মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ…

‘If you don’t have a dog to go hunting but only have a cat, you have to take your cat. You’ll catch less, but you’ll catch something all the same.’

২০০৮-০৯ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের লড়াই থেকে ছিটকে যাওয়া রিয়াল, অন্যদিকে মারকাটারি উত্থান আর ট্রফিতে ট্রফিতে ভরে ওঠা বার্সেলোনা। সেবার প্রথম পেপ হটসিটে বসেই চমকে দিলেন কাতালুনিয়ার ওই ক্লাবের সমর্থকদের। অপরদিকে রিয়ালের অবস্থা তথৈবচ।

২০০১-০২ এর পর ক্লাবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ঢোকেনি। গ্যালাকটিকোসের শোচনীয় পরিণামের কথা মাথায় রেখেও প্রেসিডেন্ট পেরেজ দ্বিতীয়বার আরেকটা চ্যালেঞ্জে হাত বাড়ান। ২০০৯-১০, সদ্য মাদ্রিদ থেকে ইন্টার মিলানে গিয়েই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন স্নেইডার আর ফাইনাল খেলেছেন রবেন। বদলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে সদ্য ব্যালন ডি’অর জেতা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, এসি মিলান থেকে কাকা, লিভারপুল থেকে জাবি আলান্সো আর আরবেওলা এবং অলিম্পিক লিঁও থেকে করিম বেনজেমা।

কোচ ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি ফর্ম সাজালেন ৪-২-১-৩। প্রধান অ্যাটাকিং মিড কাকার প্লে-মেকিংয়ে ভরসা করে দুই উইংগার রোনালদো আর হিগুয়েনের মাঝে প্লেস করলেন বেঞ্জেমাকে। ফলে, ইনভার্টেড উইংগারদ্বয় মাঝে ঢুকে পড়তে পারে বেঞ্জেমার আন-অর্থোডক্স নাম্বার নাইন হওয়ায়। শুধু সেটাই নয়, বেঞ্জেমার পেরিফেরাল মুভের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতিপক্ষের হাফ থেকে মার্কারকে টেনে নিচে নামিয়ে আপফ্রন্টের দরজা খুলে দেওয়া, অর্থাৎ বক্স স্ট্রাইকার নয়- প্লে-মেকার হিসেবে আনঅর্থোডক্স নাম্বার নাইন।

বক্স ও বক্সের বাইরে যার চলাফেরা হবে যে কোনও ভাবে উইংগারদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে। লেফট আর রাইট ফরোয়ার্ডের মধ্যে হিগুয়েনই আসল নাম্বার নাইন ছিল তখন।

ফল একেবারেই আশাপ্রদ হল না। কোপা ডেল রে-তে বাজে হারল আলকর্কন বলে একটা ছোট ক্লাবের কাছে ৪-০ তে (মোট ৪-১!)। লিগে জিততে শুরু করলেও শেষে লিগ পাওয়া হয়নি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও আউট। পুরো মৌসুম ট্রফি ছাড়া, সঙ্গে বেঞ্জেমার পারফরম্যান্স তলানিতে। ৩৩ ম্যাচে মাত্র ৯ গোল। এর সাথে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে বিদায় জানালেন ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনিও।

সেই মৌসুমে রিয়ালের কোচ হয়ে বার্নাব্যুতে পদার্পন করলেন সদ্য ইন্টার মিলানকে ইউসিএল জিতিয়ে আসা হোসে মরিনহো। এসেই ছক পাল্টালেন। ৪-২-১-৩ হয়ে গেল ৪-২-৩-১। অর্থাৎ কাকার খেলা বন্ধ। পরের মৌসুমে এলেন এক জার্মান, মেসুৎ ওজিল। বেনফিকা থেকে এলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। টটেনহ্যাম থেকে লুকা মদ্রিচ আর কিছু পরে গ্যারেথ বেল (তখন অবশ্য আন্সেলোত্তি কোচ, ৯২ঃ৪৮ এর স্মৃতি)। রোনালদো হয়ে গেলেন রোটেশনাল স্ট্রাইকার। ফল এল হাতেনাতে।

লোন স্ট্রাইকার হিসেবে উপরে খেলল মোরিনহোর প্রথম পছন্দ হিগুয়েন। মৌসুম শেষে লিগ এল ঘরে। রোনালদো এই সিজন থেকে হয়ে উঠল জায়ান্ট আর ক্রমশ তমশাবৃত অঞ্চলে ভিড়ে যেতে লাগল করিম বেঞ্জেমা। আর তার পরেই ওই বিখ্যাত বিতর্কিত মন্তব্য মোরিনহোর। যার জেরে পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলনে বেঞ্জেমাও মুখ খুলবে, আর বাকিটা…

