দামী মদ, সুস্বাদু খাবার। পুরনো দিল্লীর অভিজাত একটা বাড়ির ছোট্ট একটা হাউজ পার্টি। বসার ঘরে পাঁচজন মানুষ জড়ো হয়েছেন উদযাপন করতে। দিনটি ছিল চার আগস্ট, ২০২০। উদযাপনের যথার্থ কারণ তাঁদের কাছে। সেদিনই গভর্নিং কাউন্সিল জানিয়ে দেয়, ১৯ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ১৩ তম আসর।
পুরনো দিল্লীর নব্বই বছর পুরনো ওই বাড়িটাই নাকি দিল্লী ভিত্তিক ক্রিকেট জুয়ার মূল কেন্দ্র। আর আইপিএল তাঁদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই সোনার ডিম পাড়া হাস। দিল্লী পুলিশের তথ্য বলছে, একটি বেটিং ওয়েবসাইট থেকে যেকোনো আইপিএল ম্যাচে ৩৭ কোটি রুপির জুয়ার ব্যবসা হয়। পুরো আইপিএলে, পুরো ভারতজুড়ে এই সংখ্যাটা কত, গুনে দেখুন তো!
এবার ফিরি বর্তমানে।
২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। টুইটারে একটা বোমা ফাঁটিয়েছেন হরভজন সিং। লিখেছেন, ‘আজ কাল ক্রিকেটে অনেক খবর। আর মাত্রই আমি এমন কিছু জানতে পেরেছি, যা চিরদিনের জন্য ক্রিকেট বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে দেবে।’
কি এমন জানতে পেরেছেন হরভজন সিং? আর এজন্যই কি ‘ব্যক্তিগত কারণ’-এর দোহাই দিয়ে আইপিএল না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? তার আগে সুরেশ রায়নার ক্ষেত্রেও কি বিষয়টা এমন ছিল?
দলটার নাম চেন্নাই সুপার কিংস বলেই সন্দেহটা তীব্র হচ্ছে। এই দলটাই তো ২০১৩ সালে স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে ২০১৫ সালের পর থেকে দুই বছরের জন্য নির্বাসিত ছিল। দলের সহ-কর্ণধার গুরুনাথ মুয়াপ্পান সরাসরিই জড়িত ছিলেন সেই ঘটনায়।
মুয়াপ্পান আবার হলেন এন শ্রীনিবাসনে জামাতা। শ্রীনিবাসনকে কে না চেনে! বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) সাবেক সভাপতি, সাবেক আইসিসি চেয়ারম্যান, ইন্ডিয়া সিমেন্ট ও চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক ও ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গনের ‘যত না বিখ্যাত, তার চেয়ে বেশি কুখ্যাত’ এক মাস্টারমাইন্ড।
ওই ফিক্সিং কেলেঙ্কারির পরই তো শ্রীনিবাসনের গদিটা যায়। শ্রীনি খানিকটা সময় বিতাড়িত ছিলেন, পরে আবারও বহাল তবিয়তে ফিরেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে। সুরেশ রায়না আইপিএল না খেলার ঘোষণা দেওয়ার পর শ্রীনি বলেছিলেন, ‘আজকালকার ক্রিকেটারদের সমস্যা হল, তারা নিজেদেরই প্রধান চরিত্র ভাবে। আগেকার দিনের রাগীমত অভিনেতাদের মতো। কখনও কখনও সাফল্য তাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। খনও মৌসুম শুরু হয়নি। রায়না নিশ্চয়ই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। এতগুলো অর্থ ও হাতছাড়া করতে চাইবে না।’
এখানে ‘অর্থ’টা কি? শুধুই পারিশ্রমিক, না অন্য কিছু!
