লোকে বিদ্রুপ করছে, শিরিষ কাগজ দেখাচ্ছে বার্মি আর্মি। দেড় বছর যাবত তো আর কম শুনেননি। ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে আসার পথে কি সেসবই ভাবছিলেন স্টিভ স্মিথ। বোধহয় নাহ, কারণ দল যে তখন কাঁপছে ব্রড-ওকস-আর্চারদের সামনে। তিনি নামতেই বাউন্সার দিয়ে স্বাগতম জানালেন জোফরা আর্চার।
জো রুট ফিল্ডিংও সাজালেন সেভাবে। লেগ সাইডে ছয়জন। লং লেগ, ডিপ স্কয়ার লেগ এবং ডিপ মিডউইকেটে তিনজন। বাকি তিনজন স্কয়ার লেগ, শর্ট মিডউইকেট এবং মিড-অনে ওঁত পেতে ছিলেন স্মিথের ভুল পুলের জন্য।
কিন্তু ভুল করলেন না স্মিথ, দর্শকদের দুয়ো আর ইংরেজ বোলারদের আগ্রাসন পাত্তা না দিয়ে ইস্পাতকঠিন মানসিকতার পরিচয় দিলেন পরের কয়েক ঘন্টায়।
একাগ্রতা আর মনোসংযোগের চূড়ান্ত সম্মিলনে সময়ের সাথে সাথে ম্যাচের চিত্রনাট্য দিলেন পালটে। সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মাঝেও উইকেট কামড়ে থেকে দলকে সম্মানজনক স্কোর এনে দিয়ে যখন শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ফিরলেন তখন দুয়ো দেওয়া দর্শকরাই করছেন হর্ষধ্বনি। এজবাস্টনে তখন দর্শকদের করতালিতে কান পাতা দায়!
২.
আশির দশক। একদিকে সুনীল গাভাস্কার ব্যাটিংয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন তো পৃথিবীর অপরপ্রান্তের রিচার্ড হ্যাডলী আগুন ঝড়াচ্ছেন বল হাতে। ক্যারিবীয়ানদের পড়ন্ত বেলা তখনো ঠিক শুরু হয়নি তখনো মাঠে আলো ছড়াচ্ছেন স্যার ভিভ রিচার্ডস, রিচি রিচার্ডসন, কোর্টনি ওয়ালশরা। সাদা পোশাকের ক্রিকেট ছেড়ে ক্রিকেট আগাচ্ছে রঙিন পোশাকের দিকে। মানুষের জীবনযাত্রাতেও লেগেছে তখন পালাবদলের হাওয়া।
ঠিক সেসময়েই মন দেয়া-নেয়া করলেন এক সুদর্শন অজি তরুণ এবং এক রূপবতী ইংরেজ তরুণী। পেশায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট পিটার স্মিথ তখন চাকরিসূত্রে ইংল্যান্ডে। সেখানেই প্রেমে পড়লেন এক ব্রিটিশ তরুণীর, গিলিয়ান। মন দেয়া-নেয়া করে ফেললেন প্রথম আলাপেই। গাঁটছড়া বাঁধতেও খুব বেশি দেরি করলেন নাহ, বিয়েটা সেরে ফেললেন দ্রুতই। আর তাতেই তরুণী গিলিয়ান পুরোদস্তুর গৃহবধূ হয়ে ফিরলেন অজি মুলুকে।
অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসে সংসার পাতলেন এই নবদম্পতি। দুজনের ঘর আলো করে এলো প্রথম সন্তান, ক্রিস্টি। মেয়েকে পেয়ে দুজনের আনন্দ যেন আর ধরে না।
তিন বছর পর স্মিথ পরিবারের আনন্দ দ্বিগুণ করে দিয়ে এল দ্বিতীয় সন্তান। ক্রিস্টির আনন্দ যেন একটু বেশিই, ভাইকে কাছছাড়া হতে দেয় না সে। রাজপুত্রের একটা নাম রাখা দরকার। নাম রাখা হল স্টিভেন পিটার ডেভের্যাক্স স্মিথ। স্টিভেন নামটা এসেছে গ্রীক ‘স্টিফেন’ বা ‘স্টিফেনাস’ থেকে, যার অর্থ মুকুট বা জয়মাল্য।
৩.
