উইকেটের দু’পাশের ধূর্ত চমক

নি:সন্দেহে ভারতের প্রথম ড্যাশিং তারকা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। অনেকেই বলে থাকেন সুনিল গাভাস্কারই প্রথম ভারতীয় যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস দানবদের ফেস করেছিলেন। তবে ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের দানবীয় পেস বোলিং অ্যাটাকের সামনে লড়াই করেছিলেন। ওই সময় কোনো ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার প্লেয়ার ভুলেও ফারুখকে স্লেজিং করার সাহস করতো না। কারণ এর ক্ষোভটা যে ব্যাট হাতে তাঁদের উপরই তিনি মেটাবেন সেটা অবশ্য ভালো করেই জানতো ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা।

শূন্য রানে ব্যাটিং করছেন নাকি ৯৪ রানে সেটা নিয়ে তিনি মোটেও ভাবতেন না, আগ্রাসী ব্যাটিংয়েই পেতেন তৃপ্তি। বাউন্ডারি হাঁকানোই ছিলো লক্ষ্য! ক্রিজে আসলেই বোলারদের উপর চড়াও হয়ে ব্যাটিং করাটা ছিলো নেশা। অনেকের মতেই ২০০০ পরবর্তী সময়ে খেললে ভারত পেতে পারতো আরেকটি অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। হতে পারতেন আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্র‍্যান্ড, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এক আইকন। এমন প্রতিভা আর তারকা খ্যাতি নিয়েই ষাটের দশকে ২২ গজ মাতিয়েছেন ভারতের সাবেক উইকেটরক্ষক ব্যাটার ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার।

এখনকার সময়ে অনেক উইকেটকিপারই বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ পরিচিত। কিন্তু ষাটের দশকে এমন উইকেটকিপারদের সেভাবে মুল্যায়ন করাই হতো না। আর বিধ্বংসী ব্যাটিং তো কালেভদ্রে দেখা যেতো। তবে ভারতের হয়ে এর শুরুটা করেছিলেন ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার। ভারতের কাছে তখন এমন দুইজন উইকেটকিপার ছিলেন যারা শুধু কিপিংই নয় ব্যাট হাতে ঝড়ও তুলতে পারতেন। একজন বুধি কুন্দরন ও আরেকজন ছিলেন ফারুক ইঞ্জিনিয়ার।

হুক কিংবা স্টেপ আউট করে কভারের উপর দিয়ে নান্দনিক বাউন্ডারি – আধুনিক ক্রিকেটের অনেক শটই সেই সময়ে দিব্যি খেলতেন ফারুখ। শুধু ব্যাটিংই নয়, উইকেটকিপিংয়েও ছিলেন সেরাদের একজন। উইকেটের দুই পাশেই ঝাপিয়ে পড়ে ক্যাচ লুফে নিতেন সহজেই! এমনকি প্রায়শই প্রথম কিংবা দ্বিতীয় স্লিপের ক্যাচও গ্লাভসবন্দি করতেন ষাটের দশকের এই তারকা।

বোম্বের পার্সি কলোনিতেই ছেলেবেলা কেটেছে ফারুখের। আরেক পার্সি ক্রিকেটার ভারতের তখনকার অধিনায়ক পলি উমরিগর ছিলেন ফারুখের আইকন। ছোটবেলায় পার্সি কলোনিতেই গলিতে ক্রিকেট খেলতেন তিনি। পাড়া-প্রতিবেশির জানালার কাঁচ ভাঙা ছিলো নিত্যদিনের রুটিন। পাড়ার দুষ্ট বালক হিসেবেই ছিলো পরিচিতি! দুষ্টামির কারণে ফারুখকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বোর্ডিং স্কুলে! পুনে বোর্ডিং স্কুল থেকেই ধীরে ধীরে ক্রিকেটে উঠে আসা ফারুখের।

ফারুখের বাবা ছিলেন ডাক্তার, নিজে হতে চেয়েছিলেন পাইলট। কিন্তু নাম হলো ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ার ফারুখদের পার্সি পরিবারের পদবী। ভারতের কিংবদন্তী এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের প্রথম ভালোবাসা ছিলো টেনিস। তবে স্কুল জীবন থেকে তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিলো পাইলট হওয়া। সে জন্য বম্বে ফ্লাইং ক্লাব থেকে পাশও করেছিলেন। এমনকি ছোটখাটো প্লেন চালিয়েছেনও কিছুদিন। কিন্তু মায়ের আপত্তিতে এই শখ বিসর্জন দিতে হয়েছে। এরপর মনোনিবেশ করেন ক্রিকেটে।

