ডি-বক্সের খানিক বাইরে থেকে ফ্রি-কিক। স্বাভাবিকভাবে দলের সেরা তারকাই বল বসিয়ে নিজের স্নায়ুচাপ কমাতে বেশ ক’বার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফেললেন। একটি গোল লিখবে নতুন ইতিহাস। একটি গোল আবার স্বপ্নযাত্রার শুরুটা করে দেবে। এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে গ্যারেথ বেল, নিলেন বা-পায়ের শট। তবে তা ইউক্রেনের আন্ড্রি ইয়ানমোলেঙ্কোর মাথায় লেগে জালে জড়ায়।
গোলটা লেখা হয় তাঁর নামে, পাশে জুড়ে দেওয়া হয় আত্মঘাতী গোল। তাতে কি আসে যায়? কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা তো মিলল। হোক সেটা প্রতিপক্ষের মাথা ছুঁয়ে। তারপর বেল ছুটলেন নিজের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তটা উপভোগ করতে। ছুটলেন তিনি। চিৎকার যেন ছাপিয়ে যাবে কার্ডিফের সকল দর্শকদের সম্মিলিত ধ্বনি। এমন আনন্দের মুহূর্ত তো আর প্রতিদিন আসে না।
ওয়েলসের ক্ষেত্রে এটি এলো গুণে গুণে ঠিক পাঁচ যুগ দুই বছর বাদে। দীর্ঘ ৬৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দিলেন গ্যারেথ বেল। এরপর তাঁর আনন্দ উল্লাসে্র পারদ নিশ্চয়ই ছুঁয়েছে নীলাম্বর। ছোঁঁয়াটাই তো স্বাভাবিক। অথচ এই তো ক’দিন আগেও তিনি বিরল এক রেকর্ডের সাক্ষী হলেন। ঠিক বিরল নয়। তবে খানিকটা তো বটেই। ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিতে পাঁচ খানা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ যুক্ত করাটা তো কোন সাধারণ বিষয় নয়।
সে কাজটা করেও তিনি ছিলেন একেবারে মলিন, সাদামাটা। যতটুকু হাসির প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই যেন তাঁর ওষ্ঠ সামনে এনেছে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এটাই ছিল তাঁর শেষ মৌসুম। তিনিও সেটা জানতেন। তাঁর সতীর্থরাও জানতেন। তাঁর সাথে ইস্কো, মার্সেলোরাও ছাড়ছেন দল। তাদেরকে ঠিক যেমন করে বিদায় জানিয়েছে ক্লাবের সমর্থক থেকে শুরু করে সতীর্থরা। সেটার ছিটেফোঁটাও কপালে জোটেনি বেলের।
অথচ, কত শিরোপা জয়ের নায়ক তো তিনিও। ২০১৮ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল নিশ্চয়ই স্মৃতিতে আবছা হয়ে যাওয়ার কথা না। কি চোখ ধাঁধানো বাইসাইকেল শট! বিদ্যুৎ গতির দূরপাল্লার শট! এসব কিছু হয়ত রিয়েল সমর্থকরা ভুলে গিয়ে থাকবেন। ভুলে গিয়েছিলেন হয়ত বেল, যে ১০৬ বার গোলের আনন্দে ভাসিয়েছেন লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। এমন অবজ্ঞার শুরু অবশ্য একটি মাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা পোস্ট থেকে।
বেল পোস্ট করেছিলেন, ‘ওয়েলস, গলফ ও রিয়াল মাদ্রিদ’। স্প্যানিশ গণমাধ্যম এই বিষয়টা উপস্থাপন করে তাঁর অগ্রাধিকার সিঁঁড়ি হিসেবে। যেখানে সবার নিচে অবস্থান রিয়াল মাদ্রিদের। তাতেই চটে যায় মাদ্রিদ সমর্থকেরা। সে থেকেই যেন মাদ্রিদে উপেক্ষিত গ্যারেথ বেল। তবে সেসব এখন সব অতীত। তিনি এখন তাকিয়ে রয়েছেন অনন্ত সম্ভাবনার দিকে।
সম্ভাবনা রয়েছে দেশের সর্বকালের সেরা তারকা বনে যাওয়ার। তিনি তো ভরসা জুগিয়েছেন। বিশ্বকাপ অবধি নিয়েও এসেছেন দলটাকে। ৬৪টা বছর তীর্থের কাক হয়ে অপেক্ষায় থাকা একটি দেশের জনগোষ্ঠী মাতবে এখন বিশ্বকাপের উন্মাদনায়। বিশ্বকাপের জ্বর নাকি ভীষণরকম তীব্র। এই জ্বর থেকে পরিত্রাণ মেলে না ঐ সোনালি ট্রফিটা কারও হাতে না ওঠা অবধি।
এবার ওয়েলসের জ্বরের মাত্রাটা নিঃসন্দেহে থাকবে সবচাইতে বেশি। বেলের কাঁধে দায়িত্বটাও থাকবে সবচাইতে বেশি। এই তারকার ফুটলারের কাঁধে ভর করেই তো ওয়েলস চাইবে এই বিশ্বকাপটা স্মরণীয় করে রাখতে। নিশ্চয়ই এই বিশ্বকাপ যাত্রা ওয়েলসের জন্যে ধারাবাহিকতার একটা পথ খুলে দেবে। অভিজ্ঞতার একটা ভারী ঝোলা নিয়ে ফেরা যাবে। অঘটিত বেশ কিছু ঘটিয়ে ফেলার সামর্থ্যও রাখেন তিনি।
আর বেলও নিশ্চয়ই বাড়তি প্রস্তুতি নিবেন। ইনজুরি মুক্ত থেকে যেতে চাইবে্ন কাতার। সেখানটায় নিজের সামর্থ্যের পুরোটা ঢেলে দিয়ে নিশ্চয়ই চাইবেন ওয়েলসকে বিশ্বকাপ জেতাতে। স্বপ্নটা তো হতেই হয় আকাশ ছোঁয়া।