ছোটবেলায় সবাই চায় নিজের পছন্দের মানুষের মতো হতে। কেউ পারে আবার কারো সে সৌভাগ্য হয় নাহ। কৈশোরে প্রিসলির মতো এলোমেলো লম্বা চুল আর গিটার হাতে ঘুরে বেড়ানো ছেলেকেই পরবর্তীতে দেখা যায় পুরোদস্তুর অফিস করতে। ছেলে বা মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার বানাবে এমন স্বপ্নই দেখে বেশিরভাগ বাবা-মা। তবে ‘আউট অব দ্য বক্স’ চিন্তা করার মতোই খুব অল্প বাবা-মা-ই ভাবেন হোক না ছেলে যা ইচ্ছে। আর ঐ ছেলেমেয়েরাই স্বপ্ন দেখে মেসি হয়ে বল পায়ে কারিকুরি দেখানোর বা শচীনের মতো ব্যাট হাতে বিশ্ব শাসন করার।
শচীনও একসময় লম্বা চুল নিয়ে পেসার হতে চেয়েছিলেন কিংবা সাকিব আল হাসান হতে চেয়েছিলেন ফুটবলার। কিন্তু আসল প্রতিভা বুঝতে দেরি করেননি। ছোট্ট স্মিথও তাই, তার জীবনজুড়ে ক্রিকেট। নাওয়া-খাওয়া-ঘুম সব ফেলে রেখে ক্রিকেট। বাবা-মা বাধাঁ দেন না, করুক না ওর যা ইচ্ছে। তখন ক্রিকেট মানেই শেন ওয়ার্ন, লেগস্পিনের মায়ায় মোহমুগ্ধ করে রেখেছেন সারাবিশ্ব। তার বোলিংয়ের প্রেমে পড়ে ছোট্ট স্মিথও, সেও হতে চায় শেন ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিতে চায় হারানো বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের প্রেমে শিকেয় উঠলো লেখাপড়া, বার বছরেই স্কুল ছাড়লো স্মিথ।
প্রতিভার জানান দিতেও খুব বেশি সময় নিলেন নাহ, সারে আগ্রহ দেখালো স্মিথের উপর। সদ্য ১৭ পেরোনো স্মিথের সামনে তখন দুটো রাস্তা; অস্ট্রেলিয়া নাকি ইংল্যান্ড। নানা নাকি দাদা কাদের জার্সি গায়ে জড়াবে স্মিথ। ছোটবেলা থেকেই ব্যাগি গ্রিন ক্যাপের স্বপ্ন দেখা স্মিথ বেছে নিলেন অস্ট্রেলিয়াকেই।
৪.
২০০৮ সাল।
কিশোর স্মিথ তখন অস্ট্রেলিয়া অনুর্ধ্ব দলের সদস্য। বিশ্বকাপ খেলতে গেলেন মালয়েশিয়ায়। স্মিথ ট্রফির নেশায় বিভোর। স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিংয়ের মতো তিনিও উচিয়ে ধরবেন সোনালি ট্রফি। হোক না ছোটদের বিশ্বকাপ তবুও বিশ্বকাপ তো। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বাড়ি ফিরতে হলো স্মিথদের। হতাশ হলেন তবে ভেঙে পড়লেন নাহ।
পরাজয়ে ডরে না বীর।
২০০৮ সালে সুযোগ পেলেন নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে খেলার। কেএফসি টি-টোয়েন্টিতে ৪ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হন স্মিথ। পরের বছরই চ্যাম্পিয়ন লীগ টি-২০’র শিরোপা জিতে নিউ সাউথ ওয়েলস। ফাইনালে ত্রিনিদাদের বিপক্ষে ৩৩ রানে ২ উইকেট নেন তিনি। ঘরোয়াতে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে বল হাতে ছিলেন সাদামাটা। তবে মৌসুমে শেষ ম্যাচে সা উইকেট পেলে শেন ওয়ার্নের নজরে পড়ে যান। ওয়ার্ন এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন তাকে নিয়ে যে নিজেই ছুটে আসেন এবং তাকে লেগস্পিনের কলাকৌশল নিয়ে টিপস দেন।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতেই পেয়ে যান স্বপ্নের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ। লেগস্পিনার হিসেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয় টি-টোয়েন্টিতে। একইমাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হয় ওডিয়াই অভিষেক। ২০১০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে হন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। ২০১০ সালেই লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই বোলারদের সাথে জুটি বেঁধে ৭৭ রান করে নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের জানান দেন। বল হাতেও নেন তিন উইকেট।
৫.
