বর্তমান সময়ে চার ছক্কার মারমুখী ক্রিকেট আর ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক স্বল্প সময়ের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উত্তাপে অনেকখানি আড়ালে লাল বলের টেস্ট ক্রিকেট। ব্যস্ততার ভিড়ে রোমাঞ্চ প্রত্যাশী তরুণ সমাজের অনাগ্রহের কেন্দ্রে থাকা টেস্ট ক্রিকেটও যে টানটান উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে,তার স্বাক্ষর রেখে চলেছে অ্যাডিলেড থেকে লর্ডস, অথবা আবুধাবি থেকে ইডেন গার্ডেন।
ইতিহাসের পাতায় এমন ‘নেইলবাইটিং’ টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। অনিশ্চয়তার এই ক্রিকেটকে সংজ্ঞায়িত করা যায় স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের কথা দিয়ে, ‘If it’s difficult, I’ll do it now. If it’s impossible, I’ll do it presently.’
- পাকিস্তান বনাম নিউজিল্যান্ড, আবুধাবি, ২০১৮
টসে জিতে নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ১৫৩ রানে অলআউটের পর দ্বিতীয় দিনেই পাকিস্তানকে ২২৭ রানে অলআউট করে আবুধাবি টেস্ট জমজমাট হবার সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছিল দুদলই। তৃতীয় দিন শেষে হাসান আলী ও ইয়াসির শাহ্র যৌথ দাপটে ২৫৫ রানে ব্ল্যাক ক্যাপসরা অলআউট হলে ভাগ্যবিধাতার আশীর্বাদ পাক শিবিরের দিকেই ধাবমান ঠেকছিল।
চতুর্থ দিনের শুরুতে হাতে ১০ উইকেট থাকা পাকিস্তান দলের যখন জয়ের জন্যে ১৩৮ রান প্রয়োজন তখনো হয়তো কেউ বুঝেনি দিন শেষের সূর্য কার জন্যে হাসি বাঁচিয়ে রেখেছে । পানিবিরতি পর্যন্ত স্কোরবোর্ডে ৮১/৩ আর ক্রিজে অনফর্ম ব্যাটসম্যান আজহার ও শফিককে দেখে নির্ভারই ছিল সরফরাজ বাহিনী। কিন্তু বৃহস্পতিরও যেমন শনি থাকে পাকিস্তানেরও তেমন ভারতশনি থাকবেই।
অনেকে ভ্রু কুঁচকে ফেললেও চতুর্থ দিনের ছড়ি ঘোরানো ব্ল্যাক কেপ এজাজ প্যাটেল জন্মসূত্রে কিন্তু ভারতীয়ই! প্যাটেলের দুর্দান্ত স্পেলে স্কোরবোর্ড ১৩০/৪ থেকে ১৬৪/৯ এ নাটকীয় মোড় নেয়। জেতার জন্যে পাকিস্তানের তখনো দরকার ১১ রান, হাতে শেষ উইকেট আর ক্রিজে সেট ব্যাটসম্যান আজহার আলী। নার্ভ ব্রেকিং মোমেন্টেও ঠান্ডা মাথার ক্রিকেট খেলে জয় থেকে যখন ছুঁইছুঁই দূরে দাঁড়ানো ঠিক তখন সেই এজাজ প্যাটেলের শেষ শিকার আশা দেখানো আজহার! ঐতিহাসিক ৪ দিনের টেস্ট জয়ের মাত্র ৪ রান দূরে থেকে আরো একবার অনুতাপের অনলে পোড়ার স্বাদ পেল তৎকালীন টেস্ট র্যাংকিং এ সাতে থাকা পাকিস্তান দল।
- ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া, মেলবোর্ন ১৯৮২
