ডাচ দূর্গের বৈচিত্র্যময় সেনানী

চোখে চশমা পরে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া যায়? যায়, যায়। এডগার ডেভিডস সেটা পারতেন। শুধু পারতেন না, নিয়ম মেনে তাই করতেন। শক্তিশালী দৃঢ় দেয়াল, বলের সাথে যার সখ্যতা তিনি তো প্রতিপক্ষকে নাকানি-চোবানি খাওয়াবেনই। যার দৃঢ়তা মুগ্ধতা ছড়িয়ে আদায় করে নিয়েছে ‘পিটবুল’ খ্যাতি।

১৯৭৩ সালের এমনই কোন এক তপ্ত মার্চের ১৩ তারিখে সুরিনামে জন্মেছিলেন এডগার ডেভিডস। তবে ফুটবল ক্যারিয়ারের হাতেখড়ি নেদারল্যান্ডসে। সুরিনাম থেকে নেদারল্যান্ডস হয়ে পরে ছড়িয়ে গেছেন গোটা বিশ্বে। বয়সটা ১২ হবার আগেই দু’দফা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে ডাচ ক্লাব ফুটবলের পরাশক্তি আয়াক্স। তবুও ক্ষুদে ডেভিস হার মেনে নিতে নারাজ। তৃতীয় দফা তিনি আবার চেষ্টা করলেন। এবার আর ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় ছিল না। আয়াক্স যুব অ্যাকাডেমি হল তাঁর ঘর।

সে থেকেই শুরু হল নতুন এক গল্প। ক্ষুদ্র এক আলোক রশ্মি থেকে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হওয়ার গল্প। আগ্নেয়গিরি যেমন লাভা নিজের মধ্যে রেখে দেয় বহুকাল ধরে, তেমনি ডেভিডস তাঁর বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখতে পারতেন অক্সিজেন। ৯০টা মিনিট তিনি ছিলেন অদম্য।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই আয়াক্সের মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ডেভিসকে অনায়াসে বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার হিসেবে খেলানো যায় আবার পুরাদস্তুর হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলানো যায়। তিনি পানির মতো পাত্রের আকার ধারণ করতেন।

তাই হয়ত আটখানা ভিন্ন ক্লাবের হয়ে অনায়াসে খেলে যেতে পেরেছেন। একেবারেই যে উত্থান-পতন ছুঁয়ে যায়নি তাঁকে তা বলার অবশ্য উপায় নেই। শুরুটা হয়েছেও চোক ধাঁধানো। শুরুর বছরেই তাঁর হাতে উঠেছিল উয়েফা কাপ। মৌসুমটা ১৯৯১/৯২।

এরপর টানা লিগ শিরোপাও জিতেছেন ডেভিডস। ছয় মৌসুম খেলেছেন তিনি ডাচ ক্লাবটির হয়ে। মাঝে টানা দুইবার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলেছিলেন ডেভিডস। একদফা ইউরোপের ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাও গগন পানে উঁচিয়ে ধরার সুযোগ হয় তাঁর। ভালই ছিলেন আয়াক্সে।

তবুও মানুষ নতুন কিছু খোঁজে, নতুন গন্তব্য টানে সবাইকেই। সব ধরণের টুর্নামেন্টে আয়াক্সের হয়ে ১৫৪ ম্যাচ খেলে ৩১ গোল করে তিনি পাড়ি জমান ইতালিতে। ১৯৯৬ এর দলবদলে তাঁর ঠিকানা হয় এসি মিলান। সেখানে সময়টা ভাল কাটেনি।

মূল একাদশে সুযোগের বড্ড অভাব তাঁকে দলতে ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৯৭ তেই তাঁর নতুন গন্তব্য জুভেন্টাস। জিনেদিন জিদানের সাথে জুঁটি বেঁধে শাসন করেছেন মধ্যমাঠ। ওল্ড লেডির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে জিতেছেন দুই বার সুপার কোপা ও তিনবার স্কুডেট্টো। তাছাড়া দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠেও সাদা-কালদের হয়ে ছুঁয়ে দেখা হয়নি ট্রফি।

সেখান থেকে তিনি ধারে খেলতে চলে যান স্পেনের কাতালুনিয়ার ক্লাব বার্সেলোনাতে। সেখানে স্বদেশী কিংবদন্তি ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের অধীনে খেলেন কিছুদিন। তারপর বিতর্কের জন্ম দিয়ে তিন বছরের চুক্তিতে চলে যান ইন্টার মিলানে। ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারলেন না তিনি। মাত্র ১৪ ম্যাচেই থামে তাঁর ইন্টার ক্যারিয়ার। দুই বছরের চুক্তি বাকি থাকা সত্ত্বেও ক্লাব নিজের ক্ষতি মাথায় নিয়ে ডেভিডসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।