কিন্তু অভিষেকের সুখের সময়টা খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হলো না স্মিথের জীবনে। বুঝে গেলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চটা বড়ই আঁকাবাঁকা। টানা তৃতীয় বিশ্বকাপের লক্ষ্যে ভারতে এল অজিরা, সঙ্গে তরুণ স্মিথ। কিন্তু মাঠের বাইরে বসেই দেখতে হলো ভারতের বিপক্ষে হার। কয়েকদিন পরেই বাদ পড়লেন দল থেকে, সাম্রাজ্য হারানোর বেদনার সাথে যুক্ত হল ঘরের মাঠে অ্যাশেজ হার। জন্মের পর থেকে তো আর এই ঘটনা দেখেনি সে। দেখল নিজের প্রথম অ্যাশেজে!
৬.
ডুবন্ত মানুষ নাকি খুড়কুটো ধরেই বাঁচয়ে চায়। কঠিন এই দুঃখ-যন্ত্রণার সময়ে খুড়কুটো হয়েই যেন স্মিথের জীবনে আসলেন উইলিস, ড্যানি উইলিস। আইনের এই ছাত্রীর কথার মাঝে হারিয়ে গেলেন স্মিথ।
‘আমি মনে করি, আমার জন্য সে একটু বেশিই স্মার্ট। সে অনেক বেশি যোগ্য আমার চেয়ে। সে অনেক বেশি প্রতিভাবান, চাইলেই সে অন্য যেকোনো ছেলেকে ভালোবাসতে পারে। আমি ভাগ্যবান, মেয়েটা আমাকে পছন্দ করেছে।আমাকে ফিরে আসতে হবে। আমাকে প্রমাণ করতে হবে আমিই সেরা। বিশ্বের সেরা হতে হবে আমার। ড্যানির যোগ্য হতে হবে আমাকে। ওকে খুশি দেখতে চাই আমি। আর সে খুশি হবে আমার সাফল্যে।’
স্টিভের পরিশ্রম আর অধ্যবসায় আরো গেল বেড়ে। স্টিভ স্মিথ ধীরে ধীরে গোছালেন নিজেকে। নেট সেশনে ঘাম ঝরালেন ভীষণ। নিজেকে বদলে ফেললেন একটু একটু করে। শেন ওয়ার্নের ছায়া থেকে বেরিয়ে কবে যেন হাঁটতে শুরু করলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ছায়ার দিকে।
৭.
প্রিয় বন্ধু ফিলিপ হিউজ। ছোটবেলা থেকে একত্রে খেলেছেন, মালয়েশিয়ার ছোটদের বিশ্বকাপেও ছিলেন একসাথে। হুট করে কী যে হলো, দুম করে চলে গেল হিউজি। কিছুতেই মানতে পারেন না স্টিভ। বুকে যন্ত্রণার অশান্ত ঢেউ। তবে চাপা দিয়ে রাখলেন তা।
ওয়ার্নারের আবেগঘন সেঞ্চুরি উদযাপন দেখেছেন তিনি। আকাশপানে তাকিয়ে হিউজিকে করা উৎসর্গটা, চোখে প্রায় জল এনে দিচ্ছিল তার। কিন্তু চোখে জল এলে হবে না। তাহলে তো বল দেখবেন না, আউট হয়ে যাবেন। দলপতি ক্লার্কের উদযাপনটাও তাকে ভীষণ আবেগে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বহু কষ্টে সামলে রেখেছেন নিজেকে। উঁহু, হিউজির জন্য আমার তো কিছু করা হয়নি এখনো।
‘ঠিক ৯৮ রানে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম, আর দুটো রান পেলেই আমি ঐ ৪০৮ লেখাটায় ছুটে যাব, এবং প্রিয় বন্ধুকে জানাব ধন্যবাদ। ব্যাটিংয়ের এই পুরোটা সময় আমার সঙ্গে থাকার জন্য।’
পুরস্কার পেলেন পরের টেস্টেই, প্রমোশন হলো তার। উঠে এলেন চার নাম্বারে। অবশেষে তার সমস্ত পরিশ্রম, সমস্ত অনুশীলন, সমস্ত অধ্যাবসায় কথা বলতে শুরু করেছে। তিনি বিশ্বজয়ে নামবেন এবার। তাকে থামায়, সাধ্য কার?
