সাদা পোশাকের নীরব পূজারী

আইপিএলের দুনিয়া তাঁকে গ্রহণ করে না আর। নিলামের টেবিলে তাঁর নাম উঠলে পাশে ট্যাগ পড়ে যায় ‘আনসোল্ড’। যদিও ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে শতরান আসে তাঁর ব্যাট থেকেও। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রঙিন দুনিয়াতেও তিনি ব্রাত্য। পাঁচটার বেশি ম্যাচ তাঁর কপালে জোটেনি, যদিও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তাঁর গড়টা বিরাট কোহলির প্রায় কাছাকাছিই।

কিন্তু, সাদা পোশাকের সনাতনী ক্রিকেটে ভারতের প্রথম উইকেটটি পড়লে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসা ঐ ডান হাতি ব্যাটসম্যানটিই সবচেয়ে ভরসার পাত্র হয়ে ওঠেন ভারতের। রণে বনে জলে জঙ্গলের মত দেশের মাটিতে, অস্ট্রেলিয়ায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, শ্রীলঙ্কায় সৌরাষ্ট্রের অরবিন্দ পুজারার সুযোগ্য সন্তানই বহু সময় হয়ে ওঠেন ব্যাটিংয়ের ত্রাতা।

কানের দুল বা ট্যাটু বর্জিত দুনিয়ার এমন এক প্রতীক, যাকে টি-টোয়েন্টির এর ঝংকার স্পর্শ করে না। বহু মানুষের কাছেই সেই ‘বোরিং’, ‘ব্যাকডেটেড’ চেতেশ্বর পুজারাই টেস্ট ক্রিকেটের এক নীরব সাধক। ব্যাটিংই যাঁর কাছে সাধনা, আর ক্রিকেটের বাইশ গজই হল তাঁর কাছে মন্দির। সেই মন্দিরেরই একনিষ্ঠ পূজারী হলেন চেতেশ্বর পুজারা।

ছোটবেলায় খুব ভিডিও গেমস খেলতে ভালোবাসতেন। কিন্তু, মা রিনা পুজারা সেই গেমস থেকে ছেলের মন সরাতে প্রতিদিন পুজো পাঠে মন দিতে বলেন। পূজারী পুজারার শিকড়টা বোধহয় রিনা পুজারা ওভাবেই তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আজও তাই ব্যাট হাতে একনিষ্ঠ থেকে যান ঠাকুরঘরের ধুপ ধুনো হাতে পুজো করার মতোই।

রিনা পুজারা পৃথিবীর মায়া বহুদিন হলো ত্যাগ করে গেলেও সেই শৃঙ্খলতা থেকে সরে আসেননি তাঁর আদরের চিন্টু। বাবা অরবিন্দ পুজারাই মা বাবা ও ক্রিকেট কোচের ত্রিমুখী ভূমিকা পালন করে লালন করে তুলেছেন চেতেশ্বরকে। বাবা অরবিন্দই তাঁর ফ্রেন্ড ফিলোসোফার অ্যান্ড গাইড।

২০০৫-০৬ সাল থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের দ্যুতি ছড়ানো পুজারা প্রথম লাইম লাইটে আসেন ২০০৬ এর অনুর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপে। ৩৪৯ রান করে সেখানে প্রতিযোগিতার সেরা হন। এরপর রঞ্জি ট্রফি ও ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে চোখ ঝলসানো সব পারফরমেন্সের পরে নির্বাচকরা আর তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেননি।

২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া এর বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজেই সুযোগ এল। আর প্রথম সুযোগেই বাজিমাত সৌরাষ্ট্রের তরুণের। ব্যাঙ্গালুরুর সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেই দুর্দান্ত অসি আক্রমণ সামলে ম্যাচ জেতানো ৭২ এল। তারপরেও ভারতের মিডল অর্ডারে ‘ট্রাফিক জ্যাম’ এর জন্য দেড় বছরের ও বেশি লেগে গেল পরবর্তী সুযোগ আসতে।

