কাইল মিলস, ইনজুরিতে হারানো পেস দানব

শেন বন্ডের গতি কিংবা স্যার রিচার্ড হ্যাডলির সুইংয়ের মাদকতা তাঁর বোলিংয়ে ছিল না। হালের টিম সাউদি কিংবা ট্রেন্ট বোল্টদের ভিড়ে আলাদা করে চেনাতে পারেননি এই প্রজন্মেও। তবুও নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের আক্ষেপ তিনি। নিজের সীমিত সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইনজুরির করাল গ্রাসে ক্যারিয়ারটা থমকে গেছে বারবার। তিনি কাইল মিলস, কিউই ক্রিকেটের আক্ষেপ। 

রাগবির দেশ নিউজিল্যান্ড। দীর্ঘদেহী মিলস যে কেন দেশের জনপ্রিয়তম খেলা ছেড়ে ক্রিকেটের নেশায় মজলেন সে এক প্রশ্ন বটে! বাড়ির উঠোনে বড় ভাইদের সাথে খেলতে গিয়ে কখন যে চামড়ার বলটার সাথে আড়ে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলে সে বোধহয় মিলস নিজেও জানেন না। অকল্যান্ডের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকের তিন বছর বাদেই ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে। 

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে মিলসের। প্রথম ম্যাচে আহামরি ভালো বোলিং না করলেও সবাইকে চমকে দেন দ্বিতীয় ম্যাচেই। শ্রীলংকার বিপক্ষে তিন উইকেটের ম্যাচজয়ী এক স্পেলে ম্যাচসেরার পুরষ্কারটা ভাগাভাগি করে নেন ম্যাথু সিনক্লেয়ারের সাথে। কিন্তু জাতীয় দলের একাদশে জায়গাটা তখনো পাকাপোক্ত হয়নি মিলসের। ২০০২ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে তুলে নেন তিন উইকেট। পরের বছরের বিশ্বকাপ দলে থাকলেও একাদশে ছিলেন মোটে এক ম্যাচে।

শেন বন্ড এবং ড্যারেল ট্যাফির জন্য আসলে দলে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছিলেন না মিলস। ভাগ্যের দরজা খুলে যায় পরের বছর ইংল্যান্ড সফরের আগে দুজনেই ইনজুরিতে পড়লে, টেস্ট দলে ডাক পান মিলস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওভালে নিজের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ছয় ওভার বল করার পরেই সাইড স্ট্রেনে চোটে পড়ে গোটা সিরিজ থেকেই ছিটকে যান তিনি। 

ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা জুড়েই ইনজুরি বারবার ভুগিয়েছে মিলসকে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, বরং লড়াই করে ফিরে এসেছেন বারবার। ২০০৬ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই প্রথমবারের মতো মিলসের বিধ্বংসী বোলিংয়ের দেখা পায় গোটা বিশ্ব। সেবারে মাত্র চার ম্যাচে দশ উইকেট নিয়ে কিউইদের সেরা বোলার ছিলেন তিনি। ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে ছিলেন ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে। শেন বন্ড এবং তাঁর জুটি দেখার অপেক্ষায় ছিল গোটা বিশ্ব। কিন্তু আরো একবার ইনজুরির আঘাত! বিশ্বকাপ দল থেকে অশ্রুসজল চোখে নাম প্রত্যাহার করে নেন মিলস। 

ইনজুরি থেকে ফিরেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ শুরু করেন ২৫ রানে পাঁচ উইকেট শিকার করে। কিউইরা ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও সিরিজ সেরার পুরষ্কার জেতেন মিলসই। অন্যদিকে, শেন বন্ড নিষিদ্ধ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) এ নাম লিখিয়ে জাতীয় দল থেকে নির্বাসিত হলে প্রথমবারের মতো কিউই বোলিং লাইন আপের নেতৃত্বভার পান মিলস। 

২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে যান আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে। যদিও সেবার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আর পেরে ওঠেননি মিলসরা, সন্তুষ্ট থাকতে হয় রানার্সআপ হয়েই। ২০০৯ সালে চ্যাপেল-হ্যাডলী সিরিজে নয় উইকেট শিকারের পর প্রথমবারের মতো আইসিসি বোলিং র‍্যাংকিংয়ের এক নম্বরে উঠে আসেন মিলস। কিন্তু ইনজুরির কারণে আরো একবার ছন্দপতন ঘটে মিলসের ক্যারিয়ারে! ২০১১ বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়েন মাত্র তিন ম্যাচ শেষেই। 

আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বরাবরই দুহাত ভরে দিয়েছে মিলসকে। ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও তুলে নেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ছয় উইকেট। ২৮ উইকেট শিকার করে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি। ২০১৩ সালে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও করেন এই পেসার। ২০১৫ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে থাকলেও কোনো ম্যাচে মাঠে নামা হয়নি এই পেসারের। 

২০১৫ সালে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান মিলস। লাল বলের চাইতে সাদা বলের ক্রিকেটেই বেশি কার্যকরী ছিলেন এই পেসার। ১৯ টেস্টে ৪৪ উইকেট শিকার করলেও ১৭০ ওডিয়াইতে নিয়েছেন ২৪০ উইকেট। এছাড়া ৪২ টি- টোয়েন্টিতে তাঁর উইকেটসংখ্যা ৪৩। নিচের দিকে নেমে ব্যাট হাতে ঝড় তুলতে মিলসের জুড়ি মেলা ভার। 

একদিনের ক্রিকেটে দুইটি হাফসেঞ্চুরি আছে তাঁর নামের পাশে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাঁর কার্যকারিতার সুবাদে আইপিএলের দলগুলোতেও ছিল তাঁর কদর। খেলেছেন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব এবং মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের মতো দলে। 

মাঠ ছাড়লেও ক্রিকেটকে বিদায় জানাননি মিলস, জড়িয়েছেন ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে। ২০২০ আইপিএলে কাজ করেছেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের বোলিং কোচ হিসেবে। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে আছে আজন্ম আক্ষেপ, মিলস তাই কাজ করে যাচ্ছেন কিউই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তারকাদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link