এরপর ঘন অন্ধকারে পথ হারিয়ে একা হয়ে গেলেন বেঞ্জেমা। এর এক বছর পর থেকেই মাদ্রিদ সমর্থকদের চোখে খলনায়ক হয়ে উঠবে বেঞ্জেমা। লাগাতার ব্যঙ্গ, কার্টুন প্রকাশিত হবে স্প্যানিশ ম্যাগাজিনে। বেরিয়ে যেতে বলবে সদস্য-সমর্থকরা। স্ট্যাট বলবে, খুব খুব খারাপ পারফরম্যান্সের কবলে না পড়েও নিজের ক্লাবে, নিজের গোছানো সংসারের মধ্যেই একা হয়ে পড়বে লোকটা আর তারপর মাদ্রিদের হটসিটে বসবে এসে জিনেদিন জিদান। সেই মাদ্রিদের পজিশনওয়াইস বেস্ট প্লেয়ারদের মধ্যে একা বেনজেমার মিস নিয়ে সরব হবে গোটা মাদ্রিদ।

সেই মাদ্রিদ, ৯০ মিনিটের আগে যারা হারে না। সমর্থকদের বানিয়ে আনা টিফো এখন প্রবাদ। সেই মাদ্রিদে দিনের পর দিন সহজ সুযোগ নষ্ট করে যাওয়া বেঞ্জেমা কেমন নিশ্চুপ ভাবে থেকেই গেল। কেউ লক্ষ্যই করেনি, এমনভাবে। মাঝে ওজিল আর্সেনালে, ক্যাসিয়াস পোর্তোতে, রোনালদো জুভেন্টাস, ডি মারিয়া ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এবং হামেস রদ্রিগেজ ক্লাব ছেড়ে দিলেও আশ্চর্যজনক এটাই যে – বেঞ্জেমার রয়ে যাওয়া। প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের দূরদর্শিতা এখানেই, যে তিনি বেঞ্জেমাকে শেষ অবধি রেখেই দিলেন। আর তারপর রিয়ালের ভরাডুবির সময় কোচ হয়ে এলেন জুয়ান লপেতেগুয়ে।

৪-৩-৩। অনেকদিনের খেতে না পাওয়া গ্রে হাউণ্ড ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে। লোপেতেগুয়ের ৪-৩-৩ এ বেঞ্জেমা সেই পুরনো জায়গা ফিরে পেল যেখানে পেলেগ্রিনির আমলে সেট হতে হতেও হয়নি। শুরু হল সেই পেরিফেরাল মুভ। প্লাস, তখন ২০১৮। ন’বছরের টানা অভিজ্ঞতাকে বগলদাবা করে মাঠে নেমে পড়া। গোল আসতে থাকল একটা-দুটো। আর এই কাজে বেঞ্জেমাকে সাহায্য করল এক উঠতি ব্রাজিলিয়ান, ভিনিসিয়াস জুনিয়র। যার লেফট ফরোয়ার্ড প্লে আর ইনভার্টেড উইংপ্লে বেনজেমার সামনে খুলে দিল গোলের দরজা।

এতকালের চেপে রাখা অভিমানগুলো ছোট বডি-ফেন্ট, লবের বল ধরে কোমর ঘুরিয়ে মারা চকিত শটে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। ফল আশাপ্রদ না হলেও, লপেতেগুয়ে কাজটার একটা শুভারম্ভ করে গেলেন। যে সার্কেলটা এসে কমপ্লিট করবেন এই জেনারেশনের সবচেয়ে সফল কোচ কার্লো আন্সেলোত্তি।

রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাস ঘেঁটে বার করতে বেশিদূর যেতে হয় না। ওখানেই লেখা আছে মদ্রিচের সাইনিং নিয়ে বলা কথাখানা। ঠিক তেমনই এই গল্পের উপসংহারে লুকিয়ে আছে অনেকদিনের না লেখা গল্পের খসড়া। সিজন ২০১৬-১৭। বেঞ্জেমার গোল মাত্র ১৯। তার পরের সিজন ২০১৭-১৮ আরও খারাপ। সারা সিজনে বেঞ্জেমার গোল সংখ্যা মাত্র ১২! তখন সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে লোকটা, সতীর্থরা নিজ নিজ অর্জিত ট্রফি হাতে হাসিমুখে, পোজে দাঁড়িয়ে।