রায়না অবশ্য পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করে জবাব দেন, ‘একদম ব্যক্তিগত কারণে আমি পরিবারের কাছে আসতে চেয়েছি। আমার দলের কাছে যা স্পষ্ট করা দরকার ছিল। সিএসকেও আমার পরিবার, মাহি ভাই (এমএস ধোনি) আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া তাই কঠিন ছিল। শক্ত কারণ ছাড়া কেউই সাড়ে ১২ কোটি রুপি ছাড়তে চাইবে না। আমি হয়ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছি কিন্তু আমি এখনো তরুণ। আরও ৪-৫ বছর আইপিএল খেলতে মুখিয়ে আছে। আর উনি (শ্রীনিবাসন) আমার বাবার মতো। আর আমার খুব কাছের মানুষ। আমাদের সম্পর্কটা এমনই। তিনি যা বলেছেন তা স্বাভাবিক। বাবা তার ছেলেকে বকাঝকা করতেই পারেন। তিনি আসল কারণ জানতেন না। এখন তাকে জানিয়েছি, তিনি ফিরতি মেজেসও পাঠিয়েছেন।’
এমন বক্তব্যের পর বিতর্কের আগুনটা নিভেই গিয়েছিল। এমন সময় হরভজন টুইট করে জল ঘোলা করলেন। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছেই, তাহলে কী এবার আইপিএলে ফিক্সিং আর বিতর্কের মহোৎসব হবে? করোনা ভাইরাসের প্রকোপে আইপিএল এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দর্শক থাকছে না, মিডিয়ার আগের মত সহজেই সব হাতে পাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে, নীতি-নৈতিকতা টিকে থাকবে বলে হলফ করে বলা যাচ্ছে না।
নীরাজ কুমার, দিল্লী পুলিশের সাবেক কমিশনার। বিসিসিআইয়ের দুর্নীতি দমন কমিশনের হয়ে তিনি বেশ কিছু হাই প্রোফাইল ম্যাচ ফিক্সিং কেসের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি মনে করেন, আরব আমিরাত হল ফিক্সিংয়ের স্বর্গরাজ্য। সেখানে তাই, স্বাভাবিক ভাবেই ফিক্সিংয়ের প্রকোপ বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
নিউজক্লিক নামের একটি ভারতীয় গণমাধ্যমকে এই ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ওখানে ফিক্সিংয়ের ঝুঁকি বেশি, কারণ ওখানে অনেক রকম স্টেক হোল্ডারদের ছড়াছড়ি। টপ ফিক্সাররা ওখানেই থাকে। তবে, নজরদারী বাড়িয়ে চাইলে বিষয়গুলো এড়ানো যায়।’
সিবিআইয়ের সাবেক এই কর্মকর্তা মনে করেন, আইপিএলের ফরম্যাটটা জুয়ারিদের জন্য খুবই মোক্ষম। তিনি বলেন, ‘আইপিএলে জুয়ার কালো প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। এটা হচ্ছে কারণ, এর ফরম্যাটটাই এমন যাতে জুয়া ব্যাপারটা খুব ভাল ভাবে যায়। বিসিসিআইয়ের দূর্নীতি দমন কমিশনকে এবার আরো সতর্ক থাকতে হবে।’
একটা আশার ব্যাপার যে, খেলাগুলো হবে জৈব সুরক্ষা বলয়ে, সেখানে বাইরের কারোরই আসার সুযোগ নেই। নীরাজের আশঙ্কা অবশ্য তাতে কমছে না। তিনি বলেন, ‘এই বছর খেলোয়াড়রা জৈব সুরক্ষা বলয়ে আইসোলেটেড থাকবেন। ঠিক আছে, কিন্তু এখনকার যোগাযোগ-প্রযুক্তি এতটাই এগিয়ে গেছে যে, বাইরে থেকেও অনেক কিছু সম্ভব। ফিক্সারদের স্বশরীরে হাজির না হলেও চলে। আর ফিক্সারদের সাথে খেলোয়াড়দের যোগাযোগ টুর্নামেন্ট শুরুর অনেক আগেই হয়ে যায়।’
তার অর্থ কী? ফিক্সাররা কলকাঠি নাড়া শুরু করেছেন?