ফুটবল কোচিংয়ের যীশু

বিজয়ী বীরদের বয়স বোধহয় কখনও বাড়ে না। অন্তত ষাট পেরিয়ে যাওয়া সাদা চুলওয়ালা কার্লো আনচেলত্তিকে দেখে তো তাই মনে হয়। এই যেমন গোটা দুই সিজন ধরে এভারটনে কোচিং করিয়ে আবার ফেরত এলেন সেই ক্লাবে, যে ক্লাবে জীবনের সবচেয়ে সফল বছরগুলি কাটিয়েছেন। ট্রফি পেয়েছেন, জয় পেয়েছেন, সম্মান পেয়েছেন বহু। আবার তবে কেন? এবার তো অবসর নিলেই পারতেন এই ফুটবল সাধক।

অবসরের অনেক ক্রাইটেরিয়া হয়। কেউ প্রভিডেন্ট ফান্ড গোছায়, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সটা ঠিকঠাক আছে কি না একবার সসম্ভ্রমে চোখ বুলিয়ে নেয়। পেনশনটা মাসের পয়লায় সময় মত ঢুকবে কি না তার নিশ্চয়তা বজায় রেখে তবে বিদায় নেয় কর্মজীবন থেকে। কিন্তু স্পোর্টসে, বিশেষত ফুটবলে উপরোক্ত কথাগুলোর কোনওটাই খাটে না। ঠিক যেমন অভিনেতাদের ক্ষেত্রেও খাটে না।

একটাই ব্যাপার, কাজের খিদে। প্যাশন, ভালবাসার খিদে। যে খিদের চোটে আজও লিডসকে প্রিমিয়ার লিগের মূলপর্বে দুর্দান্ত খেলান মার্সেলো বিয়েলসা, সত্তর পেরিয়েও উরুগুয়ের সাইডলাইনে ক্রাচ হাতে বসে থাকেন অস্কার তাবারেজ এবং এত ক্লাব ঘুরে টানা ট্রফি জয় করে যান কার্লো আনচেলত্তি। এভারটন তাঁকে খালি হাতে ফেরালো। এর আগে কখনও এভাবে খালি হাতে ফেরেননি আনচেলত্তি।

লোকটা সেই পার্মা থেকে কোচিং করাচ্ছে। একটুও অবসর নেই। যখনই যে ক্লাবে গেছে, ক্লাবের ক্যাবিনেট ভরিয়ে দিয়েছে ট্রফিতে। কখনও মিলান, কখনও লণ্ডন, মাদ্রিদ, কখনও মিউনিখ – সারা ইউরোপ ঘুরে ঘুরে টানা কোচিং করিয়ে অবশেষে আবার ব্যাক টু মাদ্রিদ।

আচ্ছা, ফুটবলের তো অনেক ফর্মেশন হয়। সোজা বাংলায় ব্যূহ রচনা বলতে যা বোঝায়। সেই মহাভারতের সময় থেকে যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষ সেনাদল একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ব্যূহ রচনা করত, আজকের ফুটবলেও তাই। বহু ব্যূহের আড়ম্বরসূচক নাম ছিল, যেমন – চক্রব্যূহ, বজ্রব্যূহ প্রভৃতি। তেমনই, ফুটবলের এই ফর্মেশনেরও বেশ জুতসই নাম থাকা উচিত। এর মধ্যে একটি ফর্মেশনের নাম ‘ক্রিসমাস ট্রি ফর্মেশন’। কে করেছিলেন, কোথায় আর কেনই বা করেছিলেন, একটু বিশদে লেখা হোক।

২০০১ এর শেষভাগ। ইউরোপে ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে নিজের দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্লাব এসি মিলানের কোচ হলেন কার্লো আনচেলত্তি। মালদিনি, পিরলো, গাত্তুসো, ইনজাগি আর গোলরক্ষক দিদা-কে নিয়ে ভরা টিম। কিছু পরে এলেন নেস্তা, কাফু, শেভচেঙ্কো, কাকা, আর হার্নান ক্রেসপো। ভরা সংসার নিয়ে এবার আন্সেলোত্তি ভাবতে বসলেন, এই সোনার টিম নিয়ে কী ছকে খেলবেন। ভাবতে ভাবতে বেশ মনের মত একটা ছক বার করলেন। সেটা কীরকম? না, দুটো সেন্ট্রাল ব্যাক থাকবে।

আর বাঁদিকে-ডানদিকে দু’জন এমন প্লেয়ার চাই যারা একইসঙ্গে ফুলব্যাক এবং দারুণ ওভারল্যাপ করতে পারে। একজন ছিলই অপশনে। নাম, কাফু। যার ডিফেন্ডার হিসেবে কোনও সৌন্দর্য নেই কিন্তু পোড়া কপালের ম্যাচেও যার প্রতি চোখ বন্ধ ক’রে ডিফেন্সিভ লাইনে ভরসা করা যাবে। অপরজন জান্কুলভস্কি। নেস্তা আর ক্যাপ্টেন মালদিনি নেতৃত্ব দেবে সেন্ট্রাল ডিফেন্সের, যখন ওভারল্যাপ আক্রমণ হবে। মাঝমাঠে থাকবে একটা সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ও দু’জন মিডফিল্ডার অ্যাম্ব্রোজিনি এবং গাত্তুসো।