অ্যাশেজ সিরিজ মানেই ছাইদানিতে তেঁতে ওঠা উত্তেজনা আর বিতর্কের ঝড়। ১৯৮২ সালের ২৬ ডিসেম্বরে শুরু হওয়া অ্যাশেজ টেস্ট যেন তাতে আরো একমুঠো ইতিহাস পুরে দেয়। পিচ আর আউটফিল্ডের ডাম্প কন্ডিশন দেখে সিরিজে ২-০ তে এগিয়ে থাকা অজি কাপ্তান গ্রেগ চ্যাপওয়েল ফিল্ডিং এর সিদ্ধান্ত নেন। চতুর্থ উইকেট জুটিতে এলান ল্যাম্ব ও ক্রিস টাভারের ১৬১ রানে ভর করে দিনশেষে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ ২৮৪ রান।
অজি ব্যাটিংয়ে মাত্র তিন রানের লিড নিয়ে অলআউট হলে হিসাবটা বরাবরই রাখে ইংলিশরা। পরপর দুদিন দুটো কমপ্লিট ইনিংসের ধারা অব্যাহতি রেখে তৃতীয় দিনেও ইংল্যান্ড দল অলআউট আগের ইনিংসের চেয়ে মাত্র ১০ রান বেশি করে। অস্ট্রেলিয়া দলের সামনে সংগ্রহযোগ্য ২৯২ রান টার্গেট রেখে উত্তেজনাময় চতুর্থ দিনের শুরু। পিচ-আউটফিল্ড আর অস্ট্রেলিয়া টিম সবই বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছিল।
স্কোরবোর্ডে ৭১ রানের মধ্যেই তিন উইকেটের পতন সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখছিল সমান তালে। কিন্তু হিউজ আর হুকসের ১০০ রানের পার্টনারশিপ পেন্ডুলামের কাঁটাকে ধরে রাখে অজি শিবিরের দিকেই। বেখেয়ালিতে পরপর দুই রানের ব্যবধানে দুজনই আউট হলেন এবং ১৯০ রানে আরো দুই উইকেটের পতনে ফেভারিট বিশেষণ ঘুরে যায় পুরোপুরি উলটো দিকে। পিচের একপ্রান্ত আটকে রাখা এলান বর্ডার একে একে প্যাভিলিয়ন ফিরতে দেখলেন ল্যাওসন ও হজকেও।
স্কোরবোর্ডে ২১৮/৯, জয়ের জন্যে আরো ৭৬ রান- এমন অবস্থায় বর্ডারকে সঙ্গ দিলেন আত্মবিশ্বাসী থমসন। দুপ্রান্ত সমান্তরালে ধরে রেখে ২৫৫/৯ এ দিন শেষ করেন বর্ডার-থমসন জুটি। শেষদিনের থমথমে পরিস্থিতির স্বাদ পেতে স্টেডিয়ামে জড়ো হয় ১৮০০০ দর্শক। প্রতিটি সফল সিংগেলেও উল্লাস দেখছিল মেলবোর্ন গ্রাউন্ড।সাবধানতার পরিচয় দিয়ে ২৯টি ‘সম্ভব-সিংগে’ ও নাকচ করে দেয় এই জুটি। কিন্তু জয় থেকে যখন মাত্র চার রান দূরে, বল হাতে এগিয়ে আসেন ইংলিশ পেসার ইয়ান বোথাম।
দুর্দান্ত লো বাউন্সিং বলে এজ কাট করে সেকেন্ড স্লিপে ক্যাচ দিয়ে অসাধারণ এক ইতিহাস গুড়িয়ে দেন জে আর থমসন।জন্ম হয় নতুন এক ইতিহাসের, মাত্র তিন রানের জয় দিয়ে পাঁচ দিনের অ্যাশেজ টেস্ট ইতি টানে ইংলিশরা।
- অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড, ম্যানচেস্টার ১৯০২
আরো একটি অ্যাশেজ আরো একটি তিন রানের গল্প। বিংশ শতকের শুরুর দিকের এই অ্যাশেজে সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে ছিল অজিরাই। তৎকালীন সিডনি বার্ন্স, উইলফ্রেড রোডসদের মত তারকানির্ভর ইংলিশদের জন্যে ম্যাচটা ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর। টসে জিতে অস্ট্রেলিয়ান কাপ্তান জো ডার্লিং চিরায়ত ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রথম ইনিংসে স্কোরবোর্ডে তুলে আনেন দলীয় ২৯৯ রান।
