বড় মঞ্চের বড় বিতর্ক

খেলাধুলার জগৎ তো আর ছেলেখেলা নয়। এখানে বিতর্ক থাকবেই। ক্রিকেটের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়।

আর মঞ্চ যত বড়, বিতর্কও তত বেশি। এই যেমন ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরেই এমন সব বিতর্ক দানা বেঁধেছে যা শুনলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। সেসব নিয়ে এবারের আয়োজন।

  • গাভাস্কারের কচ্ছপগতির ব্যাটিং (১৯৭৫)

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ম্যাচ। মুখোমুখি স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও ভারত। আগে ব্যাট করে ৬০ ওভারে ইংল্যান্ড বোর্ডে জমা করে ৩৩৪ রান। জবাবে পুরো ৬০ ওভার ব্যাট করে মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে ভারত করে মোটে ১৩২ রান। আশ্চর্যজনকভাবে এর পেছনে দায়ী ভারতের ব্যাটিং জিনিয়াস সুনীল গাভাস্কার।

সেদিন ১৭৪ বল খেলে মাত্র ৩৬ রান করেন এই ব্যাটিং মায়েস্ত্রো। আসলে তিনি কি চিন্তা করে এমন শম্বুকগতির ব্যাটিং করেছেন তা কেবল তিনিই জানেন। তাই গাভাস্কারের সে ইনিংসটি শুধু বিতর্কিত নয়, রহস্যজনকও বটে।

  • মিয়াঁদাদের লম্ফঝম্ফ (১৯৯২)

পাক-ভারত লড়াই মানেই বাড়তি উন্মাদনা। তা শুধু মাঠের বাইরে সীমাবদ্ধ নয়, মাঠের ভেতরেও তার অস্তিত্ব মেলে। এই যেমন ১৯৯২ বিশ্বকাপে। সেদিন শচীন টেন্ডুলকারের বল খেলতে বেশ সংগ্রাম করতে হচ্ছিল জাভেদ মিয়াঁদাদকে। এতে উইকেটের পেছন থেকে তীর্যক কিছু মন্তব্য হয়ত ছুঁড়ে বসেছিলেন ভারতের উইকেটরক্ষক কিরণ মোরে।

সেই সাথে অযথাই অনবরত আবেদন করতে থাকেন তিনি। এতে মিয়াঁদাদ বিরক্ত হয়ে মোরেকে বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটটা মানুষের খেলা, জীবজন্তুর নয়।’ এক পর্যায়ে মোরের আবেদনের ভঙ্গি নকল করে ব্যাঙের মত লাফিয়ে মোরেকে ব্যঙ্গ করেন তিনি।

  • বিতর্কিত বৃষ্টি আইন (১৯৯২)

দীর্ঘ ২২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে থাকায় এটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা প্রথম কোন বিশ্বকাপ। আর প্রথম অংশগ্রহণেই সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় তারা।  ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচে এক পর্যায়ে তাদের দরকার পড়ে ১৩ বলে ২২ রান, হাতে ৪ উইকেট। ঠিক এমন সময় বাঁধ সাধে বৃষ্টি।

সিডনির আকাশ থেকে প্রায় ১২ মিনিট বৃষ্টি ঝড়ার পর খেলা পুনরায় শুরু হয়। তখন বৃষ্টি আইনে প্রথমে স্কোরবোর্ডে ৭ বলে ২২ রানের পরিবর্তিত টার্গেট দেখানোর কিছুক্ষণের মধ্যে সেটি বদলে দেখানো হয় ১ বলে ২২। এভাবে বৃষ্টি আইনে মুহূর্তেই বলি হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ফাইনালে খেলার স্বপ্ন।

  • নৈশভোজ বয়কট (১৯৯২)

ঘটনাটি ১৯৯২ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাতের। মেলবোর্নে প্রাক-ফাইনাল নৈশভোজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান। সে অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে অজি কমেডিয়ান গ্যারি কলোনি আসেন ইংল্যান্ডের রাণীর বেশে।