রমনিরঞ্জন আনন্দলাল পোদ্দার কলেজে ভর্তি হয়ে বনে যান অধিনায়ক। তখন ওই কলেজ থেকে বড় কোনো ক্রিকেটার বের হয়নি। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারের পর ওই কলেজ থেকেই পরবর্তীতে দিলিপ ভেৎসরকার, রবি শাস্ত্রী, সাঞ্জে মাঞ্জারেকারদের মতো ক্রিকেটাররা বের হলে বেশ পরিচিতি পায় কলেজটি। দাদর পার্সি কলোনি দলের হয়ে উইকেটকিপার হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরু। সেখান থেকে পরবর্তীতে মাইশোরের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলেন তিনি।

যদিও রঞ্জি ট্রফিতে যেতে বহু কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে ফারুখকে। ১৯৫৮ সালে বোম্বে ইউনিভার্সিটি দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান ফারুক। কিন্তু ফেব্রুয়ারি, ১৯৬০ পর্যন্ত তখনো রঞ্জি ট্রফিতে অভিষিক্ত হতে পারেননি তিনি। সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক লালা অমরনাথই তাঁকে ইন্ডিয়ান স্টারলেস দলের সাথে পাকিস্তান সফরে পাঠান।

ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম করলেও জাতীয় দলে আসার পথে ফারুকের সামনে বাঁধা হয়েছিলো নরেন তামহানে এবং বুধি কুন্দরন। ফারুখ জানতেন নিজেকে জাতীয় দলে ভেড়াতে হলে অবশ্যই বিশেষ কিছু করতে হবে। যেহেতু ওই সময় উইকেটকিপারদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হতো না; নিজেই নিজেই উইকেটকিপিং অনুশীলন করে স্কিল বাড়ানোর চেষ্টায় মত্ত হলেন। দুর্দান্ত সব ক্যাচে নজর কাঁড়ছিলেন অনেকেরই!

প্রথম উইকেটকিপার হিসেবে পুরো ক্রিকেট বিশ্বে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেন ফারুখ। ফিল্ম স্টারদের মতোই খ্যাতি ছিলো ফারুকের। অবশ্য চলাফেরা, লাইফস্টাইল সবই ছিলো একদম চকচকে! পার্সি ক্রিকেটার হওয়ায় বেশ খোলামেলা আর খুশি মনেরই একজন ছিলেন ফারুখ।

১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে বুধি কুন্দরনের জায়গায় ভারত জাতীয় দলে জায়গা পান ফারুখ। এরপর বছর কয়েক দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে দু’জনের মধ্যে পারফরম্যান্সের বেশ জম্পেশ একটা লড়াই চলছিলো। অবশ্য বুধি শুরু থেকে উইকেটকিপার ছিলেন না, বরং লালা অমরনাথই তাঁ কে কিপার হিসেবে তৈরি করে।

এরপর একবার ফারুখের আঙুলের ইনজুরিতে বুধি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দলে সুযোগ পেলো। আর সুযোগ পেয়েই খেলেছিলেন ১৯২ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। ফারুখ তখন মজার ছলেই বলছিলেন বলছিলেন, ‘এটা কি হলো! এখন আমি দলে ঢুকবো কিভাবে।’ অবশ্য একই দলে দু’জনে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও বেশ ভালো বন্ধুও ছিলেন একে অপরের।

১৯৬৬-৬৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল তখন ভারত সফরে। বুধিকে হটিয়ে আরো একবার দলে জায়গা করে নেন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু সমস্যা হলো বুধি যেহেতু ওপেনিং করতো তাই ফারুখকেও ওপেনার হিসেবে খেলতে হবে! ফারুখের ব্যাটিং পজিশন ছিলো লোয়ার অর্ডারে। সেখান থেকে প্রথমবার তখন ব্যাট হাতে ওপেনিংয়ে আসেন ফারুক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ংকর পেস ইউনিটের সামনে ওপেনিংয়ে তখন ফারুখ! ওয়েস হলস, ল্যান্স গিবস, চার্লি গ্রিফিথদের প্রায় ১০০ মাইলের বলের সামনে করেছিলেন দুর্দান্ত ব্যাটিং!

প্রথম ওভারেই মারলেন দুই ছক্কা! ১৮ বাউন্ডারিতে ১০৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন ফারুখ। ওপেনিংয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম ইনিংস খেলতে নেমেই জুড়ে দেন সেঞ্চুরি। ফারুখের ওই ইনিংসের পর কুন্দরন আর মাত্র দু’টি টেস্ট খেলেছিলেন ওপেনার হিসেবে!

