অপূর্ব এক ডেলিভারি! রোহিত শর্মার অফস্ট্যাম্প যেন হেঁটে বেরিয়ে গেল উইকেট ছেড়ে! ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের গর্জন এক মুহূর্তে স্তব্ধ। হতবাক! ঘরের ছেলে আজ দ্বিতীয় বলেই ফিরছেন সাজঘরে।
ডেলিভারিটা গুড লেন্থে পড়েছিল, বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল অ্যাঙ্গেল ধরে — রোহিত খেলেছিলেন ইনস্যুইংয়ের আশায়! কিন্তু হায়! বলটা ছিল নিখুঁত আউটস্যুইং, একেবারে স্টাম্প উপড়ে দিল! বোলারের মুখে পরিপূর্ণ তৃপ্তির হাসি।
দৃশ্যপট ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের, ২০২৩ সালের নভেম্বর। ওয়ানডে বিশ্বকাপের মঞ্চ। গ্যালারিতে আশার ঢেউ, পালে হাও দিচ্ছেন রোহিত শর্মা। সেই স্বপ্নে আচমকা এক খণ্ড বাদল নেমে এল—দিলশান মাধুশঙ্কার বাঁ-হাত হাত ধরে। ক্রিকেট অদ্ভুত এক খেলা। কে জানত, ওই একটা ভুলই এই সময়ে এসে রোহিত শর্মার ক্যারিয়ার ‘ডিফাইন’ করবে, দাঁড় করিয়ে দেবে ভবিষ্যতের শঙ্কার মুখে।
বাঁ-হাতি পেসার—ক্রিকেট অভিধানে যা কেবলই একটা ট্যাকটিকাল টার্ম, রোহিত শর্মার জন্য সেটা যেন হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত দু:স্বপ্নের প্রতীক। সোমবার রাতে সেই ওয়াংখেড়েতেই রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর সামনে সেই একই পর্দা আবারও ফাঁস হল।
আবার সেই ইনসুইং, আবারও সেই স্তব্ধতা! আবারও দর্শকদের সেই হতভম্ব চাহনী! ইয়াশ দয়াল দ্বিতীয় ওভারেই এসেই কাজের কাজটা করে ফেললেন। রোহিত তখন ব্যাট চালিয়ে মেরেছেন পরপর দুই চার, পুরনো হিটম্যানের ফেরার আভাস দিচ্ছেন, তখনই বলটা ঢুকে গেল ভেতরে, দৃষ্টি ফাঁকি দিল, ব্যাট আর প্যাডের ফাঁক গলে ঢুকে গেল স্টাম্পে। ওয়াংখেড়েতে তখন পিনপতন নিরবতা।
একের পর এক বাঁহাতি পেসারের হাতে রোহিতের উইকেট যাচ্ছে — এটা আর নিছক কাকতাল নয়। এটা এখন মনস্তত্ত্বের সংকট। ২৬ টি ইনিংসে ১২ বার আউট বাঁ-হাতিদের হাতে। মানে শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ। গড় কমছে, উদ্বোধনের ধার ভাঙছে, আর রোহিতের বাঁ-হাতি দেজ্যা ভ্যু বাড়ছে।
২০২৪ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাঁহাতি পেসারদের বিরুদ্ধে রোহিত খেলেছেন ১৫৭ টি বল, রান তুলেছেন ২৪৯, স্ট্রাইক রেট চমৎকার —১৫৮’এরও ওপরে! কিন্তু, সেখানে লুকিয়ে আছে এক কঠিন বাস্তবতা—গড় মাত্র ২০.৭৫! হ্যাঁ, পরিসংখ্যানের ভেতরটা ফাঁপা।
৪৪.৫ শতাংশ বলেই রান তুলতে পারেননি! অথচ ২৭.৩৮ শতাংশ ডেলিভারিতে আবার এসেছে বাউন্ডারি — মানে একদিকে আগুন, অন্যদিকে ধোঁয়া! এই আইপিএলে এখন পর্যন্ত মাত্র চার ইনিংস খেলেছেন, তার মধ্যে দুবারই ফিরেছেন বাঁহাতি পেসারের শিকার হয়ে — ৫০ শতাংশ হার!
সব মিলিয়ে বাঁহাতি পেসারদের বিরুদ্ধে রোহিতের এই পরিসংখ্যান যেন বলে দেয়—এটা কোনো রোম্যান্স নয়, এটা একতরফা ট্র্যাজেডি। বাঁ-হাতিরা আসেন, দেখেন, আর স্টাম্প ছিটকে দিয়ে জয় করে নেন—রোহিত থাকেন পেছনে, যেন ভাঙা গিটার হাতে একা বসে থাকা এক ব্যর্থ প্রেমিক।
ফজল হক ফারুকী থেকে শুরু করে শাহিন আফ্রিদি, ট্রেন্ট বোল্ট, সাম কারেন, মিশেল স্টার্ক কিংবা খলিল আহমেদ বা সৌরভ নেত্রাভালকার — সব বাঁ-হাতির বল যেন ঘুরে ফিরে রোহিত শর্মার রক্ষণের ছিদ্র খুঁজে নেয়। ফ্রন্টফুট এগিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু পেছনের পা আটকে থাকে—যেন প্রতিক্রিয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে।
রোহিতের ফ্রন্টফুটের সাথে তাল মেলাত পারছে না ব্যাকফুট। শরীরের ওজনটা দুই পায়ের ওপরই পড়ছে। আর তাতেই ফাঁক গলে বল খুঁজে পায় নিজের গন্তব্য। বড় ব্যাটাররা এখানেই নিজেদের শুধরে নেন, নতুন করে সাজান নিজেদের ব্যাটিং মডেল। ক’দিন বাঁদেই ৩৮ হতে যাওয়া রোহিত কি সে জন্য খুবই বেশ সময় পাবেন?
আবার এটাও মানতে হবে, ডান হাতি ব্যাটার মানেই তো বাঁ-হাতিদের সাফল্য। তাঁর ওপর রোহিত ওপেনার। নিজেদের পুরো ক্যারিয়ারটাই তো ডান হাতি ওপেনাদের জীবন নষ্ট করে কাটিয়ে গেছেন ওয়াসিম আকরাম কিংবা চামিন্দা ভাস। সেখানে মুম্বাই কোচ মাহেলা জয়াবর্ধনে তো বলেই দিলেন, ‘রোহিত জানে, সে কী ভুল করছে। ও কাজ করছে নিজেকে ঠিক করার জন্য।’
একট সময় রোহিত শর্মা মানেই ছিল প্রতিপক্ষের ওপেনিং বোলারদের জন্য দু:স্বপ্ন। এখন যেন পাল্টে গেছে গল্পটা। এখন রোহিত শর্মা নিজের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। বাঁ-হাতিরা জানে — রোহিতকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব। রোহিত কি পারবেন গল্পটা ফের নিজের করে নিতে?