বদ্ধ ড্রেসিংরুমের দেওয়ালে চোয়াল চাপা জলটাকে আটকে রেখেই হাসিমুখে সতীর্থদের সাফল্যে হাততালি দিচ্ছে ওই দূরে। কেউ যাতে দেখতে না পায়। স্কুলের ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়দের ভিড়ে হারিয়ে গেছে একটা লড়াই। নিজের সাথে, ক্লাব, ক্ষিপ্ত জনতা, কোচ, ক্লাব ম্যানেজমেন্ট- কেউ বাদ নেই। আসল লড়াই তো নিজের সাথে। অন্ধকার ঘরে একা বসে থাকার লড়াই, কোথাও কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না, তল নেই, কিছুই নেই। কে আছে, যে দেখবে আমিও পারি?

আজ বেঞ্জেমা ব্যালন ডি’অর নিতে উঠল সারা বিশ্বের সামনে। তাঁরই স্বদেশীয়, তাঁর প্রাক্তন কোচের হাত থেকে। যে জিদান ভরসা রেখেছিল একদা বেনজেমার উপর। ব্যঙ্গবিদ্রুপে বিদ্ধ হতে হতে দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া বেঞ্জেমা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে হারতে থাকা অবস্থায় ম্যানচেস্টার সিটির বিরুদ্ধে পাওয়া পেনাল্টিতে মারল পানেনকা কিক, যা একদা তাঁর সাবেক কোচ জিদান মেরেছিল ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে। মাদ্রিদে হারতে থাকা ম্যাচ তাই কোনও ওভারনাইট সাকসেস নয়, কোনও চমক, ম্যাজিক কিচ্ছু নয়, এর পিছনে পড়ে আছে ১৪ বছরের না পাওয়া কিসসার দস্তাবেজ।

ব্যর্থতায় পিএইচডি করা স্ট্রাইকার থেকে এই মুহূর্তের ‘গ্রেটেস্ট নাম্বার নাইন’ হয়ে ওঠার এই টানা জার্নিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, সেটা হল নিজের প্রতি কখনও বিশ্বাস না হারানো বেঞ্জেমা স্বয়ং। জিদান ব্যতীত কেউ কখনও দেখেনি বেনজেমার খেলায় উন্নতি হচ্ছে কি না, কেউ কখনও সামিল হয়নি তাঁর অন্ধকার সময়ের মধ্যে আলো খুঁজে বেড়ানোয়। নিজের মধ্যে ফুটতে থাকা জেদ, অপরিসীম পরিশ্রম আর অবিচল বিশ্বাস- বাকি সতীর্থদের মতো আজ বেনজেমাও তাহলে পোডিয়ামে! জীবনে প্রথমবারের মতো ক্লাব আর দেশ মিলিয়ে ৫০ গোল করে!

মানুষ সব পারে। সব! শুধু সঠিক সময়কে আসতে দিতে হয়। এই আমরাও পারি। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে ঝুলে ঝুলে দু’টো ভাত পাওয়ার আশায় যে অসংখ্য আমরা খেটে চলেছি অবিরাম, কম্পিউটারের সামনে গায়ে ১০২ জ্বর নিয়েও কাজ করে চলেছি তাদের সবার গল্প বেনজেমা হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে লিখে গেছে বার্নাব্যুতে, প্যারিসে, এতিহাদে, স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে। ‘বিলিভ ইন ইওরসেলফ’-এর প্রকৃত মানে বুঝিয়ে গেছে এক ফিনিশড ফুটবলার। হ্যাঁ, ফিনিশড। স্প্যানিশ ম্যাগাজিন তাই-ই বলেছিল ওকে। বেঞ্জেমা আজ সোনার বলটা নিয়ে যেন জোরে জোরে বলল রবার্ট‌ ফ্রস্টের লেখা ওই জানা কথাগুলোই – ‘And miles to go, before I sleep’।

বেনজেমা পারল। বেঞ্জেমারা পারেই। লাইমলাইটের নিয়ন আলোর পেছনে অন্ধকারে বসে থাকা সব লড়াকুগুলো একদিন বেঞ্জেমা হয়ে উঠবেই উঠবে, এ এক দৃঢ় বিশ্বাস লোকটা দিয়ে গেল। শিখতে পারলাম? কে জানে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link