ফিন অ্যালেন, ভবিষ্যতের টি-টোয়েন্টি দানব

১১ বছর আগের কথা। নিউজিল্যান্ডের পেসার ট্রেন্ট বোল্ট সে বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখলেন। হোবার্টে অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টেস্ট অভিষেক, একই সাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও। দুই ইনিংস মিলিয়ে নিলেন চার উইকেট।

তার চেয়েও বড় কথা নিজের অভিষেকেই দেখা পেলেন জয়ের দেখা। সেই ট্রেন্ট বোল্ট এ বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলবেন, তবে নিয়মিত না। 

হঠাৎ দৈবভাবে ট্রেন্ট বোল্টের প্রসঙ্গ তোলার কারণ? সেই যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অভিষেক হয়েছিল বোল্টের, ঐ ম্যাচের পর আর কখনোই অজি দূর্গে ম্যাচ জেতা হয়নি নিউজিল্যান্ডের। অবশেষে সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটেছে এই বিশ্বকাপে এসে।

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে কিউইরা হারিয়েছে ৮৯ রানের বিশাল ব্যবধানে। ৯২ রান করে সে ম্যাচটিতে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন ডেভন কনওয়ে। কিন্তু কিউইদের শুরুর ঝড়টা এসেছিল ফিন অ্যালেনের ব্যাট থেকে।

উইকেটে এসে কোনো রকম থিতু হওয়া নয়, একদম শুরু থেকেই বোলারদের বলে বেধড়ক পিটুনী দেওয়া- এমন মন্ত্রে ক্রিকেট মঞ্চে নিজেকে আলোকিত করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। ম্যাককালামের সেই মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে বেশ কিছু বছর বাদে কিউইদের হয়ে যেন আরেক ম্যাককালামের আবির্ভাব।

তিনি এই ফিন অ্যালেন। প্রতিপক্ষ বোলার কে কিংবা প্রতিপক্ষের বোলিংয়ের শক্তিমত্তা, এসবের কোনো কিছুই তাঁর কাছে বিবেচ্য বিষয় না। পূর্ণ মনযোগ নিজের হিটিং জোনকে কেন্দ্র করেই। 

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবারের বিশ্বকাপের ম্যাচে ফেরা যাক। ফিন অ্যালেন ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে আসলেন। প্রতিপক্ষ বোলিং লাইনআপে আছে মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্সদের মতো পেসার। যাদের কাছে এসে তাঁর পূর্বসূরি ব্রেন্ডন ম্যাককালামেরও দৌরাত্ম্য থেমে গিয়েছিল। কিন্তু, ওসবে যেন কোনো আগ্রহই নেই অ্যালেনের।

উইকেটে এসে প্রথম বলটা শুধু ডিফেন্স করলেন। আর এরপর থেকেই তাণ্ডব শুরু। ৪, ৬, ডট, ৪, ডট, ১, ৪, ৪, ৪, ডট, ৬, ২, ৬, ১। অর্থাৎ ৫ চার আর ৩ ছক্কা। অঙ্কগুলোর সমষ্টি করলে দাঁড়ায় ১৫ বলে ৪২ রান। ১৬ তম বলে এসে আউট। কিন্তু ততক্ষণে নিউজিল্যান্ডের রানের গতিকে নিয়ে গেছেন দূর সীমানায়।

ফিন অ্যালেনের এমন ব্যাটিং তাণ্ডব পরবর্তী ম্যাচগুলোয় আর দেখা যায়নি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচে শুধু ১৮ বলে ৩২ রান করেছিলেন। তবে ব্যাট হাতে তেমন ইনিংস বড় করতে না পারলেও স্ট্রাইকরেট ছিল ১৯০। 

ফিন অ্যালেনের ক্যারিয়ার জুড়েই অবশ্য বড় ইনিংসের দেখা মেলে কম। এখন পর্যন্ত ২২ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। সেখানে ৩ টি ইনিংস বাদে সব ইনিংসেই তিনি আউট হয়েছেন পাওয়ার প্লের মধ্যে।

আরো সূক্ষ্ম একটা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তিনি গড়ে প্রতি ইনিংসে ১৫ টি বল খেলেছেন। অর্থাৎ ফিন অ্যালেন সাধারণত লম্বা ইনিংস খেলা ব্যাটার না। তাহলে দলে তাঁর ইম্প্যাক্টটা কোথায়? সেটিই একটু খুঁজে বের করা যাক। 

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ফিন অ্যালেনের ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ১৬৬। যেটি ন্যূণতম ৫০০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১৭৭ স্ট্রাইকরেট নিয়ে শীর্ষে আছেন সুরিয়াকুমার যাদব। তবে সব ধরনের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মিলিয়ে ন্যূণতম ১০০০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে স্ট্রাইকরেটের দিক দিয়ে আবার শীর্ষে ফিন অ্যালেন। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর স্ট্রাইকরেট ১৭২। 