ফ্রি এজেন্ট হয়ে তিনি ইউরোপের ফুটবল মার্কেটের হট কেকে পরিণত হন। বেশ কিছু ক্লাব রীতিমত উঠে পড়ে লাগে তাঁকে দলে ভেড়ানোর জন্য। জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনি ইংল্যান্ডের ক্লাব টটেনহাম হটস্পার্সের হয়ে নাম লেখান।

সেখানে ডাচ খেলোয়াড় মার্টিন জলকে পেয়ে নতুন এক সূচনার আভাস দেন। তবে টটেনহাম পর্বেও সুখ এসে ধরা দেয়নি। দুই বছরে ৪৪ বার তিনি নেমেছিলেন স্পার্সদের হয়ে। পেয়েছেন মাত্র একটি গোল। ২০০৬/০৭ মৌসুমে পুন:রায় তাঁর ডাক আসে আয়াক্স থেকে যে তাঁকে বানিয়েছিল মধ্যমাঠের দূর্গ সে ঘরকে উপেক্ষা করার উপায় আছে?

কোন ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই তিনি ফেরেন তাঁর শৈশবের ঘরে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে পেল যথাযথ মর্যাদা। আশা তিনি আলো ছড়াবেন, মাঠ কাঁপাবেন। তাই হল। সেই পুরোনো ডেভিডস ফিরলেন স্বরূপে। আয়াক্সের আবার একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের মর্যাদা অর্জন করে নিলেন তিনি। শিরোপা জেতাতে আবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকায় হাজির ডেভিডস।

২০০৭/০৮ মৌসুম শুরুর আগেই ঘটে অঘটন। বাজে এক ইনজুরি তাঁকে ছিটকে দেয় মৌসুমের বড় একটা অংশ থেকে। ২০০৮ সালের মে মাসে তিনি মাত্র ১৪ ম্যাচ খেলেই ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। ১৮ মাস তিনি বসে ছিলেন। কোন ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতে নামা হয়নি তাঁর। কি এক দুর্বিষহ সময় পার করেছেন তিনি! এরপর ইংলিশ ক্লাব ক্রিস্টাল প্যালেস তাঁর হাতে তুলে দেন ম্যাগপাই জার্সি। সেখানে বেশিদিন ঠায় হয়নি তাঁর। বছর দুয়েক বাদে অদ্ভুত এক প্রস্তাব পান তিনি।

ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগের দল বার্নাটের হয়ে খেলোয়াড় হওয়ার পাশাপাশি কোচ হওয়ার প্রস্তাব লুফে নিতে দেরি করেননি ডেভিডস। উদ্ভট এই দলবদলের পর আরও উদ্ভট এক কাণ্ড করে বসেন ডেভিডস। নিজেই নিজেকে ‘১’ নম্বর জার্সি দিয়ে দেন। ফুটবলে ঐতিহ্যগতভাবেই এই নম্বরটা গোলরক্ষকরা পরে থাকেন। তবে তিনি পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে সে জার্সি গায়ে জড়ালেন। তবে ক্লাবটিকে লিগে টিকে রাখার মতো কিছুই করতে পারেননি ডেভিডস।

বৈচিত্র‍্যময় এক ক্লাব ক্যারিয়ারের পাশাপাশি তিনি নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলেও কাটিয়েছেন বর্ণাঢ্য এক সময়। যদিও আন্তর্জাতিক কোন শিরোপা দিয়ে রাঙাতে পারেননি তিনি নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তব ১৯৯৮ সালে নিজের ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের বদৌলতে টুর্নামেন্টের সেরা একাদশে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছিলেন ডেভিডস।

২০০৪ সালে মার্কো ভ্যান বাস্তেন তাঁর হাতে জড়িয়ে দিয়েছিলেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। নেদারল্যান্ডেসে হয়ে ৭৪ ম্যাচে অংশ নিয়ে মধ্যমাঠে দাপটের সাথেই খেলে গিয়েছেন। ২০০৫ সালে সেই কমলা রঙের জার্সিটি পরে শেষ বার পা রেখেছিলেন সবুজ ঘাসের মেলায়।

ছয় গোলের ক্যারিয়ারে সাময়িক সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞারও মুখমুখি হয়েছিলেন। ডোপ টেস্টে বাগড়া। খেলোয়াড়ি জীবনের পাঠ চুকিয়ে তিনি এখন মন দিয়েছেন কোচিং ক্যারিয়ারে। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন পর্তুগিজ এক ক্লাবের ম্যানেজার হিসেবে।

আয়াক্স এবং জুভেন্টাসই ছিল এডগার ডেভিডসের পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময়। তবে মানুষের জীবন নদীর জোয়ার-ভাটা। সুন্দর সময়ে পেছনেই উঁকি দেয় দু:সময়। এমন কিছুই হয়ত হয়েছিল এডগারের সাথে। তবুও ডাচদের সর্বকালের সেরা খেলয়াড়দের একজন এডগার ডেভিডস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link