গত এক দশক ধরেই ইংলিশ জায়ান্ট আর্সেনাল বাজে সময় কাটাচ্ছে। মিকেল আর্তেতা এসে দলকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলেও ২০১৯-২০ মৌসুমের শুরুতেই ইনজুরিতে পড়লেন নিয়মিত গোলকিপার বার্নাড লেনো। লিগামেন্টের ইনজুরিতে ছিটকে গেলেন তিন মাসের জন্য।
আর্সেনালের বেঞ্চে দ্বিতীয় গোলরক্ষক তখন এমন একজন যিনি কিনা গত দশ মৌসুমে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ছয়টি! একপ্রকার বাধ্য হয়েই তার উপর ভরসা রাখলেন আর্তেতা। প্রথম ম্যাচে রাখতে পারেননি আস্থার প্রতিদান, কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে পারফরমেন্স ততই উন্নতি হয়েছে।
লেনো ফিরে আসলেও এফএ কাপ ফাইনালে তাকেই গোলবারের নিচে রাখলেন কোচ। এবার আর ভুল করলেন না, ম্যাচজুড়ে দারুণ সব সেভ দিয়ে আর্সেনালকে জেতালেন শিরোপা। এক মৌসুমের দারুণ পারফরমেন্স দিয়ে উঠে আসলেন বিশ্বসেরা গোলরক্ষকদের তালিকায়। তিনি এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
১৯৯২ সালে মার দে প্লাটার খুব দরিদ্র পরিবারে জন্ম এমিলিয়ানোর। ছোটবেলা থেকেই তাই দেখেছেন দারিদ্যের নির্মম কষাঘাত। ছোটবেলার এই কষ্ট ভুলতেই কিনা এমিলিয়ানো মজলেন ফুটবলে। বাকিরা যেখানে হতে চায় ম্যারাডোনা-বাতিস্তুতা, করতে চায় গোল।
সেখানে এমিলিয়ানো হতে চাইতেন গয়কোচিয়া-ইয়েশিন, গোল ঠেকিয়েই তার সব আনন্দ। ২০০৮ সালে সুযোগ পান ইন্দিপিন্দেন্তের হয়ে খেলার। তাদের হয়ে দুই বছর কাটানোর পর তার জীবনে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা, ইংলিশ ক্লাব আর্সেনাল তাকে নিজেদের দলে ভেড়াতে চায়।
কিন্তু বাদ সাধেন এমির মা এবং ভাই। তার ভাষায়, ‘আমার মা এবং ভাই কাঁদছিল আর বলছিল প্লিজ এমি আমাদের ছেড়ে যেয়ো না। অন্যদিকে আমার বাবা রাতে কান্না করতেন আর্থিক দুরবস্থার কারণে। আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হতো।’ এমিলিয়ানো বোধহয় নিয়েছিলেন সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্তটাই। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, নিজের দেশ ছেড়ে একদিন উঠে বসলেন লন্ডনগামী বিমানে। নতুন অধ্যায় শুরু হলো তার জীবনের।
আর্সেনালের হয় মাঠে নামারই সুযোগ পাচ্ছিলেন না এমি। ক্লাবে অনুশীলন আর বেঞ্চে বসেই কাটছিল লন্ডনের দিনগুলি। এরপর লোনে লোনেই কাটছিল তার দিন। কখনো অক্সফোর্ড ইউনাইটেড কিংবা শেফিল্ড, আবার কখনো রথারহ্যাম কিংবা রিডিংয়ের হয়ে খেলেন। মাঝে এক মৌসুমের জন্য লোনে গিয়েছিলেন স্প্যানিশ ক্লাব গেটাফেতে। কিন্তু থিতু হতে পারেননি সেখানেও।
পাথরে দীর্ঘদিন পানি ঢাললে পাথরেও ক্ষয় ধরে। তেমনি এমির দীর্ঘদিনের অধ্যবসায় আর সাধনা উপেক্ষা করতে পারেননি ফুটবল ঈশ্বরও। তাই তো লেনোর ইনজুরিতে অপ্রত্যাশিতভাবে সুযোগ পেয়ে যান আর তাতেই বাজিমাৎ। মৌসুমশেষে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডে যোগ দেন আরেক ইংলিশ ক্লাব অ্যাস্টন ভিলাতে।
ভিলাতে এসেই নিজের জাত চেনান এমি, নিচের সারির দল ভিলার দুর্বল রক্ষণভাগ নিয়েও মৌসুমজুড়ে রেখে গেছেন একের পর এক ক্লিনশিট। প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন গ্লাভসের দৌড়েও টিকে ছিলেন শেষ পর্যন্ত, রাখেন ১৫টি ক্লিনশিট। জ্যাক গ্রিলিশকে পেছনে ফেলে নির্বাচিন হন ভিলার বর্ষসেরা ফুটবলার।
ক্লাবের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাধে ডাক আসে আর্জেন্টিনা থেকেও। কিন্তু ফুটবল ফেডারেশনের নোংরা রাজনীতির কারণে জায়গা পাওয়া নিয়ে দেখা দেয় শংকা। কিন্তু কথায় আছে ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষেই থাকে। এবারো তাই, ফুটবল বিধাতা ছিলেন এমির পক্ষেই। কোপা শুরুর আগে ইনজুরিতে পড়েন আর্জেন্টিনার নিয়মিত গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আরমানি আর তাতে কপাল খুলে যায় এমির।
গ্রুপপর্বে দারুণ খেলে দলকে তুলেন সেমিতে। সেমিতে কলম্বিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার পুরো দল যেখানে ব্যর্থ সেখানে আকাশি-সাদাদের পুরো ম্যাচে টিকিয়ে রেখেছিলেন একাই। ম্যাচজুড়ে রুখে দিয়েছেন কুয়াদ্রাদো-জাপাতাদের একের পর এক আক্রমণ। স্ট্রাইকারদের হাস্যকর সব ভুলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে, সেখানেও এমি ঝলক। বরফ শীতল স্নায়ুর অধিকারী এমি ঠেকিয়ে দেন তিনটি পেনাল্টি! আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যান স্বপ্নের ফাইনালে।
ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা। মারাকানায় মেসির আজন্ম শিরোপা খরা কাটিয়ে ট্রফি উঁচিয়ে তুলতে পারবেন কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এমিলিয়ানো মার্টিনেজ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার এই যাত্রাটার জন্য।