ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) তাঁর অভিষেকটা পরিবারের জন্য গর্বের ছিল, তবে বিস্ময়ের নয়। না, এবি ডি ভিলিয়ার্সের সাথে তাল মিলিয়ে খেলা, বা কখনো তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পরও নয়। কারণ, ছেলের প্রতিভার আর সামর্থ্যের প্রতি বাবা-মার ছিল পূর্ণ বিশ্বাস। একদম গোড়া থেকেই ছেলে দেবদূত পাদ্দিকালকে ক্রিকেটার বানাতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
দেবদূত পাদ্দিকালের মা আমবিলি পাদ্দিকাল বলেন, যখন আমরা দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম, আমরা চাচ্ছিলাম একটা ছেলে সন্তান হোক এবং তাকে ক্রিকেটার বানাবো ভেবেছিলাম।’
২০১৯ সালে আইপিএলের আগে দুইবার ব্যাঙ্গালুরুর ব্যাপানাহাল্লি থেকে চিন্নাস্বামি স্টেডিয়ামে ছেলের অনুশীলন দেখতে এসেছিলেন মা আমবিলি পাদ্দিকাল ও বাবা বাবুনু কুননাথ। এবি ডি ভিলিয়ার্স ও বিরাট কোহলির সাথে ছেলেকে অনুশীলন করতে দেখে দু’জনেই বেশ খুশি হন।
দেবদূতের আইপিএলে অভিষেকের আগ থেকেই তাঁর বাবা নিয়মিত আইপিএল ম্যাচ দেখতেন। এরপর ২০২০ আইপিএল আসরে অজি তারকা অ্যারন ফিঞ্চের সাথে ওপেনিংয়ে অভিষিক্ত হন দেবদূত। তবে আরব আমিরাতে খেলা হওয়ায় মাঠে বসে ছেলের অভিষেক ম্যাচ উপভোগ না করার আক্ষেপটা রয়ে গেছে বাবা বাবুনু কুননাথের।
দেবদূতের বাবা বলেন, ‘অবশ্যই আমি যেতাম যদি সে ব্যাঙ্গালুরুতে খেলতো। অনেক বড় একটা সুযোগ মিস হলো। এটা তো আর কখনো ফিরবে না। পরের বছরেও যদি সে ব্যাঙ্গালুরুর মাঠে খেলে তাও সেটা তো আর তাঁর আইপিএল অভিষেক হবে না।’
দেবদূতের কোচ এবং পরামর্শক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘দেবের ব্যাটিং যেই দেখবে সেই উচ্ছ্বসিত হবে।’ এই মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন দেবদূতকে বয়সভিত্তিক দল থেকেই পর্যবেক্ষণ করছেন। ৬.৩ ইঞ্চির দীর্ঘদেহীর পাদ্দিকালের ট্রাউজারের সাইজ মেলাতেও তার বাবা-মা বেশ বিপাকে পড়তেন। পাদ্দিকালকে শর্ট বল করে খুব বেশি সমস্যায় ফেলতে পারেননি কোনো বোলারই। বরং উচ্চতা বেশি হবার কারণে শর্ট বলে সহজেই খেলতে পারতেন তিনি।
২০১৭ সালের কর্ণাটকা প্রিমিয়ার লিগে ব্যাঙ্গালুরু ব্লাস্টার্সের হয়ে ৫৩ বলে ৭২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি। এরপর কর্নাটকা অনূর্দ্ধ-১৯ দলে বেশ কিছু সময় অফ ফর্মে থাকলেও পরবর্তীতে আবারো তিনি দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে ফর্মে ফেরেন।
কোচ নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৪ থেকে অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যন্ত সে কোনো ম্যাচেই খারাপ খেলেনি। অনূর্দ্ধ-১৯ এ এক বছর সে ব্যাটে রান পায়নি। আমরা একবার বসে একসাথে কথা বলছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম একটা বড় স্কোরই সবকিছু পরিবর্তন করে দিবে। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একটা খেলা ছিলো। ওই ম্যাচে সে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে। আমি মনে করি সেখান থেকেই সে আবার নতুন ভাবে শুরু করে।’
এরপর ২০১৮ সালে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে সুযোগ পান পাদ্দিকল। সেখানে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে ৮২৯ রান করেন তিনি। এই পারফরম্যান্স তাকে টেনে নেয় রঞ্জি ট্রফিতে। মহারাষ্ট্রের বিপক্ষে মাইশোরে ৭৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংসে মুগ্ধ করেছিলেন রাহুল দ্রাবিড়কেও।
এরপর ২০১৯ সালে কর্ণাটকের হয়ে ইমার্জিং খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর ডিরেক্টর অব ক্রিকেট অপারেশন মাইক হেসন তাকে দেখে বেশ মুগ্ধ হন। আর আর সেখান থেকেই তাকে দলে ভেড়ান তিনি। এরপর ঘরোয়াতে রান বন্যায় ভাসান পাদ্দিকাল। বিজয় হাজারে ট্রফিতে ৬৭.৬৬ গড়ে ৬০৯ রান করেন তিনি। এবং সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিতে (টি-টোয়েন্টি) ১৭৫.৭৫ স্ট্রাইক রেটে ৫৮০ রান সংগ্রহ করেন পাদ্দিকাল। এছাড়া টেস্টেও তাঁর রাজ্যের হয়ে সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন রঞ্জিতে!