আবারো উপেক্ষার জবাব দিল তাঁর ব্যাট। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঝকঝকে ১৫৯ এল তাঁর ব্যাট থেকে। ভারতীয় ক্রিকেটে দ্রাবিড় সভ্যতা ততদিনে অবসান ঘটেছে। প্রথম উইকেট পতনের পর যেভাবে এক কর্ণাটকি যাবতীয় ঝড় ঝঞ্ঝা সহ্য করে লড়ে যেতেন সেই ফেলে আসা জুতোয় পা গলানোর কাজটা কিউইদের বিরুদ্ধে ঐ হায়দ্রাবাদ টেস্ট থেকেই ধীরে ধীরে শুরু করলেন ঐ কর্ণাটকিরই ভাবশিষ্য।

নিউজিল্যান্ড সিরিজের পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের তিন নম্বর জায়গাটায় মোটামুটি আসন পেতে বসলেন ‘পূজারী’ পুজারা। পরের বছরে ভারত সফররত ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমেদাবাদের সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়াম দেখল পুজারার অসামান্য দাপট। ব্রিটিশ বোলারদের তুলোধোনা করে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা কুড়িয়ে নিলেন তিনি, থামলেন ২০৬ করে।

দ্বিশতরানের মোহ বোধহয় পুজারাকে ছাড়েনি, তাই মাস ছয়েক যেতে না যেতেই দুরন্ত অস্ট্রেলিয়া এর ঝাঁজ সামলে আবার এল ২০৪। বড় বড় সব ইনিংস খেলতে বরাবরই ভালোবাসেন তিনি, অল্পেতে সন্তুষ্ট নন। সেঞ্চুরিকে ডাবল সেঞ্চুরি বা ট্রিপল সেঞ্চুরিতেও রূপ দিতে তাঁর ব্যাট সিদ্ধহস্ত।

ঘরোয়া ক্রিকেটে গোটা তিনেক ত্রিশতরান তাই তাঁর নামের পাশে সহজেই যোগ হয়। নীরবে বোলারদের যাবতীয় উদ্যম আর প্রতিরোধ কেড়ে নিতে তাঁর মত সাধকই বোধহয় পারে, ব্যাটিংয়ের সময় আউট না হতে চাওয়া যেন তাঁর ‘ধনুকভাঙা পণ’।

দেশের মাটিতে চোখ ঝলসানো সব পারফরমেন্সের পাশাপাশি বিদেশেও পুজারা বিপক্ষের গোলা গুলির সামনে নীরব যোদ্ধার বর্ম পড়ে যেন দাঁড়িয়ে থাকেন। আর ঠাণ্ডা মাথায় সামলে দিতে পারেন দ্রাবিড় মন্ত্রে দীক্ষিত এই ‘পূজারী’। ২০১৩ এর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে স্টেইন মরকেলদের সামলে কখনো দুর্দমনীয় হয়ে উঠতে পারেন। ওয়ান্ডারার্স এ দেশবাসীকে উপহার দিতে পারেন সোনার মত দামি ১৫৩। আবার শ্রীলঙ্কান সিংহ রঙ্গনা হেরাথের স্পিন ছোবল সামলে অনবদ্য অপরাজিত ১৪৫ আসে তাঁর উইলো থেকেই।

ইংল্যান্ডের আন্ডারসন-ব্রডের সুইং সামলে সাউথাম্পটনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে ১৩২ রানের মণিমুক্তো খচিত ইনিংসের পাশেই ঐতিহাসিক হয়ে যায় ২০১৮ এর অস্ট্রেলিয়া সফরে স্টার্ক-কামিন্স-হ্যাজেলউড-লিওনের হাড় হিম করা আক্রমণ সামলে গোটা সিরিজ জুড়ে ১২৫৮ টা বলকে সামলানো। আসলে সেই অস্ট্রেলিয়া সফরটাই পুজারার নামে লেখা যেতে পারে, যেখানে দুর্ধর্ষ অসি আক্রমণ বারংবার পুজারা নামক এক প্রাচীরের কাছে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছিল।

