শূন্য রানে আউট – ক্রিকেট মাঠে এর চেয়ে হতাশাজনক আর কিছু নেই। আউট হওয়া মাত্রই টিভির পর্দায় হলুদ রঙের একটি হাঁসকে হতাশ হয়ে ফিরে দেখা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কমেন্ট্রি বক্সে বসে ধারাভাষ্যকাররা বলে ওঠেন, ‘হি হ্যাজ গট আ ডাক!’
ক্রিকেটীয় ভাষায় শূন্য রানে আউট হলে ‘ডাক’ বলা হয়। আচ্ছা কেনো শূন্য রানে আউট হলে তাকে ‘ডাক’ বলা হয়?জানা যায় ১৮৬৬ সালের ১৬ জুলাই ব্যাটিংয়ে নেমে কোনো এক ম্যাচে প্রিন্স অব ওয়েলস শূন্য রানে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে আসেন।
পরদিন ব্রিটিশ একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছিল এভাবে, ‘প্রিন্স রয়্যাল রিটায়ার্ড টু দ্য রয়্যাল প্যাভিলিয়ন অন আ ডাকস এগ।’ অর্থাৎ হাঁসের ডিম নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে এসেছেন প্রিন্স রয়্যাল। এর পরেই ওই শব্দটি ক্রিকেটের ভাষায় যুক্ত হয় এবং পরবর্তীকালে কোন ব্যাটসম্যান আউট হলে তখন ‘ডাক’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো।।
শূন্য বা ডাক আবার ছয় রকম। কোনো ব্যাটসম্যান যখন নিজের প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হন তখন তাকে গোল্ডেন ডাক বলা হয়। কোনো ব্যাটসম্যান নিজের দ্বিতীয় বলে শূন্য রানে আউট হলে তাকে সিলভার ডাক বলা হয়। কোনো ব্যাটসম্যান নিজের তৃতীয় বলে শূন্য রানে আউট হলে তাকে ব্রোঞ্জ ডাক বলা হয়।
যখন কোনো ব্যাটসম্যান টেস্টের উভয় ইনিংসে শূন্য করে তখন তাকে কিং পেয়ার বলে। কোনো ব্যাটসম্যান যখন ইনিংসের প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হয় তখন তাকে প্লাটিনাম ডাক বলে। ব্যাটসম্যান যখন কোনো বল না খেলেই আউট হয়ে যায় তখন তাকে ডায়মন্ড ডাক বলা হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবধরণের ফরম্যাট মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি বার শূন্য রানে আউট হয়েছেন মুত্তিয়া মুরালিধরণ (৫৯ বার)। ওয়াসিম আকরাম সবচেয়ে বেশি বার (১৮৯) কোনো ব্যাটসম্যানকে শূন্য রানে আউট করেছেন।
যাই হোক শূন্য রানে আউট হওয়া বিচিত্র নয় এবং ক্রিকেটে আমরা প্রায়শই দেখতে পাই। তবে সবচেয়ে বেশি বিচিত্র আউট মনে হয় ডায়মন্ড ডাক! একজন ব্যাটসম্যানের চরম দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয় এই ডায়মন্ড ডাককে। কোন বল খেলার আগেই আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরত যাওয়ার নামই হল ডায়মন্ড ডাক। বুঝতেই পারছেন ডায়মন্ড ডাক আউট হওয়ার ঘটনা ঘটে নন-স্ট্রাইকিং এন্ডের ব্যাটসম্যান রান আউট হলে, কিংবা যে বল ফেস করছে তা ওয়াইড বল হলে তাতে স্ট্যাম্পড আউট হলে। ক্রিকেট ইতিহাসে ডায়মন্ড ডাকের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়।
এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ২৯ টি ডায়মন্ড ডাকের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের ক্রিস মার্টিন একাই দুবার এই ঘটনার শিকার হন। নিউজিল্যান্ডের কেন রাদারফোর্ড, পাকিস্তানের উমর গুল এবং শ্রীলঙ্কার নুয়ান প্রদীপ – এই তিনজন ক্রিকেটার অভিষেক টেস্টে ডায়মন্ড ডাক হয়েছেন। বহু বছর বাদে কেন রাদারফোর্ডের পুত্র হামিশ রাদারফোর্ড অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি করেছেন। সুরক্ষিত ক্রিকেট খেলার পূজারী রাহুল দ্রাবিড়ও ডায়মন্ড ডাক করেছেন টেস্টে।
ওয়ানডে ক্রিকেটের দিকে তাকালে দেখা যাবে ডায়মন্ড ডাকের সংখ্যা ১৫২। শেষের দিকে দেখা যায় অতিরিক্ত রানের চেষ্টায় অনেকেই ডায়মন্ড ডাক আউট হন। শেষ বার এই ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে। ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ ও মার্ক উড একসাথে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই শূন্য বলে শূন্য করে আউট হন। টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে এই সংখ্যাটি ৫০।
বিখ্যাত ডায়মন্ড ডাকের প্রসঙ্গ উঠলে সবাই হয়তো ১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অ্যালান ডোনাল্ডের দুর্ভাগ্যজনক আউটের কথা ভাববেন। ল্যান্স ক্লুজনারের অসাধারণ লড়াইয়ের পরও শেষে ভুল বোঝাবুঝিতে ম্যাচ টাই হয়েছিল এবং অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে গিয়েছিল ও বিশ্বকাপ জয় করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলবার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছিল। এরপর আর কখনো ফাইনাল খেলা হয়নি দলটির, শিরোপা তো দূরের কথা।
কয়েক বছর আগেই ইডেন পার্কে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড অসাধারণ একটি ওয়ানডে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার পেসার জশ হ্যাজেলউড ডায়মন্ড ডাকের একটি নতুন রেকর্ড গড়েন। সবচেয়ে বেশি সময় উইকেটে থেকে ডায়মন্ড ডাক পাওয়ার রেকর্ড গড়েন। ২৬ মিনিট উইকেটে থেকেও একটি বল খেলার সৌভাগ্য হয়নি তার। হ্যাজেলউড আউট হওয়ায় মার্কাস স্টোইনিসের অসাধারণ লড়াই কোনো দাম পায়নি, কেন উইলিয়ামসনের বিদ্যুৎ গতির রান আউটে।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজের অভিষেকেও ডায়মন্ড ডাকের উদাহরণ রয়েছে। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে হায়দ্রাবাদে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২৪৩ রান তাড়া করতে নেমে ১০৪ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল জিম্বাবুয়ে। সেখান হতে অসাধারণ লড়াই চালিয়ে যান কিংবদন্তি উইকেটরক্ষক ডেভ হটন ও বোলার ইয়ান বুচার্ট। হটন সেঞ্চুরি ও ইয়ান হাফ সেঞ্চুরি করেন। ২২১ রানে হটন আউট হওয়ার পর অভিষিক্ত পেসার এডো ব্র্যান্ডেস নেমেই ডায়মন্ড ডাকের শিকার হন। দল শেষ পর্যন্ত ৩ রানে ম্যাচ হেরে যায়।