৮.
এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০১৪ সালে ৮১.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ১১৪৬ রান, ২০১৫ সালে ৭৩.৭০ ব্যাটিং গড়ে ১৪৭০ রান করেন। ঐ বছরে আইসিসি বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার, বর্ষসেরা ক্রিকেটার, অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা ক্রিকেটার, উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার, আইসিসির বর্ষসেরা টেস্ট এবং ওয়ানডে দলে সুযোগ পাওয়া সহ অনেক অ্যাওয়ার্ড তার দখলে গিয়েছে।
২০১৬ সালের শেষ টেস্ট ইনিংসে ম্যাচ সেরা ১৬৫* রানের ইনিংসের মধ্য টানা তিনবছর টেস্টে হাজারের অধিক রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন, ৭১.৭৩ ব্যাটিং গড়ে করেন ১০৭৯ রান। স্টিভেন স্মিথ বক্সিং ডে টেস্টে বরাবরই অসাধারণ ছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ইনিংসে ১৬৫* রান করার পাশাপাশি গত বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে অপরাজিত ১৩৪* এবং ৭০* রান করেন। ২০১৪ সালের বক্সিং ডে টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ১৯২ রান এবং ১৪ রান করেছিলেন বর্তমানের অন্যতম সেরা এই টেস্ট ব্যাটসম্যান।
৯.
সেবার অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্মের শেষে বিশ্বকাপ জিতে অবসরের ঘোষণা দিলেন মাইকেল ক্লার্ক। পেন্টা জয়ের মিশনে সবার সামনে তখন স্মিথ, বিশ্বকাপে টানা চার ফিফটি করে ব্যাটিং লাইনআপকে দিয়েছেন নেতৃত্ব। ক্লার্কের অবসরের পর তাই নেতৃত্বের ব্যাটনটা নিয়ে দুবার ভাবতে হলো না, দায়িত্ব পেলেন সবার প্রিয় স্টিভেন স্মিথ। সাফল্যের সিঁড়ি যেন তৈরিই ছিল, তরতর করে তাতে বেয়ে উঠলেন স্মিথ। রানের ফোয়ারা ছুটল তার ব্যাট থেকে। বর্ষসেরা ক্রিকেটার, অ্যালান বোর্ডার মেডেল কি যোগ হল না তার শোকেসে।
অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করলেন, সিরিজ জিতলেন নিউজিল্যান্ডে গিয়ে। মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখতে হয়েছে। টেস্ট হারলেন বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার কাছে। ভারতের বিপক্ষে হারলেও তাতে রাখলেন লড়াইয়ের ছাপ। তার অস্ট্রেলিয়া যে হারার আগে হারে নাহ।
গেলেন প্রোটিয়া সাম্রাজ্যে। আর সেখানেই ঘটলো ভয়ংকর কাণ্ডটা।
১০.
যুদ্ধ আর ভালোবাসার মাঠে ভালো-খারাপের তফাৎ নাকি খুঁজতে নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার সিরিজটা রীতিমতো স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে। একের পর এক বিতর্কে জর্জরিত দুই দলই, মাঠ ও মাঠের বাইরে‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ অবস্থা! একবার কুইন্টন ডি ককের সঙ্গে ওয়ার্নারের রীতিমতো হাতাহাতি শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় তো অন্যদিকে স্মিথ-রাবাদার শারীরিক সংঘর্ষ। ক্রিকেটটা এ সিরিজে যে আর কেবলই খেলার গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই, সে বিষয়ে সন্দেহ কী!