এবার আসা যাক, বাউন্ডারির অনুপাত বিবেচনায় ফিন অ্যালেন কতটা সফল। এখানে পরিসংখ্যান বলছে, ফিন অ্যালেন প্রতি ৩.৮ বলে একটি করে চার বা ছক্কা হাঁকান। যা রীতিমত অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ এই মুহূর্তে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পাওয়ার হিটার ব্যাটারের নাম করতে গেলে আন্দ্রে রাসেলের নাম সবার আগে আসবে। সেই রাসেল প্রতি ৪ বলে একটি করে বাউন্ডারি মারেন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির হিসেবে সে অনুপাতটা ১ঃ৪.৬। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফিন অ্যালেনের গড়ে ১৫/২০ বলের ইনিংসের কার্যকারিতা কতটুকু। অন্তত মার্টিন গাপ্টিলের জায়গায় তাঁর অন্তর্ভূক্তি কি নিউজিল্যান্ডকে আগের চেয়ে পরিবর্তিত করছে? উত্তর হলো- হ্যা। কারণ ফিন অ্যালেনের ইনিংস ছোট হলেও ইম্প্যাক্ট বিবেচনায় সেটির গুরুত্ব অনেক।

এর পিছনে প্রথম যুক্তিটা হলো, পাওয়ার প্লে’তে কিউইদের দারুণ শুরু এনে দিচ্ছেন ফিন। যেটি নিউজিল্যান্ডকে বড় সংগ্রহের পথে এগিয়ে দিচ্ছে। এমনকি প্রতিপক্ষের বড় টার্গেট চেজের ক্ষেত্রেও ম্যাচে ফিন অ্যালেনের থাকাটা জরুরি। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৩৬ বলে পঞ্চাশ রানের ইনিংসের চেয়ে ১৮ বলের ৩৬ রানের ইনিংসের গুরত্ব অনেক। সেই বিবেচনায় ফিন অ্যালেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দারুণ কার্যকর।

বলের হিসেবে ইনিংস ব্যপ্তির বিবেচনায়, আন্দ্রে রাসেল প্রতিটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে গড়ে ১৬ টি করে বল খেলেন। টপ অর্ডার ব্যাটারদের মধ্যে পৃথ্বী শ প্রতি ইনিংসে গড়ে বল খেলেন ১৮ টি। সেখানে তাঁর স্ট্রাইকরেট ১৫২। পাকিস্তানের স্কোয়াডে যুক্ত হওয়া মোহাম্মদ হারিস আগে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতেন।

তখন পুরনো বলে তাঁর স্ট্রাইকরেট ছিল ১৩৮। অথচ টপ অর্ডারে উঠে এসে নতুন বলে তাঁর বলের ব্যপ্তি ১৬ তে নেমে গেলেও স্ট্রাইকরেট গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৬ তে। আর মোহাম্মদ হারিসের ঐ ইনিংসগুলোই দলকে এগিয়ে দিয়েছে।

মূলত টি-ক্রিকেটে বল বেশি খেলার চেয়ে দ্রুত গতির ইনিংস প্রয়োজন। আর বিগত বছর গুলোতে ওপেনিংয়ে এসে এমন ইনিংসগুলোই ম্যাচ জয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার  বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচের একটা উদাহরণ টানা যেতে পারে।

তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কখনোই ২০০ রান চেজ করে জেতেনি। কিন্তু শ্রীলঙ্কা সেবার বাংলাদেশের সামনে টার্গেট দিল ২১৫! এমন ম্যাচ জেতার জন্য পাওয়ার প্লে তে প্রয়োজন ছিল উড়ন্ত শুরু। লিটন দাস সেই কাজটিই করেছিলেন। খেলেছিলেন ১৯ বলে ৪৩ রানের ইনিংস।

পরবর্তীতে মুশফিকের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে জিতে যায় বাংলাদেশ। মুশফিকের ৭২ রানের ইনিংসে লিটনের ঐ ইনিংস টা আড়ালে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সে ম্যাচ জেতার পথটা সহজ করে দিয়েছিল লিটনের ঐ ইনিংসটিই।    

সামনের বিশ্ব ক্রিকেট টা হবে টি-টোয়েন্টি কেন্দ্রিক। তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সংজ্ঞাটাও পাল্টাবে মুহুর্মুহু। আর সেই পথযাত্রার শুরুটাই হচ্ছে ফিন অ্যালেনদের দিয়ে। ইনিংস কিংবা ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানে হয়তো গড়পড়তা কিছু পেরিয়ে আসবে।

কিন্তু, ম্যাচজয়ের প্রভাবে সেই সব ইনিংসের গুরুত্ব হবে অনেক। পরিসংখ্যান তো শুধু সংখ্যার কথা বলে। পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বে তো ম্যাচের দৃশ্যপট। ভবিষ্যতের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সেসব দৃশ্যপট রঙিন হবে ফিন অ্যালেনদের মতো হার্ডহিটার ওপেনারদের কল্যাণে। কিউই ক্রিকেটে আকাশে তাই নেক্সট বিগ থিং হতে যাচ্ছে, এই ফিন অ্যালেন। হয়তো সেই ভবিষ্যতদ্বাণী নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ছাড়িয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেও হতে পারে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link