১১ বছর বয়সে বাড়ি থেকে ক্রিকেট কিট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মাঠে যেতেন দেবদূত। কর্নাটকা ইন্সটিউটের হয়ে অনূর্ধ্ব-১২ এবং পরবর্তীতে অনূর্ধ্ব-১৪ দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। কোচ নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘তাঁর বাবা মা তাঁর ব্যাপারে বেশ চিন্তিত ছিলো। তাঁকে একাডেমিতে নিয়েও আসতেন তাঁরা। এমনকি পিছনে বসে বেশ কয়েকদিন খেলাও দেখেছেন তারা।’ পরবর্তীতে নাসিরউদ্দিন দেবদূতকে তাঁর অধীনে নেন।
২০১১ এর মাঝামাঝি সময়ে ১০ বছর বয়সী দেবদূত তখন আম্বাতি রায়ডুর চাচার কাছে ট্রেনিং করতেন। এক সেশনে ৫০০ ছেলের ট্রেনিং করা দেখে দেবদূতের বাবা বাবুনু নিজের ছেলের ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ শঙ্কিত হন। পরবর্তীতে ছেলেকে নিয়ে আসেন ব্যাঙ্গালুরুতে। দেবদূতের বাবা হায়দ্রাবাদে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) তে চাকরি করতেন। আর মা আমবিলি পাদ্দিকল ছিলেন এডুকেশনাল ভিসা কনসাল্টেন্ট হিসেবে নিউজিল্যান্ড অ্যাম্বাসিতে। সেখান থেকে শিফট হয়ে ব্যাঙ্গালুরুতে আসা সহজ ছিল না।
‘এটা খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিলো হায়দ্রাবাদ থেকে বদলি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া। কারণ সেখানে আমাদের নিজস্ব বাসা ছিলো। এই সিদ্ধান্তটা শুধু দেবদূতের জন্যই নিয়েছিলাম। নইলে আমরা হায়দ্রাবাদে থেকে যেতাম কারণ আমার কোম্পানি আমাকে থাকার অপশন দিয়েছিল।’
দেবদূত ছোট থেকেই ফুটবলপ্রেমী ছিলেন। ইংলিশ ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফ্যান ছিলেন। ফুটবলে কিছুটা ঝোঁক থাকলেও ক্রিকেটকেই বেছে নেন তিনি। প্লাস্টিক ব্যাটে বাম হাতে খেলা শুরু করেন তিনি। তাঁর বাবা মা চেয়েছিলেন তিনি একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান হবেন। সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত মাঠে অনুশীলন করতেন দেবদূত।
এরপর ব্যাঙ্গালুরুতে দেবদূতকে আর্মি স্কুলে ভর্তি করানো হলো। তবে, সেখানে খুব বেশিদিন থাকা হয়নি তাঁর। সেন্ট জোসেফ বয়েস স্কুলের কোচ তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। অনূর্দ্ধ-১৪ এর এক ম্যাচে একা হাতে সেন্ট জোসেফের বিপক্ষে জয় এনে দেন তিনি। এরপর তাঁর কোচ নাসিরউদ্দিন তাকে আরেক স্কুলে নিয়ে আসে।
দেবদূতের একটা সমস্যা ছিলো তাঁর ব্যাটের হ্যান্ডেল নিয়ে। তাঁর উচ্চতার তুলনায় ব্যাটের হাতল বেশ ছোট ছিলো। সেখানে একজন ব্যাট প্রস্তুতকারক ছিলেন নাম গ্রেগ নিকোলস। যিনি পাদ্দিকলের জন্য লম্বা হাতলের ব্যাট তৈরি করেন।
পুরো ক্রিকেট জার্নিতে বাবা মার পূর্ণ সমর্থন থাকা ছাড়াও দেবদূত বেশ স্বাধীনচেতা ছিলেন। শপিংয়ে নিজের পছন্দমতোই সব জিনিস কিনতেন। কারো মতামত নিতেন না। বেশ কম কথাও বলতেন তিনি। পরবর্তীতে তাঁর মা আমবিলি তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দেন! যাতে করে ছেলের পারফরম্যান্স এবং অর্জনের আপডেট দিতে পারেন সবার কাছে।
