বিশাল বিশাল সব ইনিংস খেলার অভ্যাসটা তাঁর ছোটবেলা থেকেই। বয়স যখন ১৩ কি ১৪ সেই সময়ই ত্রিপল সেঞ্চুরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি। তখন থেকেই তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু। আস্তে আস্তে টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপের মূল ভরসা হয়ে উঠেছিলেন চেতেশ্বর পূজারা।
এখনকার সময়ে এসে সবাই যখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত তখন একলা পথিকের মত সাদা পোশাকের ক্রিকেটের দিকে হেঁটে গেছেন। তাও ভারতের মত দেশে যেখানে প্রতিটা ক্রিকেটারের স্বপ্ন দেখেন আইপিএল খেলার। আইপিএলে কোটি টাকার হারছানি, এত আলো কিছুই পূজারার মনোযোগে চিড় ধরাতে পারেনি। টেস্ট ক্রিকেটটা খেলে গিয়েছেন সাধনার মত করে, বারবার তাঁর ব্যাট বলেছে, ‘দেখো, এভাবেই খেলতে হয়।’
টেস্টে ভারতের তিন নম্বর পজিশনটা মোটামুটি নিজের করে নিয়েছিলেন। প্রায় এক যুগ ধরে এই পজিশনটায় ভারতের মত দলের হয়ে খেলছেন। ব্যাটিং লাইন আপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন। অন্তত ২০১৯ সাল পর্যন্ত টেস্টের পূজারাকে নিয়ে নূন্যতম প্রশ্ন করার সাহসও কেউ পায়নি। ভারতের মাটিতে, বিদেশের মাটিতে যেখানেই টেস্ট হোক পূজারার ব্যাট হাসবেই।
২০১২ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫৯ রানের ইনিংস খেলে নিজের আগমনী বার্তাটা দিয়েছিলেন। একেবারে ক্ল্যাসিক কিংবা টেকনিক্যালি খুব শার্প ব্যাটসম্যান ছিলেন না কখনোই। তবে পূজার উইকেট আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারতেন। টেস্টে বিশ্বের যেকোনো বোলিং লাইন আপ তাঁর উইকেট নিয়ে হিমশিম খেয়েছে। কিউইদের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পরের সিরিজেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ২০৬ রানের ইনিংস।
বয়স ভিত্তিক দলের হয়ে যে সুনামটা কুড়িয়েছিলেন সেটা হলো বড় ইনিংস খেলতে পারার ক্ষমতা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেও সেই মুকুটে কাউকে স্পর্শ করতে দেননি। ওই ম্যাচে পরের ইনিংসেও ৪১ রানে অপরাজিত ছিলেন। এরপরের ম্যাচে আবার ১৩৫ রান। মানে অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার, অবিশ্বাস্য এক ব্যাটসম্যান খুঁজে পেল ভারত।
বাইরে থেকে যারা তাঁর ব্যাটিং এর সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলতো তাঁদের সবাইকে চুপ করিয়েছিলেন এই শত শত রান দিয়ে। এরপর আর কেউ পূজারার ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। সেঞ্চুরি তো করতেনই। তবে মজার ব্যাপার ছিল তাঁর ইনিংস বড় করার ক্ষমতা। সেঞ্চুরি করলে সেই ইনিংসে দেড়শ থেকে দুশোতে নিয়ে যেতেন নিয়মিত। মানে পূজারা একবার উইকেটে থিতু হতে পারলেই প্রতিপক্ষের বোলারদের মাথায় হাত। বলা হয় টেস্ট ক্রিকেটে যে ঠিক বলটা ছাড়তে জানেন, তিনিই সেরা ব্যাটসম্যান। আর চেতেশ্বর পূজারা লিভ করায় ছিলেন মাস্টার।
কিন্তু সেই পুজারাই যেনো হারিয়ে যেতে শুরু করেছেন! যেনো শেষের শুরু দেখতে শুরু করেছেন।
২০১৯ সাল অবধি ভারতের হয়ে মোট ৬৮ টি টেস্ট খেলেছেন। এই সময়ে ৫১.১৮ গড়ে রান করেছেন। ২০টি হাফ সেঞ্চুরির সাথে ছিল ১৮টি সেঞ্চুরি। বলা হতো ভারতের আধুনিক ক্রিকেটের রাহুল দ্রাবিড় তিনি। তবে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ সেঞ্চুরিটা করলেন। সিডনিতে তাঁর ১৯৩ টি তে চোখ জুড়িয়েছিলে ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীরা।
এক নজরে পুজারা
- শেষ এক বছর: ১৪ টেস্টে ২৮.৫৮ গড়ে ৬৮৬ রান
- শেষ দুই বছর: ১৯ টেস্টে ৩৩.৬৩ গড়ে ৯০৪ রান
- শেষ তিন বছর: ২৭ টেস্টে ৩২.৪৮ গড়ে ১৪৬২ রান
- শেষ চার বছর: ৩৯ টেস্টে ৩৩.৭৩ গড়ে ২১৯৩ রান
এরপরই কেমন যেন অচানা হয়ে গেলেন পূজারা। টেস্টে তাঁর সবচেয়ে গর্বের জায়গা, ইনিংস বড় করতে পারা। সেটিই কোথায় হারিয়ে ফেললেন। অজিদের বিপক্ষে সেই টেস্টের পরেও ভারতের হয়ে ২৫ টি টেস্ট খেলে ফেলেছেন। নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটানোর কথা ছিল তাঁর। তবে এই সময়ে একটি সেঞ্চুরির দেখাও পাননি পূজারা। ১১ টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন তবে তাঁর একটাকেও বড় করতে পারেননি। ফলে এই সময়ে ব্যাটিং গড়ও অনেক কমেছে। শেষ ২৫ টেস্টে পূজারা রান করেছেন মাত্র ২৭ গড়ে। এই সময়ে তাঁর সর্বোচ্চ ৯১ রানের একটি ইনিংস আছে শুধু।
ভারতের এই সময়ের রাহুল দ্রাবিড়ের প্রদীপের আলো কী তাহলে ফুরিয়ে আসছে। প্রায় তিন বছর সেঞ্চুরি করতে না পারাটা অন্তত পূজারার সাথে যায় না। ভারতের প্রধান কোচ হয়ে এসেছেন এখন রাহুল দ্রাবিড়। রাহুল দ্রাবিড়ের সামনেই কী পূজারার আলোটা একদিন ফুরিয়ে যাবে?