এইখানে আসল খেলা, যে ফর্মেশনের কথা বলা হচ্ছে তার প্রাণভোমরা একজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার – যার ভূমিকায় আন্দ্রেয়া পির্লো। খেলা তৈরি এবং ক্রমাগত আপার লাইনে বল সাপ্লাই করে খেলার গতি ও ভঙ্গি বজায় রাখাই যার একমাত্র কাজ। সোজা কথায়, ফর্মেশনের ঠিকঠাক প্রয়োগ যার হাতে। এরপর উপরে, আপফ্রন্টে দু’জন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার এবং একজন স্ট্রাইকার। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে দুই শ্রেষ্ঠ অস্ত্রকে পেয়েছিলেন আনচেলত্তি – কাকা এবং সেডর্ফ। যারা দু’জনেই তখন স্বপ্নের ফর্মে।

এসি মিলানে খেলেই কাকা পেলেন ব্যালন ডি অর। তারা গোল করার সুযোগ তৈরি করবে পেনিট্রেটিভ জোনে এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে একজন স্ট্রাইকার। কখনও সে পজিশনে ফিলিপো ইনজাঘি, কখনও রোনাল্ডো, কখনও হার্নান ক্রেসপো তো কখনও আন্দ্রে শেভচেঙ্কো।

এ ছকে সেন্টার ফরোয়ার্ডের কাজও খুব একটা সহজ না যে বল ধরলেই গোল! ফার্স্ট টাচ রীতিমত ভাল হওয়া চাই, হোল্ডিং এবিলিটি স্ট্রং এবং সঙ্গে ডি-বক্সে ভয়ংকর মুভমেন্ট করতে পারলে তবেই আসবে কাঙ্খিত গোল। আর এ কাজে উপরে বলা চারটে নাম যে এক একটা রত্ন, তা তো আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ ক’রে, রোনালদো নাজারিও ডি লিমা!

একটা অসাধারণ ৪-৩-২-১ ফর্মেশন, যার নাম ক্রিসমাস ট্রি ফর্মেশন। এই ফর্মেশন কাজে লাগিয়ে আন্সেলোত্তি জয় করেছেন সিরি এ, কোপা ইতালিয়া এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তিনবার ফাইনাল খেলে দু’বার জয়, একবার রানার্স। তার মধ্যে দু’বারই প্রতিপক্ষের নাম লিভারপুল! সম্পূর্ণ ইতালিয়ান ঘরানার আল্ট্রা-ডিফেন্সিভ ছক তৈরি, যাতেই আনচেলত্তি করেছিলেন বাজিমাত।

আর সেই সঙ্গে আনচেলত্তির সবচেয়ে বড় গুণ, ঠিক ঠিক পজিশনে ঠিক ঠিক প্লেয়ার বসানো। প্লে-মেকার হিসেবে পির্লো, ডিফেন্সে নেস্তা-মালদিনি, কাফু-জানকুলভস্কির ক্রমাগত টাচলাইনের ধারে ওঠা-নামা, কখনও ওভারল্যাপ, কখনও সোজা ডিফেন্সে নেমে এসে ছক বজায় রাখার কাজ টানা করে যাওয়া। কাকা আর সেই সময়ে টেকনিক্যালি সাউণ্ড সেডর্ফের মধ্যে কম্বিনেশন, ক্রমাগত পাসিং, হোল্ডিং করা, ভিশন ঠিক রেখে একটা ডিফেন্স চেরা পাস সেন্টার ফরোয়ার্ডের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া – সব মিলিয়ে পারফেক্ট পজিশনে পারফেক্ট প্লেয়ার বসানোর জন্যই বরাবর আন্সেলোত্তি বিখ্যাত!

এই ছকের আবিষ্কর্তা কিন্তু একজন ব্রিটিশ! কোনও ইতালিয়ান নন। বার্ট হার্ড নামক এক ব্রিটিশ প্রথম এই ছকের ব্যবহার শুরু করেন ইংল্যান্ডের ক্রিস্টাল প্যালেসে। কিন্তু সার্বিকভাবে এ ছকের ব্যবহার যদি কেউ করে দেখিয়ে থাকে, বলা ভাল এই ছকের ব্যবহারকে ফ্লারিশ করে থাকেন তাঁর নাম কার্লো আনচেলত্তিই।

এবারে তাঁর ঠিকানার নাম রিয়াল মাদ্রিদ। বরারবই আপফ্রন্টে ভাল কম্বিনেশন পেয়ে আসা আনচেলত্তি ঘরে এবার রোনালদো নেই, ডি মারিয়া, গ্যারেথ বেল, জাভি আলোনসো নেই। হ্যাজার্ড, মদ্রিচ, কাসেমিরো, বেনজেমাদের দিয়েই বাজিমাত করতে হবে লা লিগা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। তবে, আন্সেলোত্তি পারবেন, পারবেনই। আনচেলত্তি জানেন ফুটবল খেলতে গেলে সবার আগে লাগে তাত্ত্বিকতা, নান্দনিকতা।

বায়ার্নে মুলার-রবেন-রিবেরি, চেলসিতে দ্রোগবা-আনেলকা-মাঁলুদা এবং আগের মাদ্রিদে বেল-বেনজেমা-রোনালদোর বহু কম্বিনেশন দেখিয়েছেন, মন ভরিয়েছেন। এবারও তাঁর কাছ থেকে সেইরকমই প্রত্যাশা থাকবে মাদ্রিদ সমর্থকদের। আর কোচ আনচেলত্তির কাছে তো বটেই। এটাই দেখার জন্য, ৪-৩-২-১ এর ক্রিসমাস ট্রি ফর্মেশন আবার মাদ্রিদে প্রয়োগ হয় কি না।

সময় বলবে। লা লিগা বলবে। আনচেলত্তি শেখাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link