ক্রিপ্টোনাইটে আটক এক ‘সুপারম্যান’

জনপ্রিয় কমিক চরিত্র ‘সুপারম্যান’। সে চরিত্র সম্পর্কে আমরা অল্প-বিস্তর সবাই জানি। এটাও জানি তাঁর সবচেয়ে বড়  দূর্বলতা ‘ক্রিপ্টোনাইট’। ঠিক তেমনি ফুটবলারদের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা বা ভয়ের কারণ ইনজুরি। কতশত খেলোয়াড়দের যে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটিয়েছে এই ইনজুরি তার কোন ইয়ত্তা নেই। ওসমান ডেমবেলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

তেমন আরও একটি উদাহরণ হচ্ছে লিভারপুল তারকা স্ট্রাইকার ড্যানিয়েল স্টারিজ। দুই দফা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। আরও একবার অন্তত জিততেই পারতেন তিনি। না সেখানটায় বাঁধ সাধে এই যে ইনজুরি নামক ক্রিপ্টোনাইট। যা সুপারম্যান হতে দেয় না ফুটবলারদের।

কেবল মাত্র ৩২ বছর বয়স তাঁর। তবুও তিনি যেন একেবারে মুষড়ে গেলেন। ছিলেন ফুটবল থেকে বিরতিতেও। অতঃপর ফুটবলের মাঠে ফিরে এলেন ঠিকই কিন্তু ইউরোপে নয়। তিনি বর্তমানে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। খেলছেন এ লিগ। তবে প্রতিভাবান এই ফুটবলারের অন্তত আরও বছর চারেক খেলার কথা ছিল ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ের কোন লিগে।

যুব পর্যায়ে ভিন্ন সব ক্লাবে খেলে তিনি নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারটা শুরু করেছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে। স্টারিজ যখন ম্যান সিটির জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন তখনও আরব অর্থের ছোঁয়া লাগেনি সিটিজেনদের গায়ে। ২০০৭ সালে তিনি প্রথমবার মাঠে নেমেছিলেন বদলি খেলোয়াড় হিসেবে। তখনও তিনি নিয়মিত হতে পারেননি শুরুর একাদশে। ২০০৮ সালের দিকে নিয়ম করে তিনি সুযোগ পেতে শুরু করেন।

ততদিনে অবশ্য শেখ মনসুরের অর্থের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে দিয়েছে। ক্লাবের উত্থানের সাথে যেন স্টারিজও হাটতে থাকেন উত্থানের পথে। তবে তা স্থায়ী হয়নি। সিটির আকাশে নীল জার্সি ছেড়ে স্টারিজের গায়ে এবারে ওঠে গাঢ় নীল জার্সি। ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে ততক্ষণে ঘাটি গেড়ে বসেছেন ড্যানিয়েল স্টারিজ। প্রথম মৌসুমেই তিনি ব্লুজদের এফ এ কাপ শিরোপা জয়ে রাখেন ভূমিকা।

বনে যান সেরা গোলদাতা। পাউন্ডের হিসেবে আট মিলিয়নের আশেপাশে দামে কেনা খেলোয়াড়কে ধারে খেলতে বোল্টনে পাঠায় চেলসি। সেখানে তিনি নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন ১২ ম্যাচে আট গোল করে। এরপর তিনি আবার ফেরেন চেলসিতে। তখন অবশ্য একটা দোলাচলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল চেলসি। ১৮ মাসের মধ্যে তিনজন ভিন্ন কোচের আগমন ও প্রস্থান দেখেছিল ক্লাবটি।

সে ক্লাবটির হয়েই তিনি জিতেছিলেন প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। তবে সেবার তিনি তা জিতেছিলেন সাইড বেঞ্চে বসে থেকে। ইনজুরি, নিষেধাজ্ঞা আর ভিন্ন সব পজিশনের ভিন্ন সময়ের খেলার কারণে তাঁকে ক্লাব ছাড়তে হয় সে মৌসুম শেষে। সেখান থেকে তাঁকে জায়গা করে দেয় অলরেডরা। এফ এ কাপটা সম্ভবত খুব প্রিয় ছিল স্টারিজের। লিভারপুলের হয়ে প্রথম গোলটা আসে সে টুর্নামেন্টেই।

এরপর নিজের প্রতিভার ঝলক দেখাতে শুরু করেন স্টারিজ। ২০১৩-১৪ মৌসুমে রেডদের হয়ে ২১ গোল করে সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিলেন। পুরস্কার হিসেবে তিনি ডাক পান ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ইতালির বিপক্ষে গোলের দেখা পান তিনি। আর সেখান থেকেই পতনের শুরু। শুরুটা করে দিয়েছিল উরুর ইনজুরি।

এরপর একেরপর এক বৃষ্টির মত ইনজুরির বর্ষণ হতে থাকে স্টারিজের শরীরে। হ্যামস্ট্রিং, হাঁটুর ইনজুরি, এসেও যুক্ত হতে থাকে। এত কিছুর পরও ১৩ গোল করে লিভারপুলের সেরা গোলদাতা হিসেবেই ২০১৫-১৬ মৌসুম শেষ করেছিলেন স্টারিজ। এমন সময়েই ইয়ুর্গেন ক্লপ এসে হাজির হয় লিভারপুলের ডাগআউটে। তিনি এসে স্টারিজের নানাবিধ সমস্যা দেখে তাঁর বিকল্প হিসেবে দলে জায়গা করে দেন রবার্তো ফিরমিনোকে।

এরপরই যেন খানিকটা বিপরীত মুখে হাটতে থাকে স্টারিজের ক্যারিয়ার। লিভারপুল ছাড়ার পর তিনি চলে যান তুরস্কে। সেখানকার এক ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি। এরপর স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়াতে যাওয়া নিয়ে বাজি ধরার এক ঘটনায় চার মাসের নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হন তিনি।

এরপর তাঁর সাথে থাকা তুর্কি ক্লাবটির চুক্তিরও সমাপ্তি ঘটে, আর আগমন ঘটে মহামারীর। সে ধাক্কা কাটিয়ে ফুটবল মাঠে ফিরলেও খানিক কালক্ষেপণ করেন স্টারিজ।

এরপর এই মৌসুমে তিনি যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ান এ লিগে। সেখানের শুরুতেও তাকে আঘাত করে করোনা। আর প্রায় তিন মাসের জন্য মাঠের বাইরে ছিলেন তিনি। ফিরেও নিজের হারানো জৌলুশের ছিটেফোঁটার দেখাও পাননি। সম্ভাবনার মৃত্যু বোধকরি এভাবেই হয়। বিশ্বমানের এক স্ট্রাইকার এতটাই নিভৃতে হারিয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link