পারভেজ ‘ওয়ানডে স্পেশালিস্ট’ মাহরুফ

পারভেজ মাহরুফ শুরুটা ছিল উইকেটরক্ষক কাম ব্যাটার হিসেবে। সেখান থেকে কিভাবে বনে গেলেন ‘অলরাউন্ডার পারভেজ মাহরুফ’ – সেই গল্পটি দারুণ মজার।

পারভেজ মাহরুফ শুরুটা ছিল উইকেটরক্ষক কাম ব্যাটার হিসেবে। সেখান থেকে কিভাবে বনে গেলেন ‘অলরাউন্ডার পারভেজ মাহরুফ’ – সেই গল্পটি দারুণ মজার।

ভবিষ্যত ক্রিকেট তারকা তৈরির স্বনামধন্য কলেজ ওয়েসলি কলেজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কলেজের একটি ম্যাচ চলছিল। কিন্তু, মাহরুফের পাঁচজন সতীর্থ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে খেলায় নামতেই পারলেন না। দলে বোলার সংকট।

কি উপায় তবে? শেষমেশ বোলারের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য মাহরুফের হাতে বল তুলে দেয়া হলো। সেদিন তিনি একটি হ্যাটট্রিক নিয়ে ম্যাচ শেষ করেছিলেন। চমকপ্রদ ব্যাপার বটে। খুঁজে পেলেন বোলিংয়ে নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে। সিদ্ধান্ত  বদলে বোলিংয়ে মনোনিবেশ করলেন মাহরুফ। উইকেট কিপিংটা ছেড়ে দিলেন। সেই থেকে ক্রিকেট বিশ্ব পেল একজন অলরাউন্ডার পারভেজ মাহরুফকে। যদিও, কালক্রমে নিজের সহজাত প্রতিভার প্রতি তিনি সুবিচার করতে পেরেছেন সামান্যই।

আট বছর বয়স থেকে ক্রিকেটে হাতেখড়ি তাঁর। পারভেজ মাহরুফকে মানা হতো ওয়ানডে ফরম্যাটে শ্রীলঙ্কা দলের সবচেয়ে প্রতিভাবান অলরাউন্ডার হিসেবে। ছন্দময় রান করতেন, উইকেট টু উইকেট ছিল তাঁর বিশেষত্ব। মাহরুফ ২০০৪ সালে ‘এ’ দলের হয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে যান। সেখানে তিনি ১১.৭৭ গড়ে নয় উইকেট নিয়ে আসেনযা ছিল টুর্নামেন্টের সেরা।

এই রকম উল্লেখযোগ্য কিছু পারফরম্যান্সের জন্য দ্রুতই জায়গা জুটে যায় অনূর্ধ্ব- ১৯ দলে। একই বছরেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের জন্য অধিনায়ক মনোনীত হন। সেই বিশ্বকাপে খুব একটা না এগোলেও মাহরুফ জিম্বাবুয়ের অনূর্ধ্ব-১৯ এর বিপক্ষে ৯.৩ ওভারে ২৮ রানের বিনিময়ে চার উইকেট নিয়েছিলেন। ৯০ ডেলিভারিতে ৫৬ রান করে অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ এর বিরুদ্ধে তাঁর দলকে স্মরণীয় জয় এনে দিয়েছিলেন।

২০০৪ সালেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাঁর টেস্ট ও ওয়ানডে অভিষেক হয়। পারভেজ মাহরুফের ওয়ানডেতে আন্তর্জাতিক অভিষেক ম্যাচটি স্মরণীয় একটি ম্যাচ। কারণ সেই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে তাঁদের ওডিআই ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্কোর ৩৫ রানে অলআউট হয়ে যায়। ম্যাচটিতে অভিষিক্ত সিমার মাহারুফের বোলিং পরিসংখ্যান ৩৩। আর ৪, ৪, ৭, ০, ০, ২, ৪, ৩, ০, ৪, ০, ৭ – এই সংখ্যাগুলো ছিলো জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটারদের ওই ম্যাচের ব্যক্তিগত সংগ্রহ!

