সিবি ফ্রাই, এক সর্বজয়ী অতিমানব

সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কে?

গ্যারি সোবার্স, জ্যাক ক্যালিস হয়ে বিতর্কটা এখন সাকিব আল হাসানে এসে ঠেকেছে। কিন্তু আমি যদি বলি, এরা কোনো অলরাউন্ডারই না!

আচ্ছা সোবার্স কী অভিনয় করেছেন? ক্যালিস কী রাজনীতি করেছেন? কপিল দেব কী কখনো স্প্রিন্টার ছিলেন? ইমরান খান কী সামরিক বাহিনীতে ছিলেন? সাকিব কী জাতীয় দলে ফুটবল খেলেছেন?

ঠোট বাঁকাবেন না। মোটেও অবিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস করুন, এই মর্তে একজন মানুষ এসেছিলেন, যিনি এর সবকিছু একা করেছেন। নাম এখানেও আসলে সব বলা হয়নি। তার পরিচয়টা একটা দুটো লাইনে আটকানো তো কঠিন।

তিনি ক্রিকেটার, ফুটবলার, অ্যাথলেট, রাগবি খেলোয়াড়, সেনা কর্মকর্তা, বহুভাষাবিদ, নৌ বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, অভিনেতা, লেখক, সাংবাদিক, অভিনেতা এবং একজন মানসিক রোগী। আসলেই তাই। তিনি সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। তিনি ওয়ান অ্যান্ড অনলি চার্লস বার্গেস ফ্রাই; সিবি ফ্রাই।

সেটা অবশ্য অলরাউন্ডারদেরই যুগ ছিল। সেই সময় ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স; একসঙ্গে চালানো বেশ কিছু খেলোয়াড়কে আপনি খুঁজে পাবেন। এমনকি ইংল্যান্ডের দুটি জাতীয় দলের হয়ে খেলাও একেবারে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা ছিল না। তবে খেলোয়াড় হিসেবে সিবি ফ্রাই সেই অলরাউন্ডারদের যুগেও ব্যতিক্রম ছিলেন।

অত্যন্ত সম্পদশালী এক পরিবারে ১৮৭২ সালে জন্ম ফ্রাইয়ের। তবে তার জন্মের পর আস্তে আস্তে সম্পদে ঘাটতি হতে শুরু করে। তারপরও ফ্রাই সে সময়ের নামকরা রেপটন স্কুল ও অক্সফোর্ডের ওয়াডহ্যাম কলেজে পড়াশোনা করেন। এখানে তার প্রথম অ্যাকাডেমিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। রেপটনে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় তিনি লাতিন, গ্রিক ও ফ্রেঞ্চ গদ্য ও পদ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। জার্মান গদ্যে রানার্স আপ হন। এখান থেকেই তিনি বহুভাষাবিদ হয়ে উঠতে শুরু করেন।

রেপটনেই ফ্রাইয়ের ফুটবলে হাতে খড়ি। সে সময় ভালো ফুটবল দল করার জন্য খ্যাত ছিল রেপটন স্কুল। এই স্কুলের অনুর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা শুরু করেন তিনি। ওয়াডহ্যাম কলেজে যাওয়ার পর ক্রিকেট ও অ্যাথলেটিক্সেও নাম লেখান। একসময় পেশাদার ক্রিকেটার ও ফুটবলার ও অ্যাথলেট ও রাগবি খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। অক্সফোর্ডের চারটি ব্লু ছিলেন ফ্রাই।

মাত্র ২১ বছর বয়সে ফ্রাইকে নিয়ে ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিন ক্যারিকেচার করে। ক্যাপশন ছিল, ‘লোকে কখনো কখনো তাকে সি.বি. বলে, আসলে তিনি তৃতীয় চার্লস (ব্রিটিশ সম্রাট)।’

এই অক্সফোর্ডে থাকা অবস্থায়ই প্রথম তার মানসিক রোগ ধরা পড়ে। শেষ বয়সে এ জন্য তাকে অ্যাসাইলামেও থাকতে হয়েছে।

সিবি ফ্রাই তার সেরা রূপ দেখিয়েছেন সম্ভবত ক্রিকেটে। ইংল্যান্ডের হয়ে ২৬ টেস্টে ৩২.১৮ গড়ে ১২২৩ রান করেছেন। সর্বোচ্চ ছিল ১৪৪ রানের ইনিংস। সাসেক্স, হ্যাম্পশায়ার ও ভারতের মাটিতে ইউরোপিয়ান্স দলের হয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলেছেন। ৩৯৪ প্রথম শ্রেনীর ম্যাচে ৫০.২২ গড়ে ৩০,৮৮৬ রান করেছেন। সর্বোচ্চ ছিল অপরাজিত ২৫৮ রানের ইনিংস। এ ছাড়া বোলিং করেছেন প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে। সমীহ জাগানোর মত ২৯.৩৪ গড়ে ১৬৬ উইকেট নিয়েছেন। ইনিংসে সেরা ৬/৭৮ পারফরম্যান্স ছিল তার।

ফুটবলেও পারফরম্যান্সটা নিতান্ত খারাপ ছিল না।

ফুল ব্যাক হিসেবে পেশাদার ফুটবল খেলেছেন। সাউদাম্পটন ও পোর্টস মাউথের হয়ে সে সময়ের প্রথম ডিভিশন (এখনকার প্রিমিয়ার লিগ) খেলতেন। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়েও একটি ম্যাচ খেলেছেন। ১৯০২ সালে সাউদাম্পনের হয়ে এফএ কাপ জেতেন।

তবে ক্রিকেটের পর তার সেরা সাফল্য ছিল অ্যাথলেটিক্সে। লং জাম্প ও স্প্রিন্টে অক্সফোর্ডের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ১৮৯৩ সালে লং জাম্পে ২৩ ফুট ৫.৫ ইঞ্চি লাফিয়েছিলেন। সেটা ছিল তখনকার বিশ্বরেকর্ড। এ ছাড়া ১০০ গজ স্প্রিন্টে ১৮৯৪ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছিলেন। ধরে নিতে পারেন, এখনকার যুগের কার্ল লুইস!

