণ্ডব যুদ্ধের বীজ পোঁতা বলা চলে; ঠিক তেমনই যেদিন সৌরভ ক্রিকেট অ্যাডভাইসরিতে এলেন, বলা যায় সেদিন থেকেই এই মহাভারতের আদিপর্বের সূত্রপাত। বিধাতা অলক্ষ্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, এই জমির লড়াই কোনদিকে গড়ায় তা দেখতে।

ক্রিকেট কমিটির বেছে দেওয়া কোচকে সরে যেতে বাধ্য করে, তাঁদেরই বাতিল করা কোচকে (পড়ুন রবি শাস্ত্রী) পুনর্নির্বাচিত করতে বাধ্য করে, কিং কোহলি প্রথম সেট জিতেছিলেন। জ্বালা ধরানো হার… একে তো অনিল সৌরভের সতীর্থই বলা চলে, তায় রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে সৌরভ গাঙ্গুলির মধুর সম্পর্কের রসায়ন তো মমতা-মোদিকেও হার মানাবে।

কিন্তু, কোহলি তখন আক্ষরিক – অর্থেই কিং! ব্যাটে রান, বক্স-অফিস তুঙ্গে, কোথাকার কোন কমিটি, যার আয়ু কতদিন তা-ই জোর দিয়ে বলা চলে না, তার এক সদস্যকে কোহলি ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। সেই সঙ্গে এটাও হয়তো হিসেবে ছিল না যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশ প্রিয়পাত্র মানুষটি জয়-শাহের বাঁ-পাশের জন হয়ে যাবেন অচিরেই।

কিন্তু, জীবন একটাই। সময়ের ঢেউ তোমার থেকে যা নিয়ে যাবে, আবার তোমাকেই তা ফিরিয়ে দিয়ে যাবে কোনও সময় – এ শিক্ষা সৌরভ সময়ের থেকে পেয়েছেন। সময় – যা তাঁর তূণীরে একমাত্র অস্ত্র, যার জবাব কিং কোহলির কাছে নেই। ক্রিকেটারের আয়ু বড়জোর চল্লিশ – প্রশাসকের? ওয়েল… ভারতের ইতিহাস মানলে, দশকের-পর-দশক!

ঠিক এই মুহূর্তে, হিসেব দেখলে, ফিরতি সেটে সৌরভ কোহলিকে তিন বার ব্রেক করে জিতেছেন। সাদা বলের ক্যাপ্টেন্সি ক্যাপ্টেন্সি তো গেছেই, একাংশ ক্রিকেট ভক্তের চোখে তাঁর সততা নিয়েও হালকা সন্দেহের মেঘ… এর সঙ্গে যোগ করুন, রাহুল দ্রাবিড়ের কোচ হয়ে আসা। কোহলি নিশ্চয়ই এবারে আর ভুলবেন না, অনিল পদত্যাগ করার পরে, তাঁর বর্তমান কোচ ঠিক কী ভেবেছিলেন?

ভারতের ফাইনাল-ফ্রন্টিয়ারে দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজের ফাইনাল টেস্ট। কেপটাউনে যদি কোহলি সেঞ্চুরি করেন এবং ভারত ম্যাচ ও সিরিজ জেতে? কখনও, কোনও ভারতীয় দল যে শৃঙ্গ জয় করতে পারেনি, যদি সেই শৃঙ্গে ক্যাপ্টেন এম.আর.এফ ব্যাটের হ্যান্ডেলে টাঙিয়ে দেয় জাতীয় পতাকা। না, ম্যাচ হয়তো তখনও শেষ হবে না। তবে বলা যাবে, থার্ড-সেট, অ্যাডভান্টেজ কোহলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link