দীপক চাহার, দ্য কামব্যাক কিং

২০০৮ সাল। রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাকাডেমির পরিচালক তখন গ্রেগ চ্যাপেল। এক মিডিয়াম পেসার আসলেন ট্রায়ালে। কিংবদন্তি গ্রেগ বললেন, ‘নাহ, তোমাকে দিয়ে পেশাদার ক্রিকেট হবে না।’

দু’বছর পর রঞ্জিতে ছেলেটার অভিষেক হল সেই রাজস্থান দলের হয়েই। কি একটা আবির্ভাব। ১০ রানে নিলেন আট উইকেট। হায়দ্রাবাদ অল আউট মাত্র ২১ রানে। যদিও ইনজুরি পরের তিনটা মৌসুমে এই দীপক চাহারের অগ্রগতি ব্যাহত করে। তবে, পথে অসংখ্য কাঁটা থাকার পরও তিনি ফিরেছেন বারবার।

গল্পটা এবার একদম শুরু থেকে বলা যাক।

১৯৯২ সালের সাত আগস্ট। উত্তর প্রদেশের আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন দীপক চাহার। বাবা লোকেন্দ্র চাহার ও মা পুষ্প চাহার। দীপক চাহারের বাবা লোকেন্দ্র চাহার ছিলেন বিমান বাহিনীর একজন কর্মকর্তা। কিন্তু তাঁরও এক সময় স্বপ্ন ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ার।

সুযোগ-সুবিধার কারণে তিনি নিজের এই স্বপ্নটি পূরণ করতে পারেননি ৷ কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে তার এই স্বপ্ন পূরণ করবে ক্রিকেটার হয়ে ৷ ক্রিকেটে সীমিত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও দীপকের মাত্র ১১ বছর বয়সেই তার বাবা ক্রিকেট কোচিং শুরু করে দেন। আরেক লেগ স্পিনার রাহুল চাহারের চাচাতো ভাই। দুজনেই একসাথে বড় হয়েছেন। 

সেই সময়ে দীপকের বাবা রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগরে বিমানবাহিনী স্টেশনে কর্মরত ছিলেন। তাদের কোয়ার্টারের পেছনেই তিনি দীপকের অনুশীলনের জন্য জায়গা তৈরি করেন। যেখানে দীপক বোলিং অনুশীলন করতেন। লোকেন্দ্র চাহারের কিছু বন্ধু যারা কিনা ব্যাটিং করতে পারতেন তারা দীপক চাহারের বলে ব্যাট করতেন। শুরু থেকেই দীপকের বাবা তাকে গতির চেয়ে স্যুইংয়ের ব্যাপারে বেশি মনযোগী হতে বলেছিলেন। 

ধীরে ধীরে দীপক ইন স্যুইং ও আউট স্যুইং দুটোতেই নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসেন। এভাবে দুই বছর অনুশীলন করেন দীপক। এরপর লোকেন্দ্র চাহারের বদলী দক্ষিণ ভারতে হয়! অর্থাৎ দীপককেও রাজস্থান ছেড়ে যেতে হতো। তার বাবা জানতেন এটা করলে ছেলে কখনোই রাজস্থান রাজ্যের হয়ে খেলতে পারবে না। ছেলের ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়তে তিনি বিমান বাহিনীর চাকুরি থেকে অব্যবহিত নিয়ে নেন এবং নিজের পৈত্রিক বাড়ি আগ্রায় চলে যান।

আগ্রায় লোকেন্দ্র চাহার একটি ক্রিকেট একাডেমি খোলেন। যার জন্য প্রায় ১০ লাখ টাকার লোন নেন তিনি। ওই একাডেমিতে দীপকের সাথে তিনি প্রায় ১৫-২০ জনকে ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেন। জুনিয়র লেভেলে ভালো পারফরম্যান্স করায় ২০০৮ সালে তাকে রঞ্জি ট্রফিতে ট্রায়ালের জন্য ডাকা হয়। সেই সময় গ্রেগ চ্যাপেল ছিলেন দায়িত্বে। দীপকের বোলিংয়ে গতি কম থাকায় চ্যাপেলের মন ভরাতে পারেনি। বলে দেন, দীপককে দিয়ে পেশাদার ক্রিকেট হবে না।  

