ডেভিড গাওয়ার, সুন্দর হে!

ব্যাট হাতে শিল্পীদের তালিকা হাতে বসলে তার মধ্যে একটা নাম জ্বলজ্বল করবে – ডেভিড গাওয়ার। তিনি নিজেও দেখতে ভীষণ সুন্দর। একঝাক সোনালী কোঁকড়ানো চুল, নিস্পাপ কিশোরের মুখশ্রী, ছিপছিপে শরীরের গঠন – কিন্তু এইসব ছাড়িয়ে সুন্দর ছিল তাঁর ব্যাটিং।

সাধারণত একদিনের ক্রিকেট শিল্পীদের প্রিয় ফরম্যাট নয়, তারা নিজের মেজাজে ইনিংস গড়তে এবং সাজাতে ভালোবাসেন। কিন্তু ডেভিড গাওয়ারের একটি একদিনের ম্যাচের ইনিংস এই নিয়মের ব্যাতিক্রম। ব্রিসবেনে ১৯৮৩ সালের বেন্সন এন্ড হেজেস কাপের নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৫৮রানের (১১৮ বলে) একটি ইনিংস খেলান গাওয়ার। উইজডেনের ১০০ সেরা একদিনের ম্যাচের ইনিংসের তালিকায় এই এই ইনিংসটির স্থান ছয় নম্বরে – কপিলদেবের ১৭৫এর দুই ক্রম নিচে।

সেদিন অবশ্য কোঁকড়া চুল ঢেকে ফ্ল্যাপ টুপি পরে নেমেছিলেন গাওয়ার। সম্ভবত দর্শকদের মনোযোগ যেন তার ব্যাটিং ছেড়ে শরীরের দিকে না যায় সেটা নিশ্চিত করতেই এই ব্যাবস্থা। ইনিংসটির আরম্ভে কয়েকটি রাজকীয় পুল দেখতে পাবেন। রাজকীয় কারণ খেলার ভঙ্গীতেই প্রচ্ছন্ন যে গাওয়ার শাসন করছেন বোলারদের। অবহেলায় বলকে নিক্ষেপ করছেন সীমানার বাইরে।

তারপর কিছু চোখ জুড়নো ড্রাইভ, কখনও বা মাটি ঘেঁষে, কখনও কিছুটা অংশ আকাশপথে পেরিয়ে বল আবার সীমানার দিকে ছুটে চলেছে। শটগুলি খেলে ছোটার প্রয়োজন নেই, টি শার্টের বুকের বোতাম খোলা অবস্থায় গাওয়ার কয়েক পা এগিয়ে এসে বোলারের দিকে স্মিত হেসে চাইছেন। যেন বলতে চাইছেন, এর চেয়ে ভালো কিছু পারো না? গাওয়ারের অন সাইড অপেক্ষাকৃত দুর্বল এই মনে করে কয়েকটি লেগের ওপর বল দিতেই দেখা গেল কয়েকটি অসাধারণ ফ্লিক।

এবার ইভান চ্যাটফিল্ড বোলিং মার্কের দিকে এগিয়ে গেলেন। একদিনের ক্রিকেটের অন্যতম কৃপণ বোলার এই চ্যাটফিল্ড। গাওয়ার অবশ্য নিজের বকেয়া আদায় করে নিতে জানেন। শুধু চার নয়, এবার চ্যাটফিল্ডকে অবহেলার সঙ্গে মাঠের বাইরে ছুঁড়ে ফেললেন। বোঝা গেল, আজ তুলি হাতে নয়, তলওয়ার হাতে শিল্প সৃষ্টি করবেন মনস্থ করে নেবেছেন গাওয়ার।

অবশেষে বল হাতে বোলিং মার্কের দিকে হেঁটে যেতে দেখা গেল সেই নি:শব্দ ঘাতককে – রিচার্ড হ্যাডলি। বহু তথাকথিত গ্রেট ব্যাটসম্যান সাধারন স্তরে নেমে আসতেন হ্যাডলির অভ্রান্ত নিশানা এবং স্যুইঙ্গের সামনে। এবার দেখা যাক স্যুইং-এর সুলতানের সামনে পড়ে রাজপুত্রের কী অবস্থা হয়!

গাওয়ারের ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা হাসি কিন্তু হ্যাডলিও মুছে দিতে পারলেন না। একবার বা দুইবার নয়, তিন-তিনবার হ্যাডলিকে গ্যালারিতে ফেলে দিলেন গাওয়ার। প্রত্যেকটি শটই লং লেগ থেকে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে অনায়াস স্বাচ্ছ্যন্দে খেলা। দেখা গেল ফলো থ্রুতে একটুও না দাঁড়িয়ে চটপট নিজের বোলিং মার্কের দিকে ফিরে যাচ্ছেন হ্যাডলি। সুলতান পরাস্ত হলেন রাজপুত্রের হাতে।

অবশেষে ইনিংসের শেষ বলে আউট হয়ে যখন গাওয়ার মাঠ ছাড়ছেন তখন মাঠের প্রত্যেকটি দর্শক দাঁড়িয়ে। করতালি দিচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের ফিল্ডাররাও। ব্যাট তুলে অভিনন্দন গ্রহণ করতে করতে মাঠের বাইরে বেরিয়ে আসছেন রাজপুত্র। ইনিংসটি খেলতে যে সামান্য পরিশ্রম হয়েছে সেটা বোঝা গেল তাকে কপালের ঘাম মুছতে দেখে। অবশ্য যেভাবে জগ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন তাতে সেই ধারণা সম্বন্ধেও সন্দেহ থেকে যায়।

সৌভাগ্যক্রমে ইনিংসটি ইউ টিউবে দেখতে পাবেন। এখনও না দেখে থাকলে অবশ্যই দেখে ফেলুন কারণ তলওয়ার হাতে শিল্প রোজ রোজ দেখা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link