রাগবি ইউনিয়ন খেলেছেন অক্সফোর্ডের হয়ে। এ ছাড়া ব্ল্যাকহিথ, বারবেরিয়ান্সের হয়েও রাগবি খেলেছেন তিনি। আফসোস, এই খেলাটায় তার কোনো বিশ্ব রেকর্ড নেই।

এ ছাড়া অক্সফোর্ডের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় অ্যাক্রোবেটিক্সে অংশ নিয়েছেন। একবার বিশ্ব বিদ্যালয় চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন।

১৯০৩ সালে ফুটবল থেকে এবং ১৯২২ সালে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।

কী ভাবছেন, সিবি ফ্রাই এরপর শান্ত হয়ে ঘরে বসে রইলেন? না, এরপরই ফ্রাইয়ের আসল ব্যস্ততা শুরু হলো। প্রথমে চার্টারহাউস নামে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করলেন কিছু কাল। তখনও অবশ্য ক্রিকেট খেলতেন। দু বছর পর সে চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী ‘রয়্যাল নেভি’র ট্রেনিং শিপ ‘মার্কারি’তে ক্যাপ্টেন সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

এখানকার অভিজ্ঞতার কারণে তাকে শেষ পর্যন্ত রয়্যাল নেভির রিজার্ভ ফোর্সে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদায়ন করা হয়। কমান্ডার সিবি ফ্রাই বলে সম্মোধন করা হতো তাকে; কেনো, সেটা পরিষ্কার নয়।

১৯২০ সালে তাঁকে লিগ অব ন্যাশন্সে নিয়ে আসেন রঞ্জিত সিংজি। তখনকার জাতিসংঘ মতো এই সংস্থায় বন্ধু রঞ্জির প্রচেষ্টাতেই ভারতীয় তিন প্রতিনিধির একজন হন ফ্রাই। এ ছাড়া সরাসরি রাজনীতি করেছেন। ১৯২২ সালে ব্রাইটন থেকে নির্বাচন করেছেন লিবারেলদের হয়ে; হেরে গিয়েছিলেন নির্বাচনে। ১৯২৩ ও ১৯২৪ সালে ব্যানবুরি ও অক্সফোর্ড থেকেও নির্বাচন করে হেরে যান।

তবে মূলত খেলা ছাড়ার পর বেশী সময় দিয়েছেন লেখালিখি ও সাংবাদিকতায়। কমপক্ষে দশটি উপন্যাস, ক্রিকেট ও খেলা বিষয়ক বইয়ের লেখক ছিলেন ফ্রাই। সাংবাদিক হিসেবে বিবিসিতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন; রিপোর্টিংও করেছেন। স্টান্ডার্ড ম্যাগাজিনের ক্রীড়া প্রতিবেদক ছিলেন। ইভিনিং স্টান্ডার্ডে কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন।

এখানেই শেষ নয়। নিজে খুব সাড়া জাগানো দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সিবি ফ্রাইস ম্যাগাজিন ও দ্য ক্যাপ্টেন ছিল তার দুটি পত্রিকা।

অনেকে দাবি করেন, হলিউডি একটা ছবিতে অভিনয়ও করেছেন ফ্রাই। কিন্তু এই সম্পর্কে খুব বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

হিটলারের সাথে দেখা করে নাজি স্যালুট দিয়ে খুব বিতর্ক তৈরী করেছিলেন ফ্রাই। হিটলারকে ক্রিকেটে আগ্রহী করার নাকি খুব চেষ্টা করেছিলেন।

১৯২০ সালের দিকে মানসিক রোগটা তীব্র হতে শুরু করে। একেবারে কলেজ জীবন থেকেই মানসিক রোগ তার সঙ্গী ছিল। যে কারণে অসাধারণ ছাত্র হওয়া স্বত্বতেও ফলাফল খুব ভালো ছিল না। দীর্ঘদিন এই রোগ নিয়ে চলেছেন। ১৯৫০ সালে মার্কারি থেকে অবসর নেন।

আর সুস্থ জীবনে থাকতে পারছিলেন না। ১৯৫৬ সালে, ৮৪ বছর বয়সে যখন মারা যান, তখন প্রায় অপ্রকৃতস্থই ছিলেন। শেষ জীবনে কী নিজের এই বর্নাঢ্য কীর্তিময় জীবন ফিরে দেখতে পেতেন?

বলা মুশকিল। তবে আমরা দেখতে পাই যে, এক জীবনে বহু জীবন কেমন করে যাপন করে গেছেন একজন সিবি ফ্রাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link