দীপক ও তার বাবা হাল ছাড়েননি৷ তাঁদের পরিশ্রম অবশেষে সফল হয়। এর সুবাদে রাজস্থান দলও দীপককে দলে নিতে বাধ্য। দু’বছরের ব্যবধানে আসে স্মরণীয় সেই অভিষেক। দীপকের তাণ্ডবে রঞ্জি ট্রফিতে সর্বনিম্ন রানে অলআউট হওয়ার লজ্জা পায় হায়দ্রাবাদ। ওই মৌসুমে ৯ ম্যাচে ৪০ উইকেট নেন দীপক! রাজস্থানকে ঐ বছর শিরোপা জেতাতে বড় ভূমিকা পালন করেন দীপক। তবে, এরপরই ছন্দপতন হয়, তবে লড়াই থামেনি।

যদিও, ২০১১ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) রাজস্থান রয়্যালসে জায়গা পান তিনি। তবে এরপর বেশ কিছু সময় তাঁর ভালো যায়নি। টানা চোটের কারণে বেশ কিছু সময় ছিলেন ক্রিকেটের বাইরেও। তবে, ২০১১ থেকে ২০১৫ – এই সময়ে ইনজুরি ও নানা কারণে একটা ম্যাচও ভাগ্যে জোটেনি তাঁর। 

২০১৬ থেকে তার ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করলো। সে বছর আইপিএলে রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টসের হয়ে অভিষেক হয় তার। এছাড়া রাজস্থান ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক কোচ ইয়ান পন্ট ও ক্যাথেরিন ডেল্টনের সাথে কাজ করেন। ধীরে ধীরে নিজের ক্যারিয়ারের ভালো সময় ফিরে পেতে থাকেন দীপক।

২০১৮ সালে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে ৯ ম্যাচে ১৯ উইকেট নেন তিনি। সে বছর টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারী বোলার ছিলেন দীপক। এরপর ২০১৮ আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংস তাকে নিলাম থেকে কিনে নেয়। ওই বছর চেন্নাইর বোলিং লাইনআপের নেতৃত্ব দিয়ে ১২ ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেন তিনি। লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতে তিনি বেশ ভালো ইনিংস খেলার সক্ষমতাও দেখান। আইপিএল ও মুশতাক আলী ট্রফির পারফরম্যান্স দেখে তাকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ভারতের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়।

জুলাই ২০১৮, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে চাহারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। এরপর একই বছর সেপ্টেম্বরে এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকও করেন তিনি। ১০ নভেম্বর ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি তে তিনি হ্যাট্রিক করেন! মাত্র ৭ রান দিয়ে ৬ উইকেট শিকার করে টি-টোয়েন্টি তে রেকর্ড গড়েন তিনি। এখন পর্যন্ত তাঁর করা রেকর্ড টি-টোয়েন্টিতে সেরা বোলিং ফিগার হিসেবে অক্ষুন্ন আছে। আইপিএলে চড়া দামে বিক্রি হন তিনি, ভারতীয় দলেও জায়গাটা প্রায় পাঁকা।

গ্রেগ চ্যাপেলরা কখনো নিজেদের ভুল শিকার করেন না, তবে এটা ঠিক যে চ্যাপেলকে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছেন। সেই ছেলেটার ইন স্যুইং আর আউট স্যুইংয়ে প্রতি ম্যাচেই ধরাশায়ী হয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা৷ ধৈর্য্য আর আত্ববিশ্বাস থাকলে হিমালয় পর্বতেও ওঠা যায় সেখানে এতো কঠোর পরিশ্রম আর বাবার আত্মত্যাগের ফল কি বৃথা যেতে পারে? থাকুক সামনে গ্রেগ চ্যাপেল কিংবা তাঁর চেয়েও বড় কোনো বাঁধা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link