সিরিজের প্রথম ম্যাচটি জিতলেও দ্বিতীয় ম্যাচে ঠিক পেরে ওঠেনি স্টিভ স্মিথের নেতৃত্বাধীন ক্যাঙ্গারুশিবির, পরাজিত হয় ছয় উইকেটের ব্যবধানে। কেপটাউন টেস্টেও খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না তারা, মাত্র ২৫৫ রানে অজিদের গুটিয়ে দিয়ে ৫৬ রানের গুরুত্বপুর্ণ একটি লিড পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর মার্করামের ব্যাটে ভর করে সেই লিডকে তুঙ্গস্পর্শী করে তোলার পথে এগিয়ে চলেছে প্রোটিয়ারা। ম্যাচের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সিরিজটাও, ব্যাটসম্যানরাও কোনোমতেই সুযোগ দিতে রাজি নন। সে হতাশাটাই হয়তো পেয়ে বসলো অস্ট্রেলিয়া শিবিরে।
টেস্টের তৃতীয় দিন বিকেল বেলায় সম্প্রচারকারী টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা পড়লো যে, অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ডার ক্যামেরন ব্যানক্রফট বলকে কিছু একটা করছেন। ক্যামেরা আরও জুম করলে বোঝা গেলো হলুদ কিছু একটা দিয়ে বল ঘষছেন তিনি। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে এই দৃশ্য ভেসে উঠতেই ব্যানক্রফট জিনিসটা চালান করে দিলেন অন্তর্বাসের ভেতর। এরপর আম্পায়ার ডাকলেন তাকে ও স্মিথকে। এই অবস্থায় দুজনই অস্বীকার করলেন বল টেম্পারিংয়ের কথা।
কিন্তু দিনের খেলাশেষে বদলে গেলো দৃশ্য। ব্যানক্রফটকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এলেন স্মিথ। ব্যানক্রফট প্রথমে সবটা স্বীকার করে নিলেন। বললেন যে, ‘স্যান্ড পেপার’ দিয়ে বল ঘষে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর স্মিথ বেশ পরিষ্কারভাবে সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন, “যা ঘটেছে, তার জন্য আমি দুঃখিত। আমার নেতৃত্বে এই প্রথম এমন কিছু ঘটল। কথা দিচ্ছি, এটাই শেষ। এটা করে কিছুটা সুবিধা নেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। সিনিয়ররা ব্যাপারটা জানেন (লিডারশিপ গ্রুপ)। কিন্তু কোচ লেম্যান এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এটা মোটেও গর্ব করার মতো ব্যাপার নয়। আমরা এটা নিয়ে লজ্জিত।
খোদ ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান, শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে ইয়ান বোথামের নামে অভিযোগ উঠেছে। এই কিছুদিন আগে ফাফ ডু প্লেসিসের নামেও অভিযোগ উঠেছে। ডু প্লেসিসসহ অনেকের বিপক্ষে ফুটেজের প্রমাণও ছিলো। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই দলের অধিনায়ক আগ বাড়িয়ে এসে বলেননি যে, এটা তাদের সিদ্ধান্তে হয়েছে।
অথচ বল টেম্পারিং বিষয়টাই এমন যে, ফাস্ট বোলারের সুবিধার জন্য এটা দলীয় সিদ্ধান্তেই হয়ে থাকে। মানে, স্টিভ স্মিথ এ ক্ষেত্রে প্রথম পাপী নন। তিনি বরং প্রথম মানুষ, যিনি দায় কাঁধে নিতে ছুটে এসেছেন। এখানে স্মিথের উদ্দেশ্যটা ছিলো খুব মহৎ। তিনি ব্যানক্রফটের মতো একজন তরুনকে বুলেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চাননি। কারণ, বল টেম্পারিং নিয়ে যত বিতর্ক হয়, সেটা যে ধরা পড়ে, তাকে নিয়েই হয়।
স্মিথ জানতেন যে, তিনি যদি এই ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে না আসেন, শাস্তি খুব বেশি না হলেও আগামী কয়েক দিন মিডিয়া অন্তত ব্যানক্রফটকে ছিড়ে ফেলবে। সেই ভাবনা থেকেই ব্যানক্রফটের মতো একজন তরুণকে বাঁচাতে নিজে এগিয়ে এসে সবটা দায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। এই স্বীকারোক্তির ফলে স্মিথ হয়ে গেলেন সবার লক্ষ্যবস্তু।
স্মিথ যদি স্বীকার না করতেন? যদি তিনি বলতেন যে, কিছু একটা ঘটেছে, তবে তাদের জ্ঞাতসারে এরকম কিছু ঘটেনি? কিংবা যদি একেবারেই সংবাদ সম্মেলনে না আসতেন?