দেবদূতের বাবা বাবুনু বলেন, ‘ও একা থাকতেই পছন্দ করে, নিজের খেয়াল নিজেই রাখে। এটাতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেবোধ করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যখন ও দশম শ্রেণিতে পড়তো, পুরো বছরে ফাইনাল পরীক্ষার আগে শুধু জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাস পড়ার জন্য সময় পেয়েছিলো। নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখে পুরো টাইম পড়াশোনা করতো। পরে ও ৯৬% নম্বর পেয়েছিল।
কোভিড-১৯ আসার পর লকডাউনের সময় সে তাঁর বিবিএর চতুর্থ সিমেস্টারের পড়া শেষ করে ফেলে। অবশ্য দেবদুতের কলেজ থেকেয়াও বেশ সুবিধে দেওয়া হয়। একটি জীবানুমুক্ত ঘরে তাকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর যখন লকডাউনের সময় আরো বাড়লো এবং আইপিএল তখন ভারতের বাইরে হবার সম্ভাবনা তৈরি হলো। এরপর আইপিএলের নিলাম! আর দল পাবার পর অনুশীলন।
দেবদূতের মা আমবিলি পাদ্দিকল আইপিএলের নিলামের (১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮) কথা মনে করে বলেন, ‘সেদিন দেব বাসায়ই ছিলো। সেও ভাবেনি আইপিএলের নিলামে দল পাবে। সাতজনের আনক্যাপড খেলোয়াড়দের তালিকায় সে অবিক্রিত থাকবেন বলে ধরে নিয়েছিলো। এরপর ব্যাঙ্গালুরু তাকে দলে কিনে নেয়। সে সাধারণত চুপচাপ থাকে। তবে সেদিন সে উত্তেজনা ধরে রাখতে পারেনি। সে দারুন উচ্ছ্বসিত ছিলো।’
দেবের বাবা বাবুনু বলেন, ‘আমি সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠেছিলাম। বেশ খুশি ছিলাম আমি। আইপিএল অনেক বড় একটা প্ল্যাটফর্ম। তাঁর জন্য এটা অনকে বড় অভিজ্ঞতা।’
আইপিএলে দেবদূতের ডাক পাওয়াটা তাঁর বাবা বাবুনু এবং মা আমবিলির জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। সেবার দেবদূত দুবাই যাওয়ার আগে তারা সমস্ত কাজ বন্ধ করে সেদিন হায়দ্রাবাদ থেকে ব্যাঙ্গালুরুতে ফ্লাইটে ছুটে আসে শুধুমাত্র ছেলেকে একবার দেখবে বলে।
দুবাই যাওয়ার আগে দেবদূত তখন ভারতে আটদিনের কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। তাঁর বাবা মাও নিজেদেরকে আইসোলেশনে রেখেছিলেন শুধুমাত্র ছেলেকে যাবার আগে দেখবেন বলে। এমনকি খাবার সময় ছাড়া কেউ কাউকে দেখতেনও না! মাস্ক, গ্লভসে নিজেদেরকে ঢেকে রাখতেন পুরোটা সময়।
বাবুনু বলেন, ‘সে যাতে নিরাপদে আরব-আমিরাত যেতে পারে আমরা সেটাই চাচ্ছিলাম। আমরা নিজেরাও আইশোলেশনে ছিলাম।’ পরবর্তীতে যখন ২০ সেপ্টেম্বর ইনস্টাগ্রামে দলের সাথে ফ্লাইটে ছেলের ছবি দেখেছিলেন সেদিনই দু’জনের মুখে হাসি ফুটে। সেখান থেকে দেবদূতের পরবর্তী সফর শুরু হয়।
আইপিএলের সিঁড়ি বেয়ে পাদ্দিকাল এখন ভারতীয় দলে। অভিষেকের দিন গুণছেন। এবার কি বাবা-মা বিস্মিত? সম্ভবত না। নিজেদের চেষ্টায় এবারো তাঁদের আস্থা আছে।