মজা করতে করতে একসময় ইংল্যান্ডের রাণীকে নিয়ে নানা ধরনের রসিকতা শুরু করে দেন তিনি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অনুষ্ঠান থেকে সোজা বেরিয়ে যান ইংল্যান্ডের অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ ও স্যার ইয়ান বোথাম।

  • নিরাপত্তা ইস্যুতে ম্যাচ বয়কট (১৯৯৬)

সেবার ক্রিকেটের বিশ্ব আসর বসেছিল যৌথভাবে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায়। ঠিক বিশ্বকাপের প্রাককালে কলম্বোর সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার মূল গেইটের সামনে বিস্ফোরক বহনকারী ট্রাক নিয়ে হামলা চালায় লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম।

এর ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে শ্রীলঙ্কায় প্রাথমিক পর্বের খেলাগুলো খেলতে অস্বীকৃতি জানায় অস্ট্রেলিয়া ও উইন্ডিজ। শ্রীলঙ্কার সরকার ও আইসিসি সর্বোচ্চ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার পরেও এ দুটি দল স্বাগতিকদের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে যায়নি শ্রীলঙ্কায়। ফলে উভয় খেলায় শ্রীলঙ্কাকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

  • ইডেনে সমর্থকদের তাণ্ডবলীলা (১৯৯৬)

আসরের প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও শ্রীলঙ্কা। স্বাগতিক দলের সমর্থনে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ভারতও সমর্থকদের প্রত্যাশা আনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছিল খুব ভালভাবে। ২৫২ রান তাড়া করতে নেমে শচীন টেন্ডুলকার আউট হবার আগ পর্যন্ত ম্যাচে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ভারত। যেই শচীন আউট হন অমনি ধস নামে তাদের ব্যাটিংয়ে।

৯৮ রানে ২ উইকেট হারানো ভারত পরে মাত্র ২২ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে। এতে হতাশা ও ক্ষোভে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে গ্যালারির দর্শকরা। মাঠে অনবরত বোতল ছোড়ার পাশাপাশি গ্যালারির চেয়ার ভাংচুর করে সেখানে আগুণ ধরিয়ে দেন তারা। ফলে আম্পায়াররা খেলা বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামলে উঠতে না পারায় ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করেন।

  • ক্রনিয়ের ‘ইয়ারপিস’ বিতর্ক (১৯৯৯)

হ্যান্সি ক্রনিয়ে ও বব উলমার জুটি বরাবরই বিভিন্ন উদ্ভাবনী কৌশল অবলম্বনের জন্য বিখ্যাত। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে যেটা আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। ওই আসরে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে কানে ‘ইয়ারপিস’ লাগিয়ে মাঠে নামেন হ্যান্সি এবং ডাগ আউট থেকে দেয়া উলমারের একের পর এক নির্দেশনা শুনতে থাকেন।

ভারতের হয়ে ইনিংসের গোড়াপত্তন করা সৌরভ গাঙ্গুলির চোখে সেটা ধরা পড়ে এবং সাথে সাথে তিনি তা আম্পায়ারদের অবহিত করেন। পরবর্তীতে আম্পায়াররা ম্যাচ রেফারি তালাত আলির সাথে পরামর্শ করে হ্যান্সিকে ওই ‘ইয়ারপিস’ খুলে ফেলতে বাধ্য করেন।

  • শেন ওয়ার্নের নিষেধাজ্ঞা (২০০৩)

২০০৩ বিশ্বকাপটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার জন্য শিরোপা ধরে রাখার মিশন। তবে আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচের ঠিক আগেরদিন বেশ বড়সড় একটি ধাক্কা খেয়ে বসে তারা। নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনের দায়ে এক বছরের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয় অজি লেগস্পিনার শেন ওয়ার্নকে।