সঙ্গে যোগ হয়েছিল তিনটে শতরানের ইনিংস, যার মধ্যে সিডনির ১৯৩ না মেলবোর্নে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাটিং সাধনার দ্বারা ১০৬ রানের গড়ে তোলা ইমারত। কোনটা শ্রেষ্ঠ হতে পারে তা নিয়ে বিতর্ক সভা বসানো যেতেই পারে।

খারাপ সময় ও পুজারার সঙ্গী হয়েছে অনেকবার। বিলম্ব না করে টেকনিকে শান দিতে ছুটে গেছেন গুরু দ্রাবিড়ের কাছে আবার কখনো ইংল্যান্ড সফরের ব্যর্থতায় কাউন্টি ক্রিকেটেরও দ্বারস্থ হয়েছেন। কখনো কখনো তাঁকে নিয়ে অভিযোগ উঠেছে বড্ড ধীর গতিতে খেলেন, দলের বাইরেও যেতে হয়েছে। কিন্তু, দল যখন বিপদে পড়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট আবার সেই নীরব যোদ্ধারই শরণাপন্ন হয়েছে, এবং রক্ষাকর্তার ভূমিকায় বারংবার অবতীর্নও হয়েছেন তিনি।

যেমন, স্পিন সহায়ক কঠিন পিচে অস্ট্রেলিয়া বোলিংয়ের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াকু ২০২ রানের ম্যারাথন ইনিংসের মধ্যে দিয়ে তাঁর মানসিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, কাঠিন্যের চরম সব পরীক্ষায় যেন লেটার মার্কস নিয়েই উত্তীর্ণ হন তিনি। যেখানে নাথান লিঁওকে মারা একটা কভার ড্রাইভ বা মিশেল স্টার্কের ভেতরে ঢুকে আসা বলে একটা ফ্লিক শতশত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়।

আসলে চেতেশ্বর পুজারারা সহজে হারার জন্য জন্মাননি। লড়াইটা তাঁর ঐ সাধনারই এক অংশ হয়ে গেছে বছরের পর বছর। আর সেই লড়াকু ব্যাটিং এর এক একটা ইনিংস যেন তাঁর কাছে ‘অন্তবিহীন পথে চলাই জীবন’।

কুড়ি বিশের ক্রিকেটের ঝলমলে মণ্ডপ থেকে অনেক দূরে নিক্ষিপ্ত পুজারার মতো ক্রিকেটারের চোয়াল চাপা প্রতিজ্ঞা, ত্যাগ দ্বারা গঠিত একেকটা টেস্ট ইনিংসের ইমারতকে তাই কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আর পারেনা বলেই ভারতীয় টেস্ট দলে প্রথম উইকেটটা পড়লে ড্রেসিংরুম থেকে শ্যাডো করতে করতে তাঁর নেমে এসে রাবাদা, বোল্ট, কামিন্স বা অ্যান্ডার্সনদের সামনে স্টান্স নিয়ে দাঁড়ানোটাই এক অনিবার্য ঘটনা।

যেন এক নির্ভীক যোদ্ধা তাঁর ঢাল তরোয়াল নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর সাদা পোশাকে টুকটুকে লাল বলটাকে ব্যাট নামক তরবারি দ্বারা বারবার প্রতিরোধ করে সাতমহলা বাড়ির মত দুর্দান্ত সব ইনিংস উপহার দেওয়া সেই যোদ্ধা পুজারা তাই যেন আবার দায়বদ্ধতা, সংকল্প, অধ্যবসায় এর মূর্ত প্রতীক ও, যেখানে আগুন ঝরানো বাউন্সার বা বিষ মাখানো স্পিনেরাও তাঁর ব্যাটে লেগে স্তব্ধ হয়ে যায়।

সেই দ্রাবিড় বংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার সলতে চেতেশ্বর পুজারা বছরের পর বছর সত্যিই যেন এক ব্যাটিং সাধনার নীরব পূজারী। আর বাইশ গজে তাঁর ম্যারাথন ইনিংসগুলো যেন নৈবেদ্যর ডালা সাজিয়ে বসে থাকার উপাখ্যান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link