ওই সিরিজের পর ক্যারিবিয়ান পেসার হলসের মা হলসের কাছে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই ফারুক ইঞ্জিনিয়ার কে? ওকে আমার কাছে আনতে পারবে কি?’ এরপর ফারুকের সাথে এক সাক্ষাতে হলসের মা বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেকে খুব বেশি ক্রিকেটার ছয় মারতে পারেনি। তুমি ছক্কা মারায় তাই বেশ অবাক হয়েছি।’

এরপর ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড সফরে যান ফারুখ। সেখানে বেশ ভালো পারফরম্যান্সের পর কাউন্টি দল ল্যাঙ্কাশায়ারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। সেখানেই এক ল্যাঙ্কাস্টিয়ার মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। ক্যারিয়ারের শেষেও ল্যাঙ্কাশায়ারেই স্থায়ী হন তিনি!

ভারতের প্রথম বিদেশের মাটিতে সিরিজ জয়েও বড় ভূমিকা পালন করেন এই তারকা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৬৭-৬৮ সালে সিরিজ জয়ে ৪০ গড়ে করেন ৩২১ রান। ওই সিরিজে গ্লাভস হাতে দুর্দান্ত উইকেটকিপিংও করেন তিনি।

এরপর ১৯৭০ সালে প্রথমবার বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলেন তিনি এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে আবারো অজিদের বিপক্ষে বিশ্ব একাদশে হয়ে খেলার সুযোগ হয় ফারুখের। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ফারুখ খেলেছিলেন বিশ্ব একাদশের হয়ে। মাঝে ১৯৭১ সালে যখন ভার‍ত দল যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেলো তখন এক আজব কারণে বাদ পড়েন ফারুখ! মূলত ওই সময়ে কোনো ঘরোয়া ক্রিকেট ম্যাচ না খেলার কারণে বাদ পড়েন এই উইকেটকিপার!

এরপর অবশ্য দ্রুতই দলে ফিরেন তিনি। ভারত তখন ইংল্যান্ড সফরে।

ওভাল টেস্টে ইংল্যান্ডের ৩৫৫ রানের জবাবে ১২৫ রানেই ৫ উইকেট নেই ভারতের। ফারুখের অসাধারণ ৫৯ রানের ইনিংসে ভর করে শেষ পর্যন্ত ২৮৪ রানে পৌঁছায় ভারত। পরের ইনিংসে তখন ইংলিশরা গুড়িয়ে যায় মাত্র ১০১ রানে! ১৭২ রানের সহজ লক্ষ্যমাত্রা ভারতের সামনে।

ব্যাট করতে নেমে ৩৭ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে বিপাকে তখন সফরকারীরা। এরপর ১৩৪ রানে হারায় ৫ উইকেট। তখনো প্রয়োজন ৩৮ রানের, হাতে ৫ উইকেট। এরপর ব্যাট করতে নেমেই শুরু থেকেই বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন ফারুখ। তাঁর অপরাজিত ২৮ রানে প্রথমবার ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজ জয় করে ভার‍ত! ফারুখের দুর্দান্ত ফিল্ডিং ওই সিরিজে নতুন করে নজর কেঁড়েছিলো ক্রিকেট দুনিয়ার।

পরবর্তীতে ঘরের মাটিতেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পায় ভারত। সেখানে পুরো সিরিজে ৪২১ রান করেন ফারুখ। এরপর ১৯৭৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে হুট করে অবসরের ঘোষণা দেন ভারতের এই তারকা। সৈয়দ কিরমানির কাছে গ্লাভস দিয়ে বিদায় জানান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। এরপর পাড়ি জমান ল্যাঙ্কাশায়ারে।

নি:সন্দেহে ভারতের প্রথম ড্যাশিং তারকা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। অনেকেই বলে থাকেন সুনিল গাভাস্কারই প্রথম ভারতীয় যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস দানবদের ফেস করেছিলেন। তবে ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের দানবীয় পেস বোলিং অ্যাটাকের সামনে লড়াই করেছিলেন। ওই সময় কোনো ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার প্লেয়ার ভুলেও ফারুখকে স্লেজিং করার সাহস করতো না। কারণ এর ক্ষোভটা যে ব্যাট হাতে তাঁদের উপরই তিনি মেটাবেন সেটা অবশ্য ভালো করেই জানতো ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা।

ভারতের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপেই ওপেন করেন ফারুখ। এবং বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে প্রথম ফিফটিও করেন তিনি। ভারতের হয়ে ৪৬ টেস্টে ৩১ গড়ে ফারুখ করেছেন ২৬১১ রান। এই ফরম্যাটে ২ সেঞ্চুরি আর ১৬ ফিফটিও যোগ করেছেন নিজের নামের পাশে। এছাড়া ৫ ওয়ানডেতে ৩৮ গড়ে ১ ফিফটিতে করেছেন ১১৪ রান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...