১১.
‘ওরা অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। ব্যাগি গ্রিন ক্যাপের অমর্যাদা করেছে ওরা।’
‘ওদের আজীবন নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিৎ। বের করে দাও দল থেকে। ওদের ছায়াও যেন আর না পড়ে।’
‘ক্রিকেট খেলার সাথে প্রতারণা করেছে ওরা। চির বিশুদ্ধতায় লেপন করেছে কালিমা। ওদের আর কোনোদিন টেস্ট খেলার অধিকার নেই।’
মাঠের বাইরের নানান মন্তব্য, ঠাট্টা-বিদ্রুপ সবকিছু যেন মানসিকভাবে চুরমার করে দিচ্ছিলো তাকে। মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?
ভাগ্যিস, পরিবারকে সাথে পেয়েছিলেন। কঠিন সে সময়টাতে সাহস জুগিয়েছেন পরিবারের সবাই। পাখি যেমন সবটুকু দিয়ে আগলে রাখে নিজের সন্তানকে, পিটারও যেন সংবাদ সম্মলনের সেই কক্ষে আগলে রাখতে চাইলেন ছোট্ট স্মিথকে। ড্যানিও ছিলেন পুরোটা সময় জুড়ে।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয় তাকে। সাথে অধিনায়কত্ব থেকে দুই বছরের নির্বাসন। অম্লান বদনে মেনে নেন সে শাস্তি। এই সময়টাতে ঘরে তোলেন প্রেয়সীকে। প্রেমিকা থেকে ড্যানির পরিচয় এবার মিসেস স্মিথ।
তিনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন নাহ, ব্যাগি গ্রিন ক্যাপটা মাথায় আবার পড়বেনই।
১২.
স্টিভ মাঠে ফিরলেন। বুকে ধুকপুকানি থাকলেও বাইরে বুঝতে দিলেন নাহ। অ্যাশেজ ধরে রাখার মিশনে নামলেন এজবাস্টনে আর লিখলেন ফিনিক্স পাখির ন্যায় ঘুরে দাঁড়ানোর এক রূপকথা। লর্ডসে জোফরা আর্চারের বাউন্সারে লুটিয়ে পড়লেন উইকেটেই। আচ্ছা তখন কি একটু হলেও বন্ধু হিউজির কথা মনে পড়ছিল তার? বোধহয় হ্যাঁ। সে ম্যাচে আর ব্যাট করা হলো নাহ। পরের ম্যাচেও বসে রইলেন সাইডলাইনে। তার অনুপস্থিতিতেই কিনা স্টোকসের অতিমানবীক এক ইনিংসে ম্যাচ জিতে সমতা ফেরাল ইংল্যান্ডকে।
দলের বিপদের সময় কি আর বসে থাকতে পারেন স্মিথ। তিনি ফিরলেন ম্যানচেস্টারে। হাঁকালেন দ্বিশতক, নিশ্চিত করলেন দেড়যুগ পর ছাইদানিটা থাকছে অজি মুলুকেই। ৩ টেস্ট, ৫ ইনিংস, ৬৭১ রান, ১৩৪.২০ গড়, ৩টি সেঞ্চুরি, ২টি অর্ধশতক।
১৩.
অস্ট্রেলিয়া তার সেই গর্বের ধন আর আদরের ছেলেটাকে ফিরে পেল, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের সময়ে। বছর দেড়েকের অনুপস্থিতি ব্যাটে মরচে ফেলেনি মোটেও, বরং তা যেন ঠেসে ধরা ফোয়ারার মুখ। ছাড়া পেতেই উদগিরিত সমস্ত শক্তি আর প্রবল স্রোতে। রান করাই সবচেয়ে সহজ তার কাছে, আউট হওয়া সবচেয়ে অপছন্দ। পরাজিত হতে একদমই ভালো লাগে না তাঁর। তাকে চোরা আনন্দ দেয় ‘ব্র্যাডম্যানের পিছু পিছু’ চলার দুষ্টুমি।