উড়ন্ত মৎসমানব

বড় দুই বোন ছিলেন স্থানীয় সুইমিং টিমের সদস্য। তাঁদের সাথে পুলে এসেছে সাত বছরের ছোট ভাই সাঁতার শিখবে বলে। জলকে ভয় পাওয়ায় সেখানকার প্রশিক্ষক উল্টো হয়ে সাঁতার কাটবার তালিম দিতে লাগলেন, উল্টোই সয়। সেই প্রথম প্রশিক্ষক বব বাউম্যান তাঁর জীবন পাল্টানোর বড়ো পথ দেখিয়েছিলেন।

নয় বছর বয়সে মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ। মা আর দুই দিদিকে নিয়ে আলাদা শুরু, আর তিন জনই সাঁতার ভালোবাসে, ছোট ছেলেটিও অনুপ্রেরণা প্রায় তাদের থেকেই। সাথে আছেন কোচ বাউম্যান, যিনি বড়ো হওয়ার সাথে সাথে ছেলেটির প্রতিভা ও দক্ষতা দেখে তাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একজন দক্ষ সাঁতারু করবার উদ্দেশ্যে শুরু করলেন জোরদার প্রশিক্ষণ।

২০০০ সাল মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক সাঁতার টিমে জায়গা করে নিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সেই ছেলেটি। এত কম বয়সে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা ছিল অলিম্পিকের ৬৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে সেবার পুরস্কার অবশ্য জেতেননি।

২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টের ফাইনাল রাউন্ড পর্যন্ত গিয়ে পঞ্চম হয়ে ফিরেছিলেন। আক্ষেপ থাকলেও হতাশা ছিল না, সবে তো শুরু। কিন্তু সেই শুরুর শেষটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটি কি নিজের কল্পনাতে এঁকে রেখেছিলেন মাইকেল ফেল্পস, বর্তমানে কিংবদন্তি, সেদিনের সেই ছেলেটি?

ফেলপস যখন সিক্সথ গ্রেডে, তখন সর্বপ্রথম তার এডিএইচডি ধরা পড়ে। নামটা বেশ খটমটে, অ্যাটেনশন ডেফিসিট অ্যান্ড হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার। সাধারণত এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা লক্ষ্য স্থির রাখতে পারেন না, কোনো নির্দিষ্ট কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে সেটা ফেল্পসের জন্য ছিল আরো ভয়াবহ।

তিনি ছিলেন এই সিন্ড্রোমের সর্বোচ্চ শিখরে। অনেকেই বলেছিলেন এই ছেলে জীবনে একটি লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না, কিন্তু সব কিছু হার মেনেছে পুলের ওই নীলাভ জলের কাছে। ওই জল তাঁকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে আর তিনি ওই জলকে নিজের বশ্যতায় এনেছেন নিজের দক্ষতা, নৈপুণ্য ও অসীম আত্মশক্তিকে বলবান হয়ে।

সাঁতারে কি সব রেকর্ড করেছেন তা দেখলে চমকে যেতে হয় এবং তা সম্বন্ধে তা প্রায় সবাই অবগত আছেন।

বাটারফ্লাই, ব্যাকস্ট্রোক, মেডলি, ফ্রীস্টাইল সমস্ত রকমেই রেকর্ডের সব পাহাড় গড়ে বসে আছেন, লিখে বা বলে শেষ করা যাবেনা। অলিম্পিকে ২৩ টি সোনা আর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ২৬ সোনায় বলে দেয় তাঁর প্রভুত্ব। যখনই সাঁতারের পুলে নেমেছেন রেকর্ড গড়েছেন, পদক জিতেছেন, আর এসব ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছেন পূর্বসূরি নিজের দেশের আরেকজন অতিমানব মার্ক স্পিৎজকে।

যিনি বলতে পারেন, ‘সাঁতারকে আমি সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলতে চাই যাতে সবাই এটা নিয়েই কথা বলে, এটাকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চায়।’ এবং সেটাকে প্রমাণ তাহলে বলবার আর কিছুই থাকেনা।

মাইকেল ফেল্পস আগামীর কাছে একজন আদর্শ। আমরা ভাগ‍্যবান তাঁর ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়টাতেই তাঁকে ওই নীলাভ জল কেটে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে দেখেছি বারবার। তাঁর মত এর আগে কেউ আসেননি, ভবিষ্যতেও আর আসবেন কি না সন্দেহ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link