২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কা আয়োজিত ত্রিজাতি-র ইন্ডিয়ান অয়েল কাপে আহত চামিন্দা ভাসের বিকল্প হিসেবে তিনি উদ্বোধনী বোলিংয়ে নেমেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে মাহারুফ দশ ওভার বোলিং করে মাত্র নয় রানের বিনিময়ে তিনটি উইকেট তুলে নিলেন। এটি একটি অসাধারণ বোলিং স্পেল ছিল যাতে তিনি পাঁচটি মেডেন ওভার দিয়েছিলেন। সেই ম্যাচে ০.৯০ ইকোনমি রেট ছিল তাঁর। ওয়ানডের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা মিতব্যয়ী বোলিং পরিসংখ্যানের নজির ছিল এটি।

ওডিআই ক্যারিয়ারের তুলনায় মাহরুফ খেলার দীর্ঘতম ফরম্যাটে তেমন সাফল্য পাননি। তবুও ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোম সিরিজটির দ্বিতীয় টেস্টটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই টেস্টে এক উইকেটের চাঞ্চল্যকর জয়ে ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন পারভেজ মাহরুফ।

২০০৬ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার করেন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। মাহরুফের মাত্র চৌদ্দ রানে ছয় উইকেটের পরিসংখ্যানটি, শহীদ আফ্রিদির এগারো রানে পাঁচ উইকেটকে ডিঙিয়ে টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সেরা বোলিং ফিগারে পরিণত হয়েছিল।

মাহরুফের সাধারণ টেমপ্লেট ছিল-  ব্যতিক্রমী লাইন যা ক্রিজে থাকা ব্যাটসম্যানদের গলা টিপে ধরে এবং তাদের ভুল করতে বাধ্য করতো। বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে নেমে তিনি প্রথম শ্রীলঙ্কান যিনি বিশ্বকাপ অভিষেকেই চার উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। পারভেজ মাহরুফ তার ৭৫তম ওডিআইতে তার শততম উইকেট তুলে নেন, যেখানে এই রেকর্ড গড়তে স্পিন কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের  ৭৬ টি ম্যাচ খেলেছিলেন।

২০০৮ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) উদ্বোধনী মৌসুমে, মাহরুফকে দিল্লী ডেয়ারডেভিলস দলে ভেড়ায়। তিনি তাঁর শালীন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দিয়ে তাঁর মূল্যের ন্যায্যতা দিয়েছিলেন। তিনি টুর্নামেন্টে পনেরোটি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। তিনি একাধিকবার কুঁচকিতে আঘাত পেয়েছিলেন যা তার ক্যারিয়ারের আকস্মিক সমাপ্তির হুমকি দিয়েছিল। ২০০৮ সালের এশিয়া কাপ এর জন্য সম্পূর্ণ ফিটনেস ফিরে পেতে ব্যর্থ হন। প্রায় আঠারো মাস সাইডলাইনে সময় কাটাতে হয়েছিল তাঁকে।

২০১০ সালের এশিয়া কাপে ভারতের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে তিনি বিশ্বকে জানান দিয়েছিলেন যে তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জাতীয় দলে ধীরে ধীরে তাঁর জন্য সুযোগ ফুরিয়ে যায়। একসময় তিনিও মিইয়ে যান। ২০১১ সালে জাতীয় দলে তার স্থান পুনরুদ্ধার করতে ইংলিশ কাউন্টিতে ল্যাঙ্কাশায়ারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। এবং কাউন্টি অভিষেকে সেঞ্চুরি করে একটি রেকর্ড তৈরি করেন। মাহারুফকে আবারো টেস্ট দলে ডাকা হয়েছিল কিন্তু তার জায়গা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন।

ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে মাহরুফ শ্রীলঙ্কার হয়ে ১০৪ টি ওয়ানডে খেলে ১০৪২ রান করেছেন এবং ১৩৩ টি উইকেট নিয়েছেন। ২২ টেস্টে মাহারুফের নামের পাশে  ৫৫৬ রান এবং ২৫টি উইকেট রয়েছে। হয়তো একটি সফল ওয়ানডে ক্যারিয়ার থাকা সত্ত্বেও অন্য ফরম্যাটে ব্যর্থতা ও ইনজুরির কারণে তাঁর ক্যারিয়ারটা আশানুরূপ হয়নি। কিন্তু এই ফরম্যাটে তাঁর অবদান মনে রাখতেই হবে। পারভেজ মাহরুফ ছিলেন ওয়ানডে স্পেশালিস্ট। সময় পেলে হয়তো ওয়ানডের গ্রেটও হতে পারতেন তিনি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link