গেল আসরের সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচের নায়ককে হঠাৎ এভাবে হারানোয় অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ পরিকল্পনায় কিছুটা ছেদ পড়ে। যদিও খুব দ্রুতই সে ধাক্কা কাটিয়ে পরবর্তীতে বিশ্বকাপ শিরোপা বাগিয়ে নেয় রিকি পন্টিংয়ের দল।

জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্রের মৃত্যু (২০০৩)

বিশ্বকাপে নামিবিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে প্রতিবাদস্বরূপ বাহুতে কালো কাপড় বেধে নামেন জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও পেসার হেনরি ওলোঙ্গা। ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রতিবাদ সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করে দেন তাঁরা।

তাঁদের এই প্রতিবাদ ছিল মূলত জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রপতি রবার্ট মুগাবের স্বৈরশাসন ও গনতন্ত্র হননের বিপক্ষে। সে বিশ্বকাপের পর স্বৈরশাসকদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় আর জিম্বাবুয়ের জার্সি গায়ে মাঠে নামা হয়নি ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গার।

  • কেনিয়া যেতে আপত্তি (২০০৩)

বিশ্বকাপের সেবারের আসর বসেছিল যৌথভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ায়। অকস্মাৎ টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাদের মাটিতে খেলতে অস্বীকৃতি জানান ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেইন। রবার্ট মুগাবে সরকারের সঙ্গে ঝামেলার কারণে ওই ম্যাচ খেলতে জিম্বাবুয়েতে যায়নি ইংল্যান্ড। এতে করে ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে জয়ী ঘোষণা করা হয়।

ঠিক একই ঘটনা ঘটে এর কিছুদিন পর। এবার দৃশ্যপটে নিউজিল্যান্ড। নিরাপত্তার অযুহাতে কেনিয়ার বিপক্ষে নাইরোবিতে মাঠে নামেনি তারা। এতে জিম্বাবুয়ের মত কেনিয়াকেও বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

  • ফ্লিনটফের মাতলামি (২০০৭)

আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারার পর মাঝরাতে ইংল্যান্ডের সহ অধিনায়ক অ্যান্ড্রো ফ্লিনটফকে মদ্যপ অবস্থায় সেন্ট লুসিয়ার একটি সমুদ্র সৈকতে পেডালো নিয়ে ভাসতে দেখা যায়। আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে তাকে সেসময় এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। সেইসাথে কেড়ে নেয়া হয় সহ অধিনায়কের দায়িত্বও।

  • বব উলমারের রহস্যময় মৃত্যু (২০০৭)

বিশ্বকাপের সেবারের আসরটি ছিল পাকিস্তানের জন্য দুঃস্বপ্নের মত। গ্রুপপর্বের বাধাই যে টপকাতে পারেনি ইনজামাম উল হকের দল। এমন কি প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে খেলতে আসা আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে হোঁচট খেতে হয় ১৯৯২ বিশ্বকাপ জয়ীদের। সে ম্যাচের পর সবাই যখন  পাকিস্তানের ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত করতে ব্যস্ত ঠিক সে সময় আকস্মিকভাবে মৃত্যবরণ করেন দলটির কোচ বব উলমার।

জ্যামাইকার পেগাসাস হোটেলের দ্বাদশ তলার ৩৭৪ নাম্বার রুমের বাথরুম থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারপর তার মৃত্যুর কারণের অনুসন্ধান নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। কখনও গণমাধ্যমে খবর আসে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ ফিক্সড করার ঘটনা যেন প্রকাশ করতে না পারেন সে জন্য তাকে খুন করা হয়েছে। কখনও আসে সাপের দংশনে নয়ত হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় উলমারের মৃত্যু হয়েছে। তারপর একই বছরের নভেম্বরে পর্যাপ্ত প্রামাণ্য দলিলের অভাবে ‘ওপেন ভারডিক্ট’ হিসেবে ঘোষণা করে মামলাটি শেষ করেন জ্যামাইকার বিচারকমন্ডলী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link