ভিক্টর ট্রাম্পার লাঞ্চ এর আগেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ‘প্রথম’ হিসেবে নাম তুলে নেন রেকর্ডবুকে। ইংলিশদের খাতায় দলীয় ২৬২ অলআউট, ব্যাক্তিগত সর্বোচ্চ স্ট্যানলি জ্যাকসনের ১২৮ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে রোডস ও লকউডের বোলিং দাপটে মাত্র ৮৬ রানে গুটিয়ে পড়ে অস্ট্রেলীয় ব্যাটিং লাইনআপ। ১২৪ রানের সহজ টার্গেট ইংল্যান্ড দলের সামনে । ৩ উইকেটে ৭২ রান নিয়ে ভালোই যাচ্ছিল সবকিছু, গোল বাধালো হুগ ট্রাম্বেলের দুর্দান্ত স্পেল। স্কোরবোর্ড ৯১/৩ থেকে ১১৬/৯ এ গিয়ে ঠেকলো।
জয়ের জন্যে ইংলিশদের প্রয়োজন ৮ রান। ব্যাটসম্যান ফ্রেড টেট এজ কাটে বাউন্ডারী হাঁকালে হাতছানি দিচ্ছিল মাত্র ৪টা রান। কিন্তু সোন্ডার্সের পরের বলেই ক্লিন বোল্ড – ফলাফল তিন রানের আক্ষেপে অ্যাশেজ সিরিজ হার ইংলিশদের।
- ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া, বার্মিংহাম ২০০৫
টেস্ট ক্রিকেট মানেই যে অ্যাশেজ ঝড়, তার প্রমাণ টানা তিনটি নাটকীয় ইতিহাস। একুশ শতকের এই টেস্ট এখনো অনেকের মনে দাগ কেটে আছে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ আর ব্রেট লির ঐতিহাসিক ছবিকে কেন্দ্র করে। প্রথম ইনিংসে ওভারপ্রতি গড়ে ৫ এর উপর নিয়ে ৪০৭ রানের উড়ন্ত সূচনা করে দেয় ইংল্যান্ড দল। ল্যাংগার এর ৮২ রানে ভর করে ৩০৮ রান তুলে প্রথম ইনিংস শেষ করে পন্টিং এর দল। দ্বিতীয় ইনিংসে শেন ওয়ার্ন আর ব্রেট লির আগুনঝড়া বোলিং এ ১৮২ তেই স্কোরবোর্ডে কালি শেষ ইংলিশদের।
আসল অ্যাশেজ উত্তাপ তখনো বাকি অস্ট্রেলিয়ার সেকেন্ড ইনিংসে। ২৮২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে নিয়মিত উইকেট পতন উপহার দেয় অজিরা। ফ্লিনটফ-গিলস এর স্পেলে কোন জুটিই যেন ঠিকমত টিকছিল না। দলীয় ১৩৬ রানে গিলক্রিস্ট গিলসের বলে ক্যাচ তুলে দিলে ও ১৭৫ রানে ৮ উইকেটের পতনে হাসিমুখ উঁকি দিচ্ছিল ইংলিশ শিবিরে। কিন্তু আগের ইনিংসের ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের জন্যে যম হয়ে উঠা ওয়ার্ন আর লি’র এবারের পরিকল্পনা ছিল বোলারদেরও কুপোকাত করার।
ধীরস্থির ক্রিকেট উপহার দিয়ে ওয়ার্ন আউট হওয়ার আগে দলের তখনো দরকার আরো ৬২ রান। ২২০ রানে ফ্লিনটফের মারমুখী বলে ওয়ার্নের হিট আউট ইংলিশদের জয়ের প্রহর গোণাচ্ছিল কেবল। কিন্তু তেঁতে উঠলেন ব্রেট লি; মাইকেল ক্যাস্প্রোউইকজের মত অনভিজ্ঞ-দূর্বল ব্যাটসম্যানকে নিয়েই ঠাণ্ডা মাথার ব্যাটিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যাটিং প্রান্ত আটকে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা বৃথা হয় ৬৪ ওভারের শুরুতে।
হার্মিসনের ফুলটস বলে দারুন ব্যাট চালিয়েও সিংগেল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ব্রেট লিকে। পরের বলে নো রান। জয়ের জন্যে দরকার কেবল তিনটি রান। নার্ভ ব্রেকিং মোমেন্টে হার মেনে ওভারের তৃতীয় বলে উইকেট কিপারের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে ক্যাস্প্রোউইকজ ইতি টানেন এক অসম্ভব সম্ভাবনার । দু রানের হার নিয়ে অপর প্রান্তে অপরাজিত ৪৩ রানে স্তব্ধ ব্রেট লির স্মৃতি এখনো পুড়িয়ে বেড়ায় অজি ফ্যানদের ।
- ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম অস্ট্রেলিয়া, আডিলেড ১৯৯৩
টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে ‘ক্লোজেস্ট’ ম্যাচ ধরা হয় একে । একইসাথে আপসেট ও স্মরণীয় এই টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেন উইন্ডিজ অধিনায়ক স্যার রিচি রিচার্ডসন। ২৫২ রানে অলআউট হয়ে প্রথম দিন ও প্রথম ইনিংস শেষ করে উইন্ডিজরা। বোলিং এ স্যার অ্যাম্ব্রোস একাই ৬ উইকেট নিয়ে অজিদের আটকে দেন ২১৩ রানেই। ম্যাচের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণে ঘুরে দাঁড়ায় অস্ট্রেলীয় বোলিং লাইনআপ।
ডাম্প উইকেটকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে উইন্ডিজদের সাজঘরে ফেরায় ১৪৬ রানে। নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে জয়ের জন্যে অস্ট্রেলিয়ার দরকার মাত্র ১৮৬ রান । রানের চাকা ঘোরার শুরু থেকেই নিয়মিত উইকেট পতন। দলীয় ১০২ রান তুলতেই আট-আটটি উইকেট খোয়াতে হয় অজিদের। ব্যাটিং এর শেষ ভরসা এক প্রান্ত আটকে রাখা ল্যাংগার ব্যাক্তিগত ৫৪ ও দলীয় ১৪৪ রানে আউট হলে আশার শেষ প্রদীপটাও প্রায় নিভে যায় এলান বর্ডারের অস্ট্রেলিয়া দলের। কিন্তু শেষ উইকেট জুটিতে স্পিনার টিম মে-র লড়াকু মনোভাবে অসম্ভবকেও সম্ভব দেখাচ্ছিল । শেষেদিকে স্কোরবোর্ডের দিকেও তাকাচ্ছিলেন না মে।
তার ভাষায়, ‘আমরা স্কোরবোর্ডের দিকে তাকাচ্ছিলাম না। আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পরের ডেলিভারি। আমরা একটু একটু করে লক্ষ্যের কাছে পৌঁছাচ্ছিলাম, দর্শকের গর্জন বাড়ছিল।’
জয় থেকে যখন দুই রান দূরে, স্ট্রাইকে শেষ ব্যাটসম্যান ম্যাকডারমট। উইন্ডিজ পেসার ওয়ালশের বাউন্সারে দিশেহারা হয়ে ব্যাট চালাতেই সোজা কট বিহাইন্ড। যদিও সমালোচকদের মাঝে এখনো মতভেদ আছে উইকেটটির যথার্থতা নিয়ে। সব বিতর্ককে ছাপিয়ে ১ রানের এই অবিস্মরণীয় জয় উইন্ডিজদের তথা পুরো বিশ্বের ক্রিকেটানুরাগীদের মনে দাগ কেটে রেখেছে। কে জানতো পাঁচদিনের টেস্ট ম্যাচের পরিণতি কখনো ১ রানের ব্যবধান টেনে দিতে পারে!