এম এস ধোনি, ছকহীন-বাঁধাহীন

১.

‘আমরা সবাই কর্মচারী এবং আমরা জাতীয় কর্তব্য পালন করছি … ’

২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত এক দিনের ত্রিদেশীয় সিরিজের দল নির্বাচনে নবনিযুক্ত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যখন উপরের কথাগুলো বলছিলেন তখন তো জাতীয় নির্বাচকদের চক্ষু চড়কগাছ।

দোষ তাঁদেরও নয়। আসলে, তারা তো কোনোদিন এমনভাবে ভাবেননি। সিস্টেম এভাবে কোনোদিন ভাবায়নি। তারা প্রথাগতভাবে বর্তমান সময় কিংবা সময়ের চাহিদার থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বড় নামকে, বড় নামের পেছনে বসে থাকা বড় সংখ্যাগুলোকে। আর, তাদের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত ধারাবাহিকভাবে ভুগিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটকে।

মহেন্দ্র সিং ধোনির সাহসী মন্তব্যটা সেদিন নির্বাচকদের আঁকড়ে ধরে থাকা বাতিল ভাবনাগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে তাদের নতুন ভাবনার রসদ জোগালো। ফল পেল ভারতীয় ক্রিকেট – প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে এক দিনের সিরিজ জয়।

২.

‘তুমি বুঝতে পারছো ধোনি আমাদের জন্য বিশ্বকাপটা নিয়ে আসতে যাচ্ছে ?’

২০১১ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে যখন ভারত রান তাড়া করছিল তখন স্বভাববিরুদ্ধভাবেই ধোনি ড্রেসিংরুমের কাঁচঘেরা অংশের মধ্যে বসেছিলেন। কোহলি আউট হতেই কাঁচের বাইরে বসে থাকা প্রোটিয়া প্রশিক্ষক গ্যারি কার্স্টেনকে ডাকার জন্য ধোনি কাঁচে টোকা দিলেন। ইঙ্গিতে বোঝালেন যে তিনি টুর্নামেন্ট জুড়ে স্বপ্নের ফর্মে থাকা যুবরাজ সিংয়ের আগে ব্যাটে নামতে চলেছেন। ধোনি যখন ওয়াংখেড়ের ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি বেয়ে ব্যাট করতে নামছেন তখন যুবরাজ পাশে বসে থাকা প্রশিক্ষক গ্যারিকে উপরের কথাগুলো বলছিলেন।

প্রথাগতভাবে, টুর্নামেন্ট জুড়ে অফফর্মে থাকা অধিনায়ক স্বপ্নের ফর্মে থাকা ব্যাটারের আগে ব্যাট হাতে নামতে চাইবেন না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, চ্যাম্পিয়নরা কবেই বা স্বাভাবিক, সাধারণ নিয়ম মেনে চলেছেন ? সেদিন ধোনিও চলেননি।

ধোনির ক্রিকেট দীক্ষা ওকে বুঝিয়েছিলেন যে মুরলির স্পিনের বিষাক্ত ছোবলের সামনে বাঁ-হাতি যুবরাজকে ফেলে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তাই, নিজেই ব্যাট হাতে ক্রিজের দিকে এগোলেন। ব্যাট হাতে সতীর্থ যুবরাজের ভরসার দাম দিতে দিতে খেলাধুলার জগতে বহুল ব্যবহৃত এক প্রবাদ তার যৌক্তিকতা খুঁজে পেল – ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট!’

৩.

‘ম্যায় পাল দো পাল কা শায়ের হুঁ,

পাল দো পাল মেরি কাহানি,

পাল দো পাল মেরি হাস্তি হ্যায়,

পাল দো পাল মেরি জাওয়ানি হ্যায় … ’

যে দেশের ক্রীড়াসংস্কৃতিতে কিংবদন্তি বনে যাওয়া তারকা ক্রীড়াবিদদের সঠিক সময়ে অবসর নিতে না পারাটা একটা মহামারীতে পর্যবসিত হয়েছে। দলের থেকে এমনকি দেশের থেকে ব্যক্তির বড় হয়ে ওঠা যেখানে স্বাভাবিক রীতি সেখানে তারকা ক্রীড়াবিদের অবসর গ্রহণে বর্ণাঢ্য ফেয়ারওয়েল একটা চালু রেওয়াজ।

সেই প্রথাগত রেওয়াজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২০২০ সালের স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে টুইটারে একটি ছোট্ট ভিডিও পোস্ট করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করা – বিদায় লগ্নে ধোনি বুঝিয়ে দিলেন যে শুরুর দিনের মত আজও তিনি ব্যতিক্রম।

চিরকাল তিনি ব্যতিক্রম রয়ে যাবেন। চিরটাকাল তিনি বিধ্বংসী ব্যাটার, সাদা বলের ক্রিকেটে দেশের সর্বকালের সেরা উইকেট রক্ষক – ব্যাটার, বেস্ট ফিনিশার, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দেশের সর্বকালের সফলতম অধিনায়ক, ‘ক্যাপ্টেন কুল’ … এর সত্ত্বা পেরিয়ে অনুসরণযোগ্য জীবন দর